সম্পদের সুষম বণ্টন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মানবিক মর্যাদার সুষম বণ্টন সম্ভব। শেষ কবে আপনি একজন গরিব মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছেন! আপনি যদি মালয়েশিয়া, তুরস্ক, জার্মানি এরকম অগ্রসর সমাজে মেলামেশা করেন, দেখবেন সম্পদের ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ধারণের গ্রামীণ জমিদারি চিন্তাটা সেখানে নেই।
আমাদের সমাজে কোনো মানুষের একটু সম্পদ হলেই তার মধ্যে একটা সেন্স অফ অ্যানটাইটেলমেন্ট বা জমিদারি মনোভাব তৈরি হয়। সে মনে করে অন্যেরা তাকে সমীহ করে চলবে। সে তার গৃহকর্মী, ড্রাইভার, চৌকিদার ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সঙে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে দুর্ব্যবহার করবে। সবাইকে ঐ কর্কশ আচরণ মেনে চলতে হবে।
ধনী-গরিবের ব্যবধান যদি পারস্পরিক আচরণে না থাকে, তাহলে এই সামাজিক বিশৃঙ্খলা কমে আসবে।
যে সম্পদশালী মানুষ ফিল্যানথ্রপি করেন, অধিকার বন্চিত শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণের কিছু দায়িত্ব নেন; তার জীবনে মানুষের ভালোবাসার অভাব হয় না। ব্যাখ্যাতীতভাবে এরকম পরোপকারী নিরহংকার মানুষের উত্তর পুরুষ সুখী জীবন যাপন করেন।
সাধারণত যে শিশুরা দারিদ্র্য ও অবহেলায় কর্কশ জীবন কাটায়; এদের মধ্যে জমিদার ও ক্ষমতাশালী হবার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়। ফেসবুকে যখন কাউকে ইসলামি চেতনা, হিন্দুত্ববাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিক্ষা দিতে দেখবেন; বুঝবেন সে ধর্ম অথবা দেশপ্রেম ব্যবসা করে নতুন জমিদার হতে চায়।
বাংলাদেশে অবহেলিত শিশুর সংখ্যা বেশি বলেই তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে রাজনীতির ডাকাত দলগুলোতে তাদের ফুটসোলজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়। কারণ বৃটিশ আমল থেকে গ্রাম বাংলার একমাত্র স্বপ্ন জমিদার হওয়া।
যেহেতু সমাজে সম্পদশালীদের আত্মকেন্দ্রিকতা থাকে, শুধু নিজের সন্তান নিয়ে আদিখ্যেতাময় জীবন তাদের; তাই দরিদ্র শিশুদের চোখে তারা খলনায়ক। রাজনীতি ও ধর্ম ব্যবসায়ীরা এই শিশুদের ব্রেন ওয়াশ করে এই বলে যে, বাকশাল বা খেলাফত কায়েম হলে এই বৈষম্য থাকবে না। ফুটসোলজারেরা তখন গ্যাং পাকিয়ে একদলীয় বা এক ধর্মীয় শাসন কায়েমের জন্য রাজপথ ও ফেসবুকে ঘুরতে থাকে।
যে মানুষটি সত্যিকার দেশপ্রেমিক তিনি নীরবে দেশের জন্য কাজ করেন। কক্ষনও দেশপ্রেমের ম্যানেজার হন না। ম্যানেজার হয় দেশ ডাকাতি করে জমিদার হতে চাওয়া লোকেরা। যে মানুষটি ধার্মিক তিনি সৎ ও নৈতিক জীবন যাপন করেন। কক্ষনও ধর্মের ম্যানেজারি করেন না।
বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেখবেন এই দুই জাতীয় ম্যানেজার ভিক্ষুক থেকে জমিদার হয়। এরা মুখে যে ইজম টিজমের কথা বলে, এগুলো ভাটের আলাপ।
বাংলাদেশের মতো দেশপ্রেম ও ধর্ম প্রেম নিয়ে হুজ্জোতি ও সামাজিক পুলিশি আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না।
এ কারণে কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরির আলোচনা জনপরিসরে নেই। সারাক্ষণ যদি পুরুষ মানুষ নারী হিজাব পরল কেন বা স্কার্ট পরল কেন আলাপে ব্যস্ত থাকে; তাহলে সে পুরুষের মস্তিষ্ক জৈবিক বিকৃতিতে ঠাসা এটা খুব স্পষ্ট। আর কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভূতিতে আঘাত করল আর কে ইসলামি চেতনাতে আঘাত করল আলোচনা যারা করে; এরা নও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোক ও নও মুসলিম। পরিবারে যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থাকে; তাহলে তা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয় না। পরিবারে যদি দীর্ঘদিনের ইসলাম ধর্মের চর্চা থাকে তাহলে ধর্ম প্রদর্শনের এত প্রয়োজন হয় না।
পৃথিবীর কোনো দেশে মানবতা বিরোধী অপরাধের সমর্থক প্রগতিশীল আপনি পাবেন না। বাংলাদেশেই রবীন্দ্র সংগীত গাইতে গাইতে গুলি করে দেওয়া খুনি আপনি পাবেন। এরা চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের মতো উচ্চাংগ সংগীত শুনতে শুনতে কৃষকের বুকে পা তুলে দিতে সক্ষম।
বাংলাদেশ কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে না ওঠায়, এখানে অধিকাংশ শিশুর জীবনে মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড পূরণ হয় না। ফলে আই কিউ কম হয়, সেটাকে ওপর চালাকি দিয়ে পূর্ণ করতে চায় অনেকে। আর ইকিউ বা সমানুভূতি অজ্ঞাত এদের অভিধানে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যে কোনো ভাবে প্রতিটি শিশুর জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে হবে। এই দেশেই বৃটিশেরা আসার আগে সচ্ছল মায়াময় সমাজ ছিল। ধর্ম কবিতা গান শিল্পকর্ম পাশাপাশি বিকশিত হতো জনপদগুলোতে। বৃটিশ সৃষ্ট ১৭৭০-এর মন্বন্তর সমৃদ্ধ জনপদে ভিক্ষুক ও চোরের খনি তৈরি করে। কোলাবরেটর চাটার দলকে জমিদারি দিয়ে স্যুডো এলিটিজমের ভুত প্রবেশ করানো হয় সমাজ মননে। পরিকল্পিতভাবে হিন্দু মুসলমান বিভাজন তৈরি করা হয়। সেই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাটিই রাক্ষসের মতো চেপে বসে আছে আমাদের জীবনে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ছিল ভালোবাসার কারেন্সিতে ধনী দরিদ্র মাপার। যে দিন থেকে অর্থবিত্ত দিয়ে ধনী দরিদ্র মাপার সূচক চালু হয়েছে; সেদিন থেকেই আমাদের নরকযাত্রা শুরু হয়েছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন