নারীর লোহার খাঁচা যেভাবে পুরুষের পার্ভার্সনের মুখোশ খুলে দেয়

২৮৬ পঠিত ... ১৮:০২, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪

34 (12)

লেখা: হাসনা হেনা বৃষ্টি 

ইদানীং একটা ব্যাপার দেখি ফেসবুকে, খোমেইনীর একটা বক্তব্যের অংশ, হযরত আলী (রাঃ) এর নামে চালিয়ে নানান পেইজে শেয়ার দিচ্ছে। খোমেইনীর মূল কথাটা ছিলো এরকম, 'If women knew how men perceive them when they look at them, they would have covered themselves in iron armor.' এই কথাটা পুরুষমানুষ কেন গর্বের সাথে শেয়ার করে আমার জানা নাই। আপনার পুরো জাতিকে পয়েন্ট আউট করে বলা হল আপনারা পা*র্ভার্ট। আপনি একজন পু*রুষ হিসেবে এতই প*শু যে নারীর নিজেকে লোহার কবচ দিয়ে আবৃত করে রাখতে হবে। নারী জাতিকে নিয়ে এরকম কোনো সংশয় থাকলে আমি নারী হবার লজ্জার প্রায়শ্চিত্ত করে যেতাম সারাজীবন।

আর এইসব উদ্ধৃতি দিয়ে, ধর্মকে ব্যবহার করে, এক ধরনের মেসেজ দেওয়া সমাজে, যেন নারী লোহার বর্মের ভেতরে থাকলেই নিরাপদ, এর বাইরে গেলে আর নিরাপত্তা নেই। এইসব হুমকিগুলোকে আপনারা আবার ই*সলামের নামে চালান। খোমেইনী কে ছিলো জানেন? একজন ইসলামী রাজনীতিবিদের কথা 'ইসলাম' হয় কীভাবে? Learn Islam from where it is supposed to be learnt.

ফেসবুকে কিছুদিন থাকলে আমার মস্তিষ্ক বিষাক্ত হয়ে যায়। একটা জাতি এত জঘন্যরকম পা*র্ভার্ট হতে পারে কীভাবে আমার জানা নেই। এদের জন্মের ইতিহাস এরা সম্ভবত মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই ভুলে যায়। একটা পুরো জাতির পু*রুষমানুষ আগাগোড়া সে*ক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড। অন্যের বউ, প্রেমিকা, বোন, মা, আর্টিস্ট থেকে শুরু করে ডাক্তার, অফিসের বস কিংবা কর্মচারী, বে*শ্যা থেকে শুরু করে রাস্তার পাগল, এমনকি মাটি দিয়ে বানানো মূর্তি, কোনোকিছুতেই এদের বাছবিচার নেই। এরা সবাইকে যৌন হয়রানি করতে পারে, হয় কথা দিয়ে, ফেসবুকে কমেন্ট বা পোস্ট দিয়ে, নয়ত শারীরিক আঘাত করেই। আপনাদের ব্যাপারটা কনসার্নিং লাগেনা? আপনাদের পুরুষদেরই ব্যাপারটা কনসার্নিং লাগে না নিজের স্ত্রী, বাচ্চা, পরিবার এর কথা চিন্তা করে?

কয়েকটা পাবলিক পোস্ট দেখলাম, আমার অসুস্থ লাগছে। দুটো উল্লেখ করি, একজন অভিনেত্রীর নাভী দেখা যাচ্ছে একটা ভিডিওতে কাপড় ঠিক করতে গিয়ে, সেই ভিডিও দেখে বোঝা যাচ্ছে কোনো টক শো তে শ্যুটিং সেটের কারওই করা ভিডিও। চাইলে এই ভিডিও কেটে দেওয়া যেতো, কিংবা কেউ হয়ত ইচ্ছে করেই এই জঘন্য কাজটা করেছে। সেখানে কমেন্ট সেকশন দেখে আমার গা গোলানো শুরু করলো। 'মিডিয়ার মেয়েরা এরকম, এরা এসব করেই পয়সা কামায়' ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মনে হয় বাংলাদেশে যারা নারী ভিজুয়াল আর্টিস্ট, পারফর্মিং আর্টিস্ট, এদের মন অনেক শক্ত। আমি এদের জায়গায় থাকলে এতদিন টিকে থাকতে পারতাম না। কমেন্ট সেকশন দেখে মনে হল, বাংলাদেশের অর্ধেক পুরুষমানুষ ওই ভিডিওর নিচে বসে সম্ভবত মা*স্টারবেট করে ফেলেছে। একদল মেয়ে দেখলাম কমেন্ট করেছে, 'এত লাফালাফির কী আছে, এরা তো এমনিতেই দেখায়।' একজন মেয়ে হয়ে এই যদি হয় এদের প্রতিক্রিয়া, শুধুমাত্র নিজের সম্ভ্রম না গেলে এদের কাছে অন্য কারও সমস্যাকে সমস্যা মনে হয়না। একজন আর্টিস্ট বা অভিনেত্রী তার পারফরম্যান্স এর প্রয়োজনে নিজের শরীরের কতখানি ক্যামেরার সামনে আনবেন সেটা তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, 'এমনিতেই দেখায়' এর মানে কী, এখন এজন্য সবসময় আপনাদের চাহিবামাত্র সকলকিছু দেখাতে বাধ্য থাকবে, এই তো?

আরেকটা ভিডিওতে দেখলাম দুজন ছেলে-মেয়ে, কলেজপড়ুয়া, একটা কোনো পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তারা প্রেমিক প্রেমিকা বা বন্ধু। যাই হোক, সেখানে হাজার হাজার কমেন্ট, এরা সবাই মেয়েটাকে 'লাগাতে' চায়। মেয়েটার দোষ সে পার্কে গেছে। পার্কে গেছে ওর প্রেমিকের সাথে, তোর বাপের সাথে তো যায়নি। প্রেমিকের সাথে পার্কে গেলো কেন কাজেই ওদের সাথেও নাকি যেতে হবে।

 

একবার পহেলা বৈশাখে টিএসসির মোড়ে কিছু নারীর কাপড় টেনে খুলে ফেলা হল, তাদের অপরাধ তারা কেন শাড়ি পরে ঘুরতে গেছে। এই ঘটনার পর আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। আমার মনে আছে তখন, এই এতকিছুর পরেও ফেসবুকে তাদেরকে নিয়ে মব ট্রায়াল চলছিলো। সেখানে বেশিরভাগ মানুষের কমেন্ট, 'প্রেমিকের সাথে রাস্তাঘাটে লা*গাতে পারো, আমাদের লা*গাতে দিবানা?' চিন্তা করেন, কোন ধরনের মানসিকতা থেকে এই আলাপ আসতে পারে কারও মাথায়। এবং এটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এই ধরনের সমস্যা সমাধান করার জন্যে কিছু করা হচ্ছে না, কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। আমি অনেক চিন্তা করি, কী করলে এরা ভালো হবে, কী করা যায় আসলে এদেরকে ঠিক করতে, একের পর এক আর্টিকেল পড়ি, ভিডিও দেখি, বই পড়ি, মানুষের এই ধরনের বিহ্যাভিয়র কোত্থেকে আসে বোঝার চেষ্টা করি। একেকদিন বোধ হয় যে আমি এগুলো দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।

আগামীকাল একদল লোক এসে আপনার স্ত্রীকে রে*ইপ করার আবদার করবে, কেননা আপনার স্ত্রী আপনার সাথে শুয়ে থাকে, কাজেই ওদের সাথে শুয়ে থাকতে অসুবিধা নেই বলে তারা বিশ্বাস করে। ব্যাপারটা কেমন হবে চিন্তা করে দেখেছেন? এর উপরে এসব নিয়ে কিছু লিখলেই একদল লোক এসে বলবে, 'আমাদের জেনারেশন এরকম না, শিক্ষিত ছেলেরা এরকম না, শহরের ছেলেরা এরকম না', ইত্যাদি আরও নানান কোটা। ভায়েরা, থামেন, আমার পুরো নারীজাতির তিনভাগের দুইভাগ এরকম পা*র্ভার্সন দেখালে আমি সেই জাতির অংশ হিসেবে মাথানিচু করে ক্ষমা চাইতাম, আমাদের মধ্যে কতজন রে*ইপ করেনাই সেই হিসাব খুলে বসতাম না।

একটা ঘটনা মনে পড়লো, তখন আমি কলেজে পড়ি, আমি আর আমার এক বন্ধু রিকশায় করে বাসায় ফিরছি, পথে পুলিশ ধরলো। তাদের বক্তব্য ছেলেমেয়ে কেন একসাথে রিকশায় চড়ে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা আমাদের বাসায় ফোন দিতে চাইলো, আমরা তাতে রাজি হলাম। এটা ওনাদের পছন্দ হল না। ওনারা তখন আমাদের ফোন কেড়ে নিলেন, আমার ছেলে বন্ধুকে রিকশা থেকে নামিয়ে মারলেন, আমার ব্যাগে ১০০০ টাকা ছিলো সেটা নিয়ে নিলেন। এবং আমাকে 'বে*শ্যা খা*নকি' জাতীয় নানান গালিগালাজ করলেন, আরও যা বললেন সেগুলো শুনলে বমি পায়, বলবার মতন না। তাদের মধ্যে একজন বললেন, আমাকে সাইডে বাগানে নিয়ে যদি তারা এখন 'লাগায়ে দেয়' আমার কিছু করার আছে কিনা, আমি কোন সাহসে এই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রিকশায় গেলাম একটা ছেলেবন্ধুর সাথে। কি অদ্ভুত কথা না? একটা দেশের পুলিশ, একজন কিশোরীকে হুমকি দিচ্ছে 'সাইডে নিয়ে লাগায়ে দেওয়ার'। পরবর্তীতে ওই পুলিশকে আমি শায়েস্তা করেছিলাম, সেটাও পেরেছিলাম কেবলমাত্র আমার পরিবার আমার সাথে ছিলো, পুলিশের তখনকার দায়িত্বরত কর্মকর্তার সাথে আমাদের পরিচয় ছিলো এইজন্য। অন্য যে কেউ হলে অবশ্যই কিছুই করতে পারতোনা। তো, এইতো নিরাপত্তা?

আরেকটা ঘটনা মনে পড়লো, একবার মোংলা থেকে আমি আর আমার ভাই খুলনা আসছি। বাসে এক লোক, আমার পেছনে বসে বাসের ফাঁকা দিয়ে বারবার আমাকে পা দিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন। এটা নিয়ে আমি কয়েকবার মানা করলাম, উনি শুনলেন না। পাশে ওনার স্ত্রী চুপচাপ বসে রইলেন। এক পর্যায়ে আমি ওনার স্ত্রীকে অনুরোধ করলাম ওনার স্বামীকে থামাতে, ওনার স্ত্রী বললেন, 'উনার পায়ে ব্যথা, আপনি একটু সামনে সরে বসেন।' লোকটা এরপর উত্যক্ত করতে থাকলো আরও দ্বিগুণ উৎসাহে। আমি কনডাক্টরকে বললে, সে উত্তর দিলো, 'আপনে জানালার পাশে গিয়া বসেন, উনার সামনে খোঁচা খাইতে বইসা আছেন ক্যান?' জানালার পাশে আমার ভাই বসা, ওর বাসে উঠলে মোশন সিকনেস হয়। আমি চুপ করে বসে রইলাম। এরপর লোকটা ইচ্ছে করে বারবার একই কাজ করতে থাকলো। মেয়ে হয়ে জন্মানোর সৌভাগ্যে কোনটা কেমন স্পর্শ এগুলো আমরা বেশ ভালোভাবে চিনি। আমি এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে যখন চিৎকার শুরু করলাম, উনি হুমকি দিলেন যে আমাকে বাস থেকে নেমে কিছু একটা করে দেখাবেন। এই পুরো সময়ে লোকের পাশে ওনার স্ত্রী বসে। লোকটা দাঁড়িওয়ালা, পাঞ্জাবী এবং টুপি পরা। বাসের লোকজন আমাকে বললেন, 'এখনকার মেয়েমানুষ, না বুঝেই সবকিছু গায়ে টাইনা নেয়, হুজুর বলতেছে তার পায়ে ব্যথা।' আমি এসব ব্যাপারে ছাড় দেইনা। আমি আমার মামাদের কল দিলাম। বাস থেকে নামার সাথে সাথে আমার দুই মামা লোকটাকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে যখন প্রশ্ন করতে শুরু করলো, এবং বললো যে থানায় চলো, সে পায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে বললো 'জীবনে আর এইরম কিছু করুম না ও ভাই, আমনের মাইয়া মোর বইনে অয়, বইন বোলাইছি।'

ধর্ম, সমাজ, শালীনতার নাম বিক্রি করে করে এসব ফাতরামি নোংরামি আর কতদিন চলতে থাকবে জানেন? আপনার কাছে উত্তর নেই, আমাদের কারও কাছে উত্তর নেই। অনেক হইলো, নিজেরাই নিজেদের ধর্মটাকে নষ্ট করলেন, পু*রুষ জাতটার বদনামও করলেন, তবুও আপনারা থামবেন না। কিছু একটা হলেই সবাইকে ধর্ম, সমাজ, শালীনতা ইত্যাদি শিখাইতে যান। আমার ইদানীং রাজনীতি নিয়ে আর কিছু শুনতে, বলতে, জানতে ইচ্ছা করে না। এই সরকার থাকুক, আগের সরকার আসুক, নতুন সরকার আসুক, রাস্তায় রাস্তায় নারী পাবলিক বাসে হ্যারাজড হবে, মব লিঞ্চিং এর স্বীকার হবে, আমাদের কাপড় টেনে খুলে নেওয়া হবে রাস্তায়, পার্কে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, মিডিয়ায় হিউমিলিয়েটেড হতে হবে, এর চাইতে ভালো কিছু তো আমাদের সাথে হবে না।

এই পোস্ট লিখতে লিখতে আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি, ভাষার সভ্যতাও রক্ষা করতে পারিনি। আসলে পারা যায়না, অসুস্থ লাগে। সবচাইতে আয়রনিটা কী বলি, অস্ট্রেলিয়াতে আসার পরে আমি একমাত্র একবারই বাজে রকম ইভ টিজিং এর খপ্পরে পড়েছি, সেটাও দুটো বাঙ্গালী ছেলেই করেছে এক বাঙ্গালী অনুষ্ঠানে। এরা কিন্তু সমাজের একটা মোটামুটি শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসা, যেহেতু চাইলেই এখানে অশিক্ষিত যাদেরকে আমরা বলে থাকি তারা আসতে পারে না। আমি চাইলে পুলিশে যেতে পারতাম, যদি যেতাম এই ছেলেদুটো ভয়ানক সমস্যায় পড়তো। আমার মায়া হল, মনে হল বাবা মা এত টাকাপয়সা খরচ করে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছে! হয়ত যাওয়া উচিৎই ছিলো, হয়ত এদের বাবা-মাও এদের মতই, কিংবা হয়ত না, কি জানি!

তো খোমেনীর যে কথাটা দিয়ে আলাপ শুরু করেছিলাম, এই বাক্যটাকে 'ইসলাম' বলে স্বীকার করে নিয়ে বাঙ্গালী মু*সলমান পু*রুষের যে একটা অডাসিটি দেখলাম, বেশ হাস্যকর। ধর্মকে যখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন যার যার সুবিধামত ধর্মের বাণীকে স্বার্থ হাসিলের জন্য ফেব্রিকেটেড করা হয়; আজকে সেটা আপনার পক্ষে যাচ্ছে বলে আপনি আনন্দিত, যেদিন আপনার বিপক্ষে যাবে সেদিন আপনি এই প্র‍্যাকটিসের ভয়াবহতা টের পাবেন।

Just mentioning this one only because I felt like. Ma`qil ibn Yassar narrated, the Messenger of Allah (peace and blessings of Allah be upon him) said: ‘For one of you to be stabbed in the head with an iron needle is better for him than that he should touch a woman who is not permissible for him.’  (At-Tabarani in Al-Kabir, 486. Shaykh Al-Albani classed it as authentic in Sahih Al-Jami`, 5045.) আপনারা শুধু আপনাদের পার্ভার্সন দেখানোর সুবিধা হয় অতটুকু ধর্মকে নিবেন, বাকিটুকু নিবেন না, এত স্বাধীনতা আপনার ধর্ম আপনাকে দেয়নাই। এত যে ইসলাম ইসলাম আর ইসলামী শাসন বলে বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেন, দেশে যদি সত্যিকারের ইসলামী শাসন আসলেই প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, যে এক পিণ্ড অতিরিক্ত মাংসের দলা শরীরে নিয়ে এত দেমাগ আপনাদের, তার আগা দিয়ে ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে করতে রুহু বের হয়ে যাইতো ভায়েরা আমার।

২৮৬ পঠিত ... ১৮:০২, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top