ক্ষমতায় যাবার তাড়াহুড়া

১০৫ পঠিত ... ১৭:১৮, নভেম্বর ২৩, ২০২৪

25

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটি ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই নানারকম চাপে রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগের গুজবের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লবের ভ্রান্তস্বপ্ন। সেখানে ভারতের গদি মিডিয়া ১৬ জুলাই থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় পেরেশান হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের ক্ষমতাকাঠামোর ছায়া উপনিবেশ নয়; এই বাস্তবতা এখনো মেনে নিতে পারেনি মোদি প্রশাসন ও এর দোসরেরা।

দ্বিতীয় চাপটি কট্টর ইসলামপন্থীদের। সাড়ে পনেরো বছর বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের ইসলামোফোবিয়ায় নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা একগুয়ে হয়ে গেছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরে কট্টরপন্থী তৌহিদি জনতা পাগলপারা হয়ে যায়। তারা মাজার ভাঙ্গতে শুরু করে; একদল খিলাফতের ভ্রান্ত স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে।

তৃতীয় চাপটি বাংলাদেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের। বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ-প্রশাসন-মিডিয়া-গোয়েন্দা সংস্থায় একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে তারা যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে পড়েছিলো; জুলাই বিপ্লবের এক ঝটকায় সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ায়; তারা পশ্চিমের নানাদেশে মাইনরিটি কার্ড নিয়ে মিছিল করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলে; আর তার হিন্দু গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড পদায়িত হলে বাংলাদেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা অপেক্ষা করতে থাকে ‘অখণ্ড ভারত’ বাস্তবায়নের অনুকূল সময়ের।

চতুর্থ চাপটি বিএনপির। তারা ২০০৬ সালের পর থেকে ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে ক্ষমতায় যাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। এই যে ছাত্রজনতার রক্তনদী পাড়ি দিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন; তাকে বিএনপি সন্দেহের চোখে দেখে। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব বিকশিত হয়ে তারা পুরোনো পরিবারতান্ত্রিক বন্দোবস্তকে যদি ছুঁড়ে ফেলে দেয়; এই আশংকায় বিএনপি তার চিরশত্রু; সাড়ে পনের বছর ধরে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগকে তাদের কাংক্ষিত দ্রুত নির্বাচনে নিয়ে আসতে মরিয়া। বিএনপি আসলে আওয়ামী লীগকে নিয়ে ৫৩ বছরের ‘দেশকে টাকা বানানোর মেশিন’ হিসেবে ব্যবহারের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী। এই যে বিএনপি ও আওয়ামীলীগের নেতারা ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছে; দেশব্যাপী চাঁদাবাজি ও দখলের যে ক্ষমতা স্বর্গ তৈরি করেছে; সেটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়াটা তারা কল্পনাও করতে পারে না। বৃটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হিন্দু জমিদার, পাকিস্তানের স্বল্পস্থায়ী বন্দোবস্তের মুসলিম জমিদারদের মতো করে বাংলাদেশের বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা টিকিয়ে রাখতে তারা জুলাই বিপ্লবের তরুণ-তরুণীদের পথের কাঁটা মনে করছে। বাংলাদেশের জনমানুষকে অপরিবর্তনীয় বিএনপি-আওয়ামী লীগ উপনিবেশে তারা আটকে রাখতে চায় অনন্তকাল ধরে। তাই তারা যেনতেনপ্রকারেণ একটি নির্বাচন চায়; তারপর জমিদারির পতাকা উড়িয়ে ঘুরতে চায়।

পঞ্চম চাপটি জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় ছিলো কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পদ-পদবী পায়নি, এমন লোকেদের। বাংলাদেশ সংস্কৃতিতে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সুফল ও নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানের সুফল দ্রুত কুড়িয়ে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হবার, প্রোলেতারিয়েত থেকে বুর্জোয়া হবার উদাহরণ জুলজুল করছে; রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যেহেতু কিছু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে প্রচলিত; তাই জুলাই বিপ্লবের সুফল কুড়াতে না পেরে বেচায়েন কতিপয় বিপ্লবী। তাদের মনোভাব হচ্ছে, এতো কষ্ট করলাম, অথচ কোন পদ পেলাম না; সুতরাং গোল্লায় যাক ইউনুস সরকার।

আওয়ামী লীগ দেশের মিডিয়া, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে অসংখ্য লোককে পুষেছে পদ-প্লট-পদক ও আর্থিক অনুদান দিয়ে। তারা সক্রিয় রয়েছে ইউনুস সরকার বিরোধী প্রচারণায়। আর বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের কিছু লোক আধুনিক ও উদারপন্থী জীবন চর্যার সঙ্গে আওয়ামী লীগকে এক করে দেখে। কিছু নক্সী পাঞ্জাবি পরা সংস্কৃতি মামা; শাড়ি পরে কপালে কণ্ঠশিল্পী উষা উত্থাপের মতো ঢাউস টিপ দিয়ে সেজে কতিপয় সংস্কৃতি খালা  ছুটির দিনে নেমন্তন্নে এক হয়। সেখানে ঘুরে ফিরে একই আলোচনা, দেশটা ইসলামিক হয়ে গেলো। এরপর বসে বসে কুঁচ কুঁচ করে জুলাই বিপ্লবের কাসুন্দি, মুগ্ধ আর স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি; মুগ্ধ শহীদ হয়নি জাতীয় নরভোজি আলোচনা করতে করতে; দু'কলি রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে ওঠে। এরপর তারাপদ রায়ের কবিতা পড়ে; বিরাট একটা কালচারাল জমিদারের ভঙ্গিতে সোফায় ক্যাতরায়ে বসে থাকা। সেই ১৮৮৫ কিংবা ১৯২১-এর কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের পোশাক-দেহভঙ্গি-সংস্কৃতি কল্পনা নিয়ে চিন্তার জগতে কমপক্ষে একশো বছর পিছিয়ে থাকা এই ট্রাইবটি জানেইনা; কলকাতা নিজেই সেসব কালচার পিছে পেলে ২০২৪-এর আলোকসরণিতে যোগ দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদ বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় পায়না কলকাতায়। অথচ হিন্দুত্ববাদ প্রভাবিত আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি জমিদারেরা ইসলামোফোবিয়াকেই স্মার্টনেস প্রকাশের একমাত্র সূচক হিসেবে খুঁজে পেয়েছে। আওয়ামী লীগ একটি হিন্দুত্ববাদী কাস্ট সিস্টেম প্রচলন করেছে। এই কাস্ট সিস্টেমে আওয়ামী লীগ মানে ব্রাহ্মণ আর আওয়ামী লীগ নয় মানেই নিম্নবর্গ। পেটমোটা, কুঁজো, পোড়া বেগুনের মতো মেছতা পড়া মুখমণ্ডল, আউটডেটেড লাইফ স্টাইলের কি এক হাস্যকর ভ্রান্ত আর্য স্বপ্ন।

আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলাম। জীবন কেটেছে এংলো স্যাক্সন লিবারেল কালচারের আবহে; ফলে এই স্যাঁতসেতে কাস্ট সিস্টেমের ব্যাকডেটেড সোসাইটিকে কখনো প্রয়োজন পড়েনি আমার। আর বিতর্ক চর্চার বন্ধুরা যা কিছু অযৌক্তিক তাকে না বলার বিশ্বসংস্কৃতিকে রপ্ত করায়; সংস্কৃতি মামা ও খালাদের ট্রাইবাল কালচারাল সার্কেলে বন্ধু খুঁজতে হয়নি। এটা যে কত বড় রিলিফ, তা এখন বুঝতে পারি। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ইংলিশ মিডিয়াম থেকে আসা বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি। আর তাই সংকীর্ণ জাত্যাভিমানের পাতকূয়াতলায় কক্ষণো যেতে হয়নি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হচ্ছে সাধারণ মানুষ; যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে স্যুডো এলিট হবার চেষ্টায় মরিয়া নয়। তাইতো তারা স্পেডকে স্পেড বলতে পারে। তারা ভোট দেবার সুযোগ পেলে লালসালুর মাজার ভিত্তিক দুটি রাজনৈতিক দলের কাউকে পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতায় রাখে না। ভোট দেবার সুযোগ না পেলে ফ্যাসিস্ট শাসককে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ-রিক্সাওয়ালা-ক্ষুদে দোকানির যে মনের ঔদার্য্য আছে; কথিত সংস্কৃতি মামা-খালাদের তা নেই। 

আমি খুবই আশাবাদী জেন জি'দের নিয়ে। তারা ইন্টারনেট সংযুক্তির কারণে বিশ্বনাগরিক; আবার প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক। ঐ সাম্য চিন্তা, গরিবমানুষকে শ্রদ্ধা করা ও ভালোবাসার মনোভঙ্গিই; ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মেহনতি মানুষদের যুক্ত করেছিলো জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে। বাংলাদেশ আমলের কতিপয়তন্ত্রের জমিদারি ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে তারুণ্য ও মেহনতী মানুষের ঐক্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে বাতিল করতে হবে পুরোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে। আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি মামাদের অন্তহীন কাস্ট সিস্টেমের বয়ান প্রত্যাখ্যান করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা। ভি আইপি কালচারকে কবর না দিলে মুক্ত বাংলাদেশের অধরা স্বপ্নকে কিছুতেই স্পর্শ করতে পারবো না আমরা।

১০৫ পঠিত ... ১৭:১৮, নভেম্বর ২৩, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top