ডাক্তার কি প্রতিপক্ষ?

১৯৪ পঠিত ... ১৩:৪৬, সেপ্টেম্বর ০২, ২০২৪

4

বেশিরভাগ মানুষ, মানে যারা ডাক্তার নন, তারা ডাক্তারদের প্রতিপক্ষ ভাবেন।

খেয়াল করলে দেখবেন, প্রতিপক্ষ যারা ভাবেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্ত— যারা সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও দ্বারস্থ হওয়ার সামর্থ্য রাখেন না কিংবা, রাখলেও সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

দরিদ্র মানুষ এই তালিকা থেকে বাদ যাবে। কেন বাদ যাবে এই কারণটি একটু বিশদ। প্রথমত, জীবন থেকেই তাদের চাওয়া পাওয়া কম। দ্বিতীয়ত, দরিদ্র এবং অবুঝ ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় পরীক্ষাগুলো ফ্রি করে দিতে, স্টোরে যেসব ওষুধের সাপ্লাই থাকে সেগুলো তারা ফ্রি পান (ভর্তি থাকা সবাই পান), কোথায়, কোনদিকে যাবে, কী করবে একই বাক্য বারবার বলে বুঝিয়ে দিতে আমরা কার্পন্য করি না।

উদাহরণ দিলে হয়ত ভালো বুঝবেন।

কয়দিন আগে ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা একাই এলেন অর্থোপেডিক্স ডক্টরস রুমে। তিনি পরীক্ষাগুলো ফ্রি করাতে চান। তাকে বলা হলো, এই কাগজগুলো নিয়ে দোতলায় যেয়ে বলবেন এডি স্যারের সিল লাগবে।

মহিলাটি তখন ভ্যাকেন্ট লুক দিচ্ছেন। অর্থাৎ, সে কিছুই বুঝতে পারেনি। এসব ক্ষেত্রে আমরা পড়া ধরার মতো আবার জিজ্ঞেস করি, ইনফরমেশন ঠিকঠাক বুঝলো কিনা তা চেক করতে।

জিজ্ঞেস করলাম, বলেন, কয় তলায় যাবেন?

বৃদ্ধা নির্বাক।

কোন স্যারের সাইন নেবেন বলেন তো?

মহিলাটি তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো, ইউনূছ ছার।

আমরা হেসে আবার পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝালাম।

এসব কারণেই খুব সম্ভবত গ্রামের এই অশিক্ষিত বুড়ো বুড়িরা ছুটির সময় কিংবা রাস্তায় দেখা হলে

কৃতজ্ঞতার চোখে তাকান।

 

গাইনীতে প্রতিদিনে সকালে এক মেয়ের ড্রেসিং করতাম। রোগা পাতলা, অপুষ্টিতে ভোগা নিম্নবিত্তের ঘরের মেয়ে। বয়স ২০ এর আশেপাশে। বাচ্চা হয়েছে কিছুদিন আগে। সেলাইয়ের জায়গায় এখন ইনফেকশন নিয়ে এসেছে। প্রতিদিন ড্রেসিং করতে করতে তার গল্প শুনি। বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেও এখন সবাই মেনে নিয়েছে। স্বামীও খুব ভালোবাসে।

একদিন ড্রেসিং করতে দেরি হলেই মেয়ের মা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তার মেয়ের উপস্থিতির জানান দেয়। আমিও হাত নেড়ে বলি, যান, মনে আছে। যচ্ছি একটু পরে।

ছুটির আগেরদিন ড্রেসিং শেষ করে ফেরার সময় ওয়ার্ডে মেয়ের মা জড়িয়ে ধরে এক নাটকীয় পরিবেশের অবতারণা করে। জাপটে ধরে অ্যাপ্রোনের পকেটে ৩০০ টাকা ঢুকিয়ে দেয়। হাসতে হাসতে বলে, মিষ্টি খাইয়ো বাবা... তার চোখের কোণায় চিকচিক করে পানি।

না, মিষ্টি খাবার জন্য ৩০০ টাকা সেদিন রাখা হয়নি। কিন্তু যে অনুভূতির সেদিন জন্ম হয়, তার মূল্য ৩০০ কোটি টাকার চেয়েও বেশি।

 

 

এর বিপরীত ঘটনাগুলোই বেশি ঘটে।

এক সপ্তাহ আগেই মেডিসিন অ্যাডমিশন নাইট ছিল। একসাথে চার-পাঁচটা করে রোগী আসে।

রাত একটার দিকে ওয়াশরুমে গেলাম। তখন রোগীর চাপ কিছুটা কম। এরমধ্যে ওয়ার্ড বয় ফোন দিল চারবার। এগারো মিনিট পর এসে দেখি ডক্টরস বেডের উপর রোগীকে শুইয়ে তাকে বাতাস করছে দুইজন। বাকি পাঁচজন রুমের মধ্যে পায়চারি করছে। আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল, কোথায় থাকেন আপনি, এতক্ষণ ধরে আসছি, এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমাদের এত সিরিয়াস রোগী...  

জানা গেল, তারা কোনো গ্রামের চেয়ারম্যানের লোক। সিরিয়াস রোগীর সমস্যা তার হাত পা চাবায়। এবং ওই রাতে রোগীর বাবা আরও চারবার এল। একবার ওষুধ বুঝতে, বাকি দুইবার পানি এবং টিস্যু আছে কি না জানতে।

 

একই রাতে এক রোগীর খুব পেট ব্যথা কমপ্লেইন নিয়ে বারবার এলেন তার বাবা। ইনজেকশন দেওয়ার পরও ব্যথা কমেনি। স্লিপ প্যাডে একটা সাপোজিটরি লিখে বললাম বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে। আচ্ছা বলে চলে গেলেন। একটু পর আবার আসলেন অগ্নিমূর্তি হয়ে। কেন এই সাপোজিটরি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হবে না, এই সরকারের পতন এসব কারণেই হয়েছে এবং তিনি ২৮ বছর যাবৎ রাজনীতি করেন ইত্যাদি তথ্য জানিয়ে গেলেন।

রাত চারটার দিকে আসলেন ওই রোগীর মা। মেয়েটির পেটে ব্যথা এখনও কমেনি। তার সচেতন রাজনীতিবিদ বাবা সাপোজিটরি কিনে না দিয়েই বাসায় চলে গেছেন।

উল্লেখ্য, সাপোজিটরির মূল্য ছিল ৬০ টাকা। 

 

অনেকেই বলেন ডাক্তারদের দায়িত্বে অবহেলার কথা। এই অবহেলা না নেগলিজেন্সের অভিযোগ অমূলক নয়। তবে আগে বুঝতে হবে গাফিলতি কোনটা।

একজন বিষ খাওয়া এবং পেট ব্যথা রোগীর ভেতর দুজন যদি একই সাথে আসে, কিংবা বিষ খাওয়া রোগী পেট ব্যথা রোগীর পরেও আসে— এবং ডাক্তার যদি একজন থাকে, তিনি বিষ খাওয়া রোগীকেই আগে দেখবেন। এটা আপনার চোখে গাফিলতি হলেও, মেডিকেলের ভাষায় আর্জেন্সির উপর ভিত্তি করে একে বলে ট্রায়াজ।

ডাক্তার যখন বলেন, ওষুধ দেবার ব্যাপারে নার্সের সাথে কথা বলেন— এই মধ্যবিত্তরা তাকান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে। তারা ভাবেন ওষুধ ডাক্তারের পকেটেই আছে। কিন্তু তিনি তা বিক্রি করে টাকা পকেটে পুরে সোনার গাছ লাগাবেন। তারা চান, প্রতি রোগীর বিছানার পাশে একজন ডাক্তার চেয়ার পেতে বসে থাকুক। রোগী কখন হেঁচকি দিচ্ছে, কখন কাশি দিচ্ছে, কখন উঁহ বলে পাশ ফিরছে, ডাক্তার চোখ বড় বড় করে দেখুক।

মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষের সমস্যা এই যে, তারা বিশ্বাস করেন হাসপাতালের চেয়ারে যেহেতু ডাক্তার বসে থাকে— এটি মূলত তাদের হাতেরই খেলনা। হাসপাতালের ওষুধ থেকে শুরু করে বিছানা দেওয়া, টিস্যু, পানি দেওয়া, বাথরুম কোনদিকে দেখিয়ে দেওয়া, স্যালাইন লাগিয়ে দেওয়া— এর সবই ডাক্তারের দায়িত্ব। এসব মামার বাড়ির আবদার যখন ডাক্তার শুনতে চান না, কিংবা শুনতে শুনতে বিরক্ত হন, তখন তিনি হয়ে যান প্রতিপক্ষ।  

১৯৪ পঠিত ... ১৩:৪৬, সেপ্টেম্বর ০২, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top