ঢাকার বাইরে যে বিস্তীর্ণ বাংলাদেশ; সেখানে জীবন এখনও সহজ; মানুষের মনের সরলতায় আনন্দময় সেসব জনপদ। ঢাকা কেন্দ্রিক দুই তিনটি রাজনৈতিক দল আর তাদের ন্যারেটিভ বানানোর সঙ্গীদের জীবন-জীবিকা ও মন যেরকম ক্ষমতাকেন্দ্রিক; ঢাকার বাইরে তা একেবারেই নয়। ঢাকার বাইরে যে সহিংসতা বা সংঘাতের অল্প কিছু ঘটনা ঘটে; তার উস্কানি মূলত ঢাকা থেকে দেয়া হয়।
চট্টগ্রামে দুর্গা পূজা উপলক্ষে আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে গান গাইতে গিয়েছিল একটি সাংস্কৃতিক দল। তারা সেখানে দুটি গান পরিবেশন করে। এর মধ্যে একটি গানকে ইসলামি বিপ্লবের গান বলে উত্তেজনা তৈরি করেছে ঢাকাস্থিত একটি রাজনৈতিক বলয়। অথচ সেই গানটিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদে অন্যধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও আনন্দময় বসবাসের ইতিহাস বর্ণনা করে। অসাম্প্রদায়িক মদিনা কনভেনশনের অধীনে যে অসাম্প্রদায়িক আরব; তার প্রেক্ষিতটিই তুলে ধরা হয়েছে এই গানে।
ঈদ পুনর্মিলনীগুলোতে অনেক হিন্দু শিল্পী সংগীত পরিবেশন করেন; সেখানে তারা রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গান থেকে মান্নাদের পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে গেয়েছেন; তারা কী গাইছেন; তা নিয়ে কখনও কোথাও প্রশ্ন উঠতে দেখিনি। আগেই বলছিলাম ঢাকার বাইরের বাংলাদেশ এতটা জটিল ও কুটিল নয়।
এমনকি বিংশ শতক পর্যন্ত ঢাকায় যেরকম হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ছিল তা আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের সোনালি সময়ই বলতে হবে।
ঢাকায় জনসংখ্যার চাপে মনের জন্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্ম জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বিচরণ করলেও; সবুজের অভাবে খুব বেশি ঔদার্য্য ধারণ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
ফেসবুকে একবিংশ শতকে যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তা দেখলাম; তাদের মাঝে নানামুখী জটিলতা দেখে মনে হয়েছে; পৃথিবীর এর চেয়ে বড় কসমোপলিটানের ছেলেমেয়েরাও তো এতো জটিল কিংবা যান্ত্রিক নয়।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলয়ে বেড়ে ওঠা এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক থেকে তিন হাজার স্কোয়ার ফিটের মাঝে বসবাস করেও আলিশান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো ভাবভঙ্গী। বংকিম চন্দ্রের অহম।
আমাদেরকে তারা কৃষক প্রজা ভেবে কত কিছু শেখায়; রবীন্দ্রনাথ শেখায়, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি শেখায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেখায়, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি শেখায়। তাদের বৈঠকখানার অমিত লাবণ্য আমাদের মার্কেজ ও ফ্রিদা কাহালোর আলো এনে দেয়। আমাদের স্কুলের পাঠ্যে একটি গল্প ছিলো মহতের লজ্জা নামে। এক লবণাক্ত পানি পানে অভ্যস্ত ব্যক্তি ভ্রমণকালে ঘাসের মধ্যে জমে থাকা মিষ্টি পানি পান করে বিস্মিত হয়ে তা চামড়ার ব্যাগে ভরে নেয়, একে স্বর্গের জল ভাবে। পরে বাদশাহ'র সঙ্গে দেখা হলে ঐ পানি উপহার দেয়। বাদশাহ ঐ পানি মুখে দিয়েই বোঝেন লবণাক্ত জল পান করে অভ্যস্ত ঐ লোক ময়লা বৃষ্টির পানিকে আবে হায়াত ভেবেছে। কিন্তু তিনি লোকটির এই ভুল ভাঙ্গান না। একেই লেখক বলছেন মহতের লজ্জা ।
আমি দীর্ঘকাল মহতের লজ্জায় আওয়ামী লীগের এই সাংস্কৃতিক বলয়ের স্যুডো কালচারাল একটিভিজিম সম্পর্কে কিছু বলিনি। কিন্তু গত সাড়ে পনেরো বছরে তাদের ভ্রান্ত অধ্যাস বা হ্যালুসিনেশান এমন পর্যায়ে পৌঁছায়; যে হালে কলকাতা-দিল্লিতে কারো কারো সঙ্গে পরিচিত হয়ে; তারা আমাদের কলকাতা ও দিল্লি দেখাতে এলো। আমি মহতের লজ্জায় একথাও বলিনি যে, কলকাতা ও দিল্লিতে স্যুডো আরেকটি চক্রের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের লীগ-বিজেপি বন্ধুতাসূত্রে। দেখা হয়নি তাদের সঙ্গে যারা সহজ সরল মনের মানুষ; সহজাত মানবিক।
আসলে পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই যারা প্রাচ্য ও প্রতীচ্য বিদ্যা-দর্শনের সংস্পর্শে এসেছেন বহু আগেই; তারা বুঝে গেছেন জীবনের গভীরের জীবন কি করে দেখতে হয়। নীরবে কি করে জীবনানন্দের মতো বিরাজ করতে হয় জগত সংসারে।
এক্সজিবিশনিজম জিনিসটা সব সময়ই নতুন পয়সা, নতুন রবীন্দ্র সংগীত, নতুন শেক্সপিয়ারদের। কথাসাহিত্যিক টমাস হার্ডি ইউরোপে শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ঠিক এরকম খেলনা সমাজকে ফিলিস্টাইন্স বলতেন। সত্যজিত রায়ের শাখা-প্রশাখা চলচ্চিত্রের কর্পোরেট স্মার্টনেস দেখিয়ে ফাঁপা প্রশ্ন করা ফ্রেঞ্চ কাট লোকটির মতোই প্রশ্ন এদের। সামান্য টাকা পয়সা হবার অতি আত্মবিশ্বাস এদের।
আওয়ামী লীগের দুর্নীতি শিল্প বিপ্লবকে ঘিরে যে নব্য ফিলিস্টাইন্স তৈরি হয়েছে; তারাই মনে করে সাম্যচিন্তার সমাজ হতে পারে না। তাকে ফেসবুকের জমিদার দাদা বা আপ্পি হতে হবে। ঘাড় গুঁজ করে জ্ঞানের ভারের ন্যুব্জ হয়ে নানারকম সনদ বিতরণই এদের কাজ। সার্টিফিকেট না দিয়ে কথাই বলতে পারে না। এরকম জাজমেন্টাল গোত্র পৃথিবীর আর কোন শহরে নেই।
আসলে বাংলাদেশ সমাজে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত মানুষের মধ্যে যারা বুদ্ধাংকের জটিলতার কারণে পিছিয়ে পড়েছিল; আওয়ামী লীগ তাদের জড়ো করেছিল গত সাড়ে পনের বছর ধরে। শেখ হাসিনা যেহেতু শুধু প্রশংসা চান; প্রশ্ন চান না; তাই শুধু যারা প্রশংসা করতে পারে; তাদের নিয়ে উন্নয়নের সরকার গড়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে মূলত ঐ নিম্ন বুদ্ধাংকের কারণে। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও অনুতাপহীন থাকা আসলে আই কিউ সেভেনটি ফোরেরই স্মারক। আই কিউ ৭৫ হবার কারণে বিজেপি সমর্থক শিবব্রত দাদা এদের থিংক ট্যাংক। তার ওস্তাদি জাস্টিফিকেশন ও ন্যারেটিভ নির্মাণে। সেগুলো হাস্যকর শোনানোর কারণ আইকিউ বিভ্রাট।
আওয়ামী লীগের পতনের পর জমিদারি হারানোর যন্ত্রণায় সহমত ভাই ভাবছে; কে বলেছে আমরা শুধু প্রশংসা করতে পারি; প্রশ্ন করতেও পারি; এবার ইউনুস সাহেবকে প্রশ্ন করে দেখিয়ে দেবো। ইউনুস সাহেবকে তারা জিজ্ঞেস করে, বলুন আই ডোন্ট নো মানে কি! ইউনুস সাহেব উত্তর দেন, কি সব পুরোনো প্রশ্ন করছেন; রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে নতুন প্রশ্ন করুন যা আগামী বিনির্মাণ সম্পর্কিত।
অমনি আওয়ামী লীগের ললিতারা রিসেট বাটন রিসেট বাটন বলে খলবল করতে শুরু করলো।
মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের রক্ত-ত্যাগ থাকুক না থাকুক; শুধু আওয়ামী লীগ করার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ম্যানেজার তারা। ইসলাম সম্পর্কে জানুক না জানুক; শুধু জামায়াতের সদস্য হবার কারণে ইসলামের ম্যানেজার যেমন তৌহিদী জনতা।
বাংলাদেশে আপনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ করতে গেলে কিংবা তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে সংস্কার আলাপ করতে গেলে; ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশ সমাজ উত্তরণ না ঘটার জন্য দায়ী এই দুই ম্যানেজার গোষ্ঠী; আলোচনা ডিরেইল করে দিয়ে গোলেমালে দেশ লুণ্ঠন করে আর ভিন্নমতের মানুষ খেয়ে বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে গেছে এই দুটি ম্যানেজার সমাজ।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন