লেখা: নীরব হাসান
গতকাল আসিফ মাহতাব উৎস একটি সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছেন—২০২৫ সালের নতুন শিক্ষাবর্ষের নবম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইতে একটা গল্প দেওয়া হয়েছে, যেখানে মা তার মেয়েকে বারবার খাঙ্কি বলে ডাকতেছে, পেটের বাচ্চা ফেলে দেওয়ার জন্য কীভাবে ঔষধ বানাতে হবে, তা শেখাচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনটি বেশ সাড়া ফেলেছে। সচেতন আলেম ও অভিভাবক মহল বেশ উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত বিষয়টি নিয়ে। জনাব আসিফ দাবি করেছেন, লেখিকা নারীবাদী বলেই এমন লেখা লিখেছেন।
আসলে ‘গার্ল’ শিরোনামে এটি কোনো গল্প নয়, এটি একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধে একজন সচেতন মা, তার স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক করার পাশাপাশি উপদেশ দিচ্ছিলেন।
প্রবন্ধটি লিখেছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফুল প্রফেসর ‘জ্যামাইকা কিনকেইড’, যা প্রকাশ হয় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে। কিনকেইড নারী-মা সম্পর্কিত প্রবন্ধ লেখার জন্য সারাবিশ্বে সমাদৃত।
আমি লেখাটি বড় করব না। শুধু এইটুক বলব, ইংরেজি প্রবন্ধ বা গল্প এমন না যে আপনি ওয়ার্ড ধরে-ধরে সেটার যাচ্ছেতাই মিনিং বের করবেন যেটি করেছেন আসিফ মাহতাব। উনি বলেছেন, ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছেন লেখিকা নারীবাদী অথচ লেখিকার নাম উনি উচ্চারণ করতে পারতেছেন না। ভিডিওর শুরুতেই উনি বলেছেন, মা বারবার তার মেয়েকে খাঙ্কি ডাকছেন—যেটা সম্পূর্ণ ভুল একটা কথা। পুরো প্রবন্ধে মা তার মেয়েকে এভাবে সম্বোধন করেন নাই। বরং মা মেয়েকে বলেছেন, হাঁটার সময় তুমি সতর্ক থাকবে যেন তোমার হাঁটা দেখে তোমাকে বখাটে বা খারাপ মনে না হয়। কাপড় পরিধানের সময় কাপড়ের ব্যাপারে, ঝুঁকার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে যেন স্পর্শকাতর কিছু দেখা না যায়।
উনি দাবি জানিয়েছেন, এমন একটা গল্প কেন রাখা হলো। উনার দাবি উড়ায় দিয়ে আমি বলতেছি, এই প্রবন্ধ একদম পারফেক্ট। নবম শ্রেণির একজন মেয়ের নিজ ও নিজের নিরাপত্তার জন্য সমাজ সম্পর্কে যা যা ধারণার প্রয়োজন, অনেকটাই এই প্রবন্ধে আছে। এমনকি এটা অষ্টম শ্রেণিতে দিলে আরও ভালো।
আসিফ আরও বলেছেন, এই গল্পে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেসব কোরআনে আছে কিনা? যেহেতু নাই তাহলে কেন এই গল্পে দিতে হবে? আমরা সাহিত্যে বা অন্যান্য বইতে যেসব শব্দ পড়ি, সেসব সরাসরি কোরআনে থাকতে হবে, এই দাবি কি উনি করতে পারেন? বা এই দাবির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?
ভিডিওর ২:২৫ – ২:৪৫ মিনিট সময়ে বলেছেন, মা তার মেয়েকে বলতেছেন, এই ঔষধ এমনভাবে বানাতে হবে যেন বাচ্চা সৃষ্টির আগেই বাচ্চা ফেলে দিতে পার। আসিফ ভিডিওর ক্যাপশন দিয়েছেন, গর্ভপাত ও অশ্লীল কথা বলা হয়েছে ২০২৫ সালের পাঠ্যবইতে। আসিফ সম্ভবত গর্ভপাত ও জন্মনিরোধক বিষয় দুইটা স্পষ্টভাবে বুঝেন না অথবা গুলিয়ে ফেলেছেন। বাচ্চা সৃষ্টির আগে, যা করা বা খাওয়া হয় সেটা কোনো বিবাহিত পরিবার করেন না? এমনকি যারা আসিফের এসব অভিযোগ শুনে পাশ থেকে সমস্বরে নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ্ বলতেছিলেন, তারাও জন্মনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করেন! সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, গর্ভপাতের ঔষধ পৃথিবীতে প্রথম আসে ২০০০ সালে ফ্রান্স ও চায়নাতে। এরপর ২০২৩ সালে ৯৬টি দেশে এটার ব্যবহার শুরু করা হয়। গল্পটির প্রকাশ ১৯৭৮ সালে যা এই ঔষধ আবিষ্কারের ২২ বছর আগের।
এতটা স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে আসিফের উচিত ছিল, পর্যাপ্ত স্টাডি করা বা বিশেষজ্ঞ কাউকে জিজ্ঞাসা করা যেটা উনি করেন নাই। দেশে নবম শ্রেণি পড়ুয়া অনেক মেয়ের বিয়ে হয়, হচ্ছে। এটা তো একেবারেই স্বাভাবিক। তাহলে নবম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর– বেবি চাইলে নাও নেওয়া যায়, এই বিষয়টি জানলে ক্ষতি কোথায়? বায়োলজি বইতে হিউমান রিপ্রোডাকশন সম্পর্কে সব পড়ানো হয়, তাহলে তো ফুল বায়োলজি বই ব্যান করে দেওয়া উচিত নাকি আসিফ বায়োলজি বই কোনোদিন খুলে দেখেন নাই!
যিনি ফিলোসফির মতো বিষয়ে ইংল্যান্ড থেকে মাস্টার্স করেছেন, তিনি যদি এমন একটা সিম্পল বিষয়ের থিম বা বাংলা করতে না পারেন তাহলে এটা খুব লজ্জার বিষয়। না পারা অবশ্য ক্ষতির কিছু না কিন্তু সেই না পারা, না জানা নিয়ে আপনি যখন মিডিয়ার সামনে পাণ্ডিত্য জাহির করতে আসতেছেন, এবং জনসাধারণ সেটা গ্রহণ করতেছেন— সেটা বোকামি প্লাস ক্রাইম। উনার পরিচিত কেউ থাকলে আমি অনুরোধ করব, উনি যেন শিক্ষাসম্পর্কিত বিষয় নিয়ে মিডিয়ার সামনে অভিযোগ করার আগে আরেকটু সচেতন হোন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন