আমি যখন ব্যাচেলর পড়া শুরু করি তখন ২০২১ সাল। ভর্তি হলাম ইসলামিক য়ুনিভার্সিটি অফ গাজার (IUG) আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। সবসময় যা পড়তে চেয়েছি সেই বিভাগেই সুযোগ পাওয়ায় এক ধরনের আত্মতৃপ্তি ছিল। ধরে নিয়েছিলাম আগামী পাঁচ বছরের জন্য জীবনটা নিশ্চিত এবং সুন্দর। নিয়মিত পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করব, ভালো কোম্পানিতে ইন্টার্ন করে মাস্টার্সের জন্য অ্যাপ্লাই করব—ভাবছিলাম, এই তো জীবন।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ৭ অক্টোবর কী হলো? সেদিন একটা প্রজেক্ট জমা দেওয়ার কথা। অনেকদিন খাটাখাটনি করছিলাম সেটা নিয়ে। সকালবেলা থেকে বোমাবর্ষণ শুরু হলেও সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে প্রজেক্টের উপর ফোকাস রাখার চেষ্টা করছিলাম। গাজার ওপর ইসরাইলের হামলায় আমরা অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকে এসবের মধ্যেই বড় হয়েছি। তাই প্রজেক্টে মনোযোগ দিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
তবে এরপর খবর পেলাম য়ুনিভার্সিটির ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। ভেবেছিলাম দ্রুতই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। সে আশায় প্রজেক্ট শেষ করে জমা দিয়ে দিলাম।
এর পরদিন, মানে ৮ অক্টোবর, তিনজন ক্লাসমেটের সাথে একটি গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আলোচনায় বসার কথা। আলোচনায় বসার পরিবর্তে কানে এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন খবর। এর জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না! সেই তিনজনের একজন, আমার প্রিয় বন্ধু আলা ইসরাইলি বিমান হামলায় মারা গেছে। আলার সাথে গ্রুপ ডিসকাশনের বসার পরিবর্তে তার জন্য কাঁদতে কাঁদতে দিনটি কেটে গেল।
অবস্থা ততদিনে বেগতিক। অক্টোবরের ১৪ তারিখ গাজাকে বিদায় জানিয়ে পরিবার নিয়ে চলে যাই খান ইউনুস শহরে। নিরাপত্তার আশাতেই বলতে পারেন। জন্মভূমি গাজায় ফেলে আসি বই, ল্যাপটপ, কষ্টার্জিত প্রজেক্টসহ পড়ালেখার যাবতীয় জিনিস।
মানুষ মাত্রই স্বপ্নপ্রিয়। সে খড়ের ঘরে শুয়ে ছাদে হাঁটার স্বপ্ন দেখে। খান ইউনুসে বসেও আমি য়ুনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। সত্যি কথা বলতে, য়ুনিভার্সিটিতে যাওয়াও হয়েছিলো—তবে পড়ালেখার জন্য নয়।
ডিসেম্বরের শুরু হয়েছে তখন। আমরা খাজা ইউনুসে যে বাসাটায় থাকতাম, তার উল্টোপাশের মসজিদে বোমা হামলা করে ইসরায়েলি আর্মি। আমরা সন্ত্রস্ত অবস্থায় যার যার অবস্থান থেকে চলে যাই পাশের আল আকসা য়ুনিভার্সিটিতে। এই তো আমার য়ুনিভার্সিটি যাওয়ার গল্প। সেদিন রাতেই আমরা যে বিল্ডিং-এ থাকতাম, সেখানে হামলা হয়। ধংসযজ্ঞের পর সেখানে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের কোনো সহায় সম্পদ ভুলক্রমেও যদি তখনও অক্ষত থাকে—এই আশায়!
খান ইউনুসে আমরা আরো দেড়মাস কাটালাম। ইন্টারনেটে ঢুকতে তখন বুক কাঁপত। মানুষের খোঁজ-খবর না নেওয়ার খুব চেষ্টা করতাম। তবু মন মানত না। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলে মনে হতো, একটি দুঃস্বপ্নে প্রবেশ করেছি। ভয়ংকর সেই দু:স্বপ্ন। আশেপাশের চেনা মানুষগুলোর মৃত্যুর খবর আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ডিসেম্বরেই ফাতেমা নামের আরেক বন্ধুর খবর পাই— ইসরায়েলি আর্মি যাকে পরিবারসহ হত্যা করেছে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে ইসরায়েল বোমা হামলার সংখ্যা আরও বাড়ায়। এ যেন তাদের গৃহীত শপথ, প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে নৃশংস হয়ে ফেরত আসা। ততোদিনে খান ইউনুসে মারা গেছে শত শত মানুষ। এমনকি আমাদের পাশে আল খায়ের হাসপাতালও বাদ যায়নি এ আক্রমণ থেকে। আমরা আবার পালাতে থাকি। মনে হয়, অনন্তকাল ধরে আমরা দৌড়ে চলছি। ক্লান্ত লাগলেও একটু বিশ্রাম নেবার সুযোগ নেই। অবশেষে আমাদের ঠিকানা হয় রাফায়, রাস্তার পাশে একটি তাঁবুতে। বিভীষিকাময় জীবনে ভয়ের পাশাপাশি ভর করে বিষাদও।
অন্ধকার ঘূর্ণিঝড়ের ভেতর হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোর মতো গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল হয়ে দেখা দিলো একটি সংবাদ। লক্ষ খারাপ সংবাদের ভেতর এ যেন এক অনাকাঙ্খিত অতিথি। শোনা যায়, ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে ওয়েস্ট ব্যাংক য়ুনিভার্সিটিগুলো গাজার ছাত্রদের অনলাইনে ভর্তি এবং ক্লাস করার সুযোগ দেবে। লুফে নিলাম এ সুযোগ। অ্যাপ্লাই করে অপেক্ষা করতে লাগলাম যে কোনো য়ুনিভার্সিটি থেকে ডাক পাবার জন্য।
সমুদ্রে যখন ডুবে যাচ্ছিলাম, ভেলা এগিয়ে দিলো বার্জিত য়ুনিভার্সিটি (BZU)। বেশ কয়েকটি কোর্সে নিজেকে এনরোল করলাম। ভাবলাম, এবার নিশ্চয়ই পড়াশোনাটা আবার ধরতে পারব! তবে আমার এই মানসিক শান্তি ছিল ক্ষণিকের জন্য।
সেমিস্টারে ভর্তি হবার ৫ দিন পরই আবার শুরু হলো চিরচেনা উদ্বাস্তু জীবন। হন্যে হয়ে পালাতে লাগলাম ইসরায়েলি আর্মির হাত থেকে। তখন প্রবল আক্রমণের শিকার রাফা। চারদিকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। আমরা আবার ফেরত গেলাম খান ইউনুসে।
খান ইউনুসে পৌঁছে দেখলাম, তাকে দেখাচ্ছে একটি সর্বহারা ভূতের শহরের মতো। চারদিকে কেবল ধ্বংসস্তূপ। স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য এমন অবাসযোগ্য একটা জায়গা আমাদের বেছে নিতে হলো। অবশ্য আর কোনো উপায় ছিলো না। দশ লাখের বেশি মানুষ তখন রাফা থেকে চলে আসে। আর দেইর আল বালাহের (Deir Al Balah) মতো জায়গাগুলো ছিলো লোকে ঠাসা।
জায়গা পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার পড়ালেখার স্বপ্ন আবার উবে গেল। বুঝতে পারছিলাম বারজিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেশিদিন নেই। রাফায় রাস্তার তাঁবুর জীবন কঠিন হলেও মোটামুটি সবজায়গায় ইন্টারনেট ছিলো। অনলাইন ক্লাসে অন্তত অ্যাটেন্ড করা যেতো। কিন্তু খান ইউনুসে এর উল্টো চিত্র। সবচেয়ে কাছাকাছি যে জায়গা থেকে কানেকশন পাওয়া যায়, আল মাওয়াসি, তা আমার থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। শেষমেষ সাত কিলোমিটার হেঁটেই বারজিত বিশ্ববিদ্যালয়কে ইমেইল পাঠিয়ে জানালাম, সেখানে আমার পড়া হবে না।
গতবছরের জুন মাসে জানতে পারি আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক য়ুনিভার্সিটি অব গাজা (IUG) অনলাইনে পড়াবার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে ইনস্ট্রাক্টর থাকলেও পড়তে হবে নিজের। সেল্ফ স্টাডি।
প্রতিটি কোর্সের জন্য আলাদা ইনস্ট্রাক্টর খুঁজে পাওয়া ছিলো বেশ দুরূহ ব্যাপার। অনেক প্রফেসর মারা গিয়েছেন, আর যারা বেঁচে আছেন তারাও দিন কাটাচ্ছেন ভীষণ কষ্টে। পরিবারকে খাবার-পানি সরবরাহ করতেই হিমশিম অবস্থা। এর ফলে ব্যাপারটা যা দাঁড়ালো, ৮০০ জন ছাত্রের জন্য আমরা পেলাম একজন ইনস্ট্রাকটর।
দুটো কোর্সে আবারও ভর্তি হলাম। প্রতিদিন মাথার উপর গনগনে সূর্য, শহরের নামে ধ্বংসস্তুপ ও নর্দমার পানি পেরিয়ে সাত কিলোমিটার হেঁটে যেতাম আল মাওয়াসি। উদ্দেশ্য হলো অনলাইন লেকচারগুলো ডাউনলোড করা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্পর্শে থাকা।
তবু বোধহয় সে সময়টা আমি ভালো ছিলাম। গরম তাঁবুতে বসে আক্ষেপ আর হতাশায় দিন কাটানোর চেয়ে সাত কিলো হাঁটা আনন্দের।
কিন্তু এভাবে আসলে হচ্ছিল না। যতদিন যাচ্ছিলো, চ্যালেঞ্জও তত বাড়ছিল। পড়াশোনা আবার শুরু করার পরই ইসরায়েলি আর্মি আল মাওয়াসিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ক্যাম্পগুলো আটটি বিশাল বোমা হামলা হয়। আল মাওয়াসিতে অন্তত ৯০ জন নিহত এবং ৩০০ জনের মতো মানুষ আহত হয়।
চারদিকে তখন কেবল ভীতি। নিরাপদ জায়গা বলতে কিছু নেই। যেসব জায়গায় 'নিরাপদ আশ্রয়' নিতে বলা হয়, সেগুলোও আমার ততদিনে আর বিশ্বাস হয় না।
এক সপ্তাহের মতো অনলাইনে যেতে পারিনি। ইসরায়েলি আর্মি তখন টেলিকম্যুনিকেশন সিস্টেমে হাত দিয়েছে। ইন্টারনেট নেই, নেটওয়ার্ক দুর্বল। যখন ইন্টারনেট কানেকশন পেলাম, তা এতোই দুর্বল ছিলো যে একটা বই ডাউনলোড করতেই দু'দিন সময় লাগল।
তবু আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতে কী! বাধাগ্রস্ত হবার জন্যই যেন সব চেষ্টা। আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, ইসরায়েল মিলিটারি বাহিনী নির্দেশে সেখানে হাজার হাজার মানুষকে অন্যান্য জায়গা থেকে পাঠানো হলো। ইভাকুয়েশন অর্ডার এসেছে। রাতারাতি জায়গাটা এত মানুষে ঠাসাঠাসি আর চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরে গেলো যে, পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়াই কঠিন হয়ে উঠল।
মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া ছিলো ভোগান্তির আরেক নাম। দু'দিন পর পর সকালবেলা একটি চার্জিং সার্ভিসে ফোনটি দিয়ে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। পাক্কা একদিন লাগতো ফোন ফেরত পেতে।
পরীক্ষা হলো অগাস্ট মাসে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ের জন্য ভালো ইন্টারনেট কানেকশন পেতে আমাকে কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। তাও যখন স্টেবল কানেকশনের সন্ধান পেলাম, এক ঘণ্টার জন্য গুনতে হলো বিশাল অঙ্কের টাকা। যতটুকু পারি তাই নিয়ে বসলাম পরীক্ষা দিতে।
তিন সপ্তাহ পর রেজাল্ট দিল। দুটো পরীক্ষাতেই A+ পেয়েছি। সেদিনের মতো খুশি অনেকদিন ধরে হতে পারিনি। হাসি যেন থামছিলই না। এরপর আমি দ্বিতীয় ধাপের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছর পর এই ইম্প্রোভাইজড সেমিস্টার শেষ হয়। উদ্বাস্তুর মতো কাটানো এই সময়টায় আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো পরিচিত মানুষ হারানোর বেদনা, দুঃস্বপ্ন আর বিস্ফোরণের শব্দ। পড়াশোনার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝেছি আমার আগের জীবনের 'সামান্য' জিনিসগুলোর গুরুত্ব। আমার পড়ার টেবিল, বিছানা, ঘর, বিকেলের চা আর চকোলেটের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
পরীক্ষার জন্য দুই মাসের প্রস্তুতি নেবার সময়টা প্রতিনিয়ত জাপটে ধরা কষ্ট আর ক্ষয়ক্ষতির কথা কিছু সময়ের জন্য ভুলতে সাহায্য করেছে—এটাই বা কম কী? এ সময়টা আমার জন্য ছিল এক চেতনানাশক ইনজেকশনের মতো, যা প্রচণ্ড ব্যথা থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি দিয়েছিল।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন