কক্সবাজারে কট্টর ইসলামপন্থীদের স্বঘোষিত শরিয়া আইনের প্রয়োগ দেখলাম নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের পতনের পর; সেনাপ্রধানের সঙ্গে সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের (পতিত আওয়ামী লীগ বাদে) বৈঠকে জামায়াত নেতা দাওয়াত পাওয়ার পর; কট্টর ইসলামপন্থীদের ধারণা হয়; ইসলামী বিপ্লবের সময় এসে গেছে। ইরানের শাহ বিরোধী অর্থনৈতিক বিপ্লবকে দখল করার ঐ একটি উদাহরণ মাথায় করে পড়ি মরি করে দৌড়াতে শুরু করে কট্টর ইসলামপন্থীরা। প্রথম সুযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করে। আওয়ামী লীগের হিন্দুরা আক্রান্ত হয়। এরপর এই হামলাটি সাধারণ হিন্দুদের ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়।
শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে খুনে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে ৫ আগস্টের পর একে আত্মবিশ্বাসহীন ভীতু বাহিনী করে রেখে যান। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এই শৈথিল্যের সুযোগে বিএনপির বুভুক্ষু কিছু কর্মী চাঁদাবাজি ও দখলে লেগে পড়ে। কিন্তু কট্টর ইসলামপন্থীর চোখে খেলাফতের নেশা লাগিলোরে; বাঁকা দুই নয়নে শরিয়া আইনের নেশা লাগিলোরে।
সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণির লোক এরা। পিতা-মাতার অবহেলার সন্তানেরা যেভাবে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে ঢুকে হাসিনা মা ও খালেদা মায়ের হুকুমের দাস হয়; একইভাবে তার চেয়ে অবহেলিত সন্তানেরা জামায়াত নেতার মাঝে বাবা খুঁজে পায়; যিনি দ্বিতীয় জন্ম দেন ইসলামি কট্টরপন্থার ইজমে।
গত পনেরো বছর ধরে ভারতের কট্টরপন্থী মোদি ভক্তরা আওয়ামী লীগের স্বামী হয়ে যেভাবে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়েছে; প্রগতিশীলতার উত্তরীয় পরা সংস্কৃতি মামারা যেভাবে দাড়ি-টুপি দেখলেই ছাগু বলেছে; এই যে হীন বংশগতির লোক ক্ষমতা পেয়ে জমিদার সেজে একে অন্যকে নিম্নবর্গের তকমা দেওয়া; এটা শুরু হয়েছিল বৃটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে। অথচ আপনি বিজেপি-আওয়ামী লীগ আর জামায়াত-বিএনপির লোকজনকে একটি কমন পোশাক পরিয়ে ছবি তুললে দেখবেন; এরা একই কাননের ফুল। কর্মহীন আলস্য বিনোদিত ভিক্ষুকের চেহারা যেমন হয়। বাংলাদেশ ছোটো আয়তনের দেশ; এখানে ক্লিক দূরত্বে হু ইজ হু; ডিএনএ-র এক্সরে রিপোর্ট।
ভারতের নাগরিক সমাজকে কেবল কট্টর হিন্দুত্ববাদ মোকাবিলা করতে হয়; পাকিস্তানের নাগরিক সমাজকে মোকাবিলা করতে হয় শুধু কট্টর ইসলামপন্থা। অথচ আমাদের কি দুর্ভাগ্য গত দেড় দশক কট্টর হিন্দুত্ববাদ মোকাবেলা করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর এখন কট্টর ইসলামপন্থা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কখনও কখনও দুটো কট্টরপন্থাকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়।
এই যে দুটি কট্টরপন্থা যারা বিপরীত অবস্থানে থেকে পরস্পরকে ক্ষমতায় ও আলোচনায় রাখতে সাহায্য করে; আমি জানি না সেই জটিলতার সমাধান কী করে হবে। তবে আইনের শাসনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এর সুরাহা অসম্ভব।
পাশতু নেতা গাফফার খান বলেছিলেন, একটি সমাজের পরিচয় নারীর সঙ্গে তার আচার আচরণের মাঝে। সুতরাং নারীর প্রতি সহিংসতা দেখলে আ্মরা রেড লাইন টেনে দেব। কট্টর ইসলামপন্থীদের মনে করিয়ে দেই বিএনপি-জামায়াত আমলে গজিয়ে ওঠা ইসলামি কট্টরপন্থী বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের ফাঁসি ঐ আমলের শেষ দিকেই হয়েছে। আর সেই সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান সফল করেছিলেন সেনাবাহিনীর চৌকষ অফিসারেরা।
আপনি নেহাত জোসেফের ভাইকে সেনাবাহিনী প্রধান না করলে; বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্মার্ট ও মানসিক আভিজাত্যের গোষ্ঠী। পাকিস্তানের জেনারেল জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জেনারেল জিয়ার যে সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের পার্থক্য; সেটা বাংলাদেশ সংস্কৃতির স্পষ্ট ঔজ্জ্বল্যের জায়গা। এরশাদ, মইন ইউ পাকিস্তানের ঐ সময়ের সেনাপ্রধানদের চেয়ে অনেক কালচার্ড। বর্তমান সেনা প্রধানের অভিজাত আচরণ সেই ধারাবাহিকতার প্রতীক। যারা চার-পাঁচ প্রজন্মের উদারপন্থী পরিবারের ছেলে তারা আপনার কোনো কট্টরপন্থী ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদের অ্যাডভেঞ্চার সফল হতে দেবে না।
১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে যেভাবে হিজাব পরা মেয়ে পশ্চিমা পোশাক পরা মেয়ে একসঙ্গে জীবন-মৃত্যুর বাজি রেখেছে; ভীড়ের মিছিলে বাংলাদেশের পুরুষ সমাজ যেভাবে সমান্তরালে হেঁটে যাওয়া নারীকে পারিবারিক পরিবেশ দিয়েছে; সেটাই বাংলাদেশ পরিবার।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অর্থনীতির যে ম্যাজিক; অন্যান্য দেশের সঙ্গে এই পার্থক্য গড়েছে বাংলাদেশের নারী শ্রমিক। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ভালো ফলাফল মেয়েদের। কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে আন্তরিক কর্মী নারী।
পড়ালেখার জগত বা কর্মজগতের অভিজ্ঞতা না থাকায় পার্টির পয়সায় বাঁচা কট্টর ইসলামপন্থীদের কোনো ধারণাই নেই বাংলাদেশের নারীর মেধা ও যোগ্যতা সম্পর্কে।
জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার হচ্ছে সমাজে প্রতিটি নারীর নিরাপত্তা। এইখানে দলীয় মাস্তান শরিয়ত ভাই এসে তরুণীকে কান ধরে উঠবস করানো; ফুরিয়ে যাওয়া রাবেয়া আপা ঈর্ষান্বিত হয়ে তরুণীর সঙ্গে বিকৃত পোশাক পুলিশী; পুলিশের উপস্থিতিতে হোটেল রুমে নেয়ামত ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শরিয়ত ভাই নারীকে অকথ্য অপমানে জর্জরিত করা; ভিডিওতে অপরাধীদের চেহারা দেখা যাওয়ার পরেও; ফারুকুল বাদে অন্যান্য অপরাধী কেন এখনও কারাগারে নয়; এই প্রশ্ন রাখছি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও নারী বিষয়ক উপদেষ্টার কাছে।
এরকম আদিম ও বিকৃত প্রবণতাগুলোকে অংকুরে বিনষ্ট করতে হবে। নারী ও শিশু আমাদের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর মানুষ। তাদের ওপরে কেউ আঘাত করলে তাদের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী।
নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে দলীয় ক্ষমতা বা কতৃত্ব ব্যবহার করে এসেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডারেরা। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের লিঙ্গগর্বী পুলিশেরা; যে কোনো কারণে নারীকে তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে লালসার লালামাখা চোখে তাকিয়েছে। ৫ আগস্টের পর তারা কোথায়! কেন এই জলজ্যান্ত উদাহরণ জামায়াতের লোকেরা দেখতে পারছে না।
আর কোনো অপরাধী ধরা পড়লেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত বলে দেয়, সে আমাদের কর্মী নয়; অথবা তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহু ব্যবহারে এই জীর্ণ পদ্ধতি বাদ দিয়ে জবাবদিহি করতে শিখতে হবে এই তিনটি দলকে।
বাদরি কি দুলহানিয়া চলচ্চিত্রে বাদরি নামের একটি ছেলে তার প্রেমিকার সঙ্গে বসে বিয়ের স্বপ্ন দেখলে; প্রেমিকা তাকে বলে, ইতনা উমিদ মাত রাখনা বাদরি। ‘এত আশা রেখ না বাদরি।‘ কট্টর ইসলামপন্থীরা যখন শরিয়ার স্বপ্নে উন্মত্ত হয়ে হিন্দুদের ওপর হামলা, মাজারে হামলা করে চলেছে; নারীর প্রতি সহিংসতা করে চলেছে; তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, ইতনা উমিদ মাত রাখনা বাদরি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন