এই যে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল বললেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক তা আমি চাই না; জামায়াতের আমীর বললেন, আমরা রাজনীতি পরিবারের লোক; তাই কাউকে সারাক্ষণ ফ্যাসিস্ট বলতে ভালো লাগে না; বিএনপি নেতা রিজভী ইন্সটিংকটিভলি বললেন, শেখ মুজিবের ছবি নামানো ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ এরকম নৈতিক, মানবিক ও সভ্যগুনের অধিকারী।
ভেবে দেখুন, মির্জা ফখরুল ও রিজভীর দলের কর্মীদের ওপর কি অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে হাসিনার পুলিশ ও অনুসারীরা; জিয়াউর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলেছে তারা; মুক্তিযুদ্ধের খেতাব কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। হাসিনা তো গণভবনে সাংবাদিকদের ‘প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি’ অনুষ্ঠানে খালেদাকে নিয়ে অশ্রাব্য সব কথা বলেছেন। আর তারেক রহমানের নাম মুখে আনলেই তাকে অশালীন কথা বলেছে ফেসবুকের সিপি গ্যাং। এই জামায়াতের আমীর ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্টার হাতে এঁকেছেন; এরপর জাসদ করেছেন; এর অনেক পরে জামায়াতে যোগ দিলেও; তাকে সারাজীবন শতমুখে ‘রাজাকার’ বলেছে হাসিনার গালাগালির বিনিময়ে খাদ্য (গাবিখা) প্রকল্পের লোকেরা।
আপনি যদি শেরে বাংলা, ভাসানি, সুহরোয়ার্দি, শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার নিজের ও তাদের অনুসারীদের মুখের ভাষা পর্যালোচনা করেন; দেখবেন তারা প্রত্যেকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী শিষ্ট ও সুন্দর রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। শেখ হাসিনাও ১৯৮১ থেকে ২০০১ একজন সহনীয় ভদ্রমহিলার মতোই কথা বলেছেন।
কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। এসময় তার দলে নাৎসিরা এসে জুটে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চ-বর্গীয় গালির পসরা সাজিয়ে বসে সিপি গ্যাং। তাদের আর্থিক অনুদান দিয়ে মিডিয়ায় ধরা পড়ে যায় পলক। আরাফাত টিভির টকশোতে এসে প্রথমবারের মতো অশালীন আচরণ করতে শুরু করে। পুলিশ বিপ্লব প্রকাশ্যে আজে বাজে কথা বলতে থাকে। সেই নবাবী আমলে দাক্ষিণাত্যের যে বর্গীরা হানা দিয়েছিলো পূর্ববঙ্গে; তাদের ডিএনএ দখল নেয় আওয়ামী লীগের। ২০০৯ থেকে ২৪ ফেসবুকে যারা অকথ্য গালাগাল করেছে; আর এর আড়ালে যারা টাকা লুণ্ঠন ও পাচার করেছে তাদের চেহারা বিশ্লেষণ করলে দেখবেন বর্গীদের স্পষ্ট ছাপ সেখানে রয়েছে। আর ভারতে মোদি ক্ষমতায় আসার পর যে অশালীন শব্দচয়ন ও মুখভঙ্গির ভক্তগোষ্ঠী তৈরি হয়; তাদের অনুকরণে ও অনুসরণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের হিন্দুত্ববাদী প্রভাবিত অংশটি ফেসবুকে লোকজনকে ‘বিভিন্ন রকম পশুর বাচ্চা’ বলে গালি দিতে শুরু করে। আওয়ামী লীগের ইসলামপন্থী প্রভাবিত অংশটি শুরু করে ভয়ভীতি দেখাতে।
শত শত বছর আগে অপরাধী বর্গী হয়ে যাওয়া ডিএনএগুলো নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটাসংস্কার আন্দোলনে এসে হেলমেট পরে হাতুড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘বর্গীরা দেয় হানা’ বাক্যটি তাদের নৃশংসতা ও অঙ্গসৌষ্ঠবের সঙ্গে মানানসই। ফলে এদের কালচারের সঙ্গে বাংলাদেশ কালচারের অনেক অমিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীরা সেই বাল্যকাল থেকে আওয়ামী বর্গীদের হানায় বিপর্যস্ত। জুলাই ১৫ থেকে ৫ অগাস্ট তাদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় এই আওয়ামী বর্গীরা। কিন্তু এতোসব সহ্য করেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ভাষার সৌন্দর্য্য ধরে রেখেছে। হাসিনার দোসরের হিন্দুত্ববাদ প্রভাবিত এটা ওটার বাচ্চা খিস্তির বিপরীতে বড় জোর একটা হারপিকের বোতল দেখিয়েছে। যে মুখ দিয়ে টয়লেটগন্ধী গালাগাল নিঃসৃত হয়; তা পরিষ্কার করতে তো হারপিক প্রয়োজন।
ফেসবুকের সিপি গ্যাং-এর চ-বর্গীয় ও এটাওটার বাচ্চা গালিতে হাহা ইমো দিয়ে খুশিতে বাকবাকুম যেসব সংস্কৃতি মামা প্রবল পুলকে রবীন্দ্র সংগীত শুনে ঘুমাতো; তারা বড্ড রুচি নির্ধারক হয়ে এসে (এটা ওটার বাচ্চা বলে গালি দেয়াটা ঠিকই আছে) কিন্তু হারপিক দেখানো হয় নাই বলে রুচি চানাচুর বিক্রি করছে।
আমাদের শৈশবে আফঘানিস্তানে মার্কিন-সোভিয়েত যুদ্ধের অভিঘাতে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদের ভীতি ছড়িয়ে পড়ায়; ইসলামের সৌন্দর্যের পরিবর্তে ভীতি জায়গা করে নিয়েছিলো আমাদের মনে। যে কোন সুন্দর জিনিস ঘাতকের হাতে পড়লে তা ভীতিপ্রদ হয়ে ওঠে। ফলে প্রকাশ্যে ইসলাম সম্পর্কিত আলাপ আমরা এড়িয়ে চলেছি।শিবিরের নারা এ তাকবির আল্লাহু আকবর শ্লোগান শুনলেই ভয় হতো, এই বুঝি সন্ত্রাসী হামলা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রছাত্রীরা তাদের শৈশবে শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আইকনকে ভীতিপ্রদ চেহারায় দেখেছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান শুনলেই সন্ত্রাসী হামলার আতংক এসেছে তাদের মনে। মুক্তিযুদ্ধের সৌন্দর্য ও বঙ্গবন্ধুর সুকৃতির পরিবর্তে ভীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে এই বিষয়গুলো। ফলে তারা এসব আলোচনা এড়িয়ে চলতে চায়। হিটলারের নাতসি অনুগামীরা যেমন সোয়াসটিকা চিহ্নের পিন পরতো জামার পকেটের ওপরে; হাসিনার বর্গী অনুগামীরা ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর ছবি চিহ্নের পিন পরেছে মুজিব কোট, জামা ও পাঞ্জাবির বুকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টিতে সোয়াসটিকা যেমন ভীতির আইকন ছিলো, হাসিনার ফ্যাসিজমের দেড় দশকে তেমনি মুজিবের ছবি ও ভাস্কর্য হয়ে ওঠে ভীতির আইকন। ফলে এই প্রজন্মের তরুণ তরুণীর মধ্যে মুজিবের ছবির প্রতি নেতি তৈরি হয়েছে।
আমাদের তরুণ বয়সে আমাদের ইসলাম ভীতির কারণ অনুসন্ধান না করেই; ইসলামের মর্যাদা রক্ষার স্বপ্রণোদিত ম্যানেজারেরা আমাদের ইহুদি-নাসারা-এটা ওটা সেটা কত কিছু বলতো। এ যুগের তরুণের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু ভীতি দেখে; চেতনা ও মুজিবের মর্যাদা রক্ষার স্বপ্রণোদিত ম্যানেজাররা তাদের ইসলামি-পাকিস্তানি-মার্কিন-এটা-ওটা-সেটা কত তকমাই দিচ্ছে। যত্রতত্র "রাজাকার" তকমা দেয়ায় বাংলাদেশের মানুষ তাদের সজোরে চপেটাঘাত করার পরেও লজ্জার লেশমাত্র নেই। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদের জয়শ্রীরাম মিডিয়ার "বাংলাদেশ তারুণ্য বিরোধী" অপপ্রচার।
আসলে ইসলামি চেতনা হোক আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হোক; তা যদি পেট চালানোর অবলম্বন হয়; তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েও মানুষ সাবহিউম্যান হিসেবে রয়ে যায়। তরুণ মনোজগতের সূক্ষ্মতম ক্ষত নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না পেটের ধান্দায় আকুল কথিত শিক্ষিত লোকেদের।
টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। যা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিষয়; তার মর্যাদা রক্ষার জন্য ফেসবুক সৈনিক প্রয়োজন নেই। এই কমনসেন্স বাকশাল টু পয়েন্ট ও আর খিলাফত টু পয়েন্টের লোকেদের নেই। তারা সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা শেষ কৃত্য অনুষ্ঠানের শোকের মধ্যেও নিজ নিজ চেতনা বিক্রি করতে চায়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন