তিনটে খরগোশ তুরতুর করে মাটি ভাঙে চিনাবাদামের খেতে। মাটি উলটে বের করে বাদাম। সামনের দুই থাবায় ধরে কুটকুট করে খায়। তাদের কান নড়ে আনন্দে।
ভুট্টা খেতের ভিতরে ঝুঁঝকো আঁধার। সেইখানে সরসর করে শব্দ হয়। দুটি শিশু কচি ভুট্টা ঘেঁড়ে, খোলস আর রোঁয়া সরিয়ে দাঁত বসায়। দানা ফেটে উছলে ওঠে ভুট্টার দুধ। স্বাদে তাদের মুখ ভরে যায়। তারা ভুট্টার দুধ শুষে নিতে থাকে। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ঝুঁঝকো আঁধারে বুঝদারের মতো হাসে। মেয়েটার চুল রুক্ষ লালচে, পরেছে এক বিবর্ণ ডুরে শাড়ি, পুরু দুটি ঠোঁটে একটু উঁচু দাঁত ঢাকা পড়ে না। ছেলেটার পরনে নোংরা লেংটি, গা উদোম, ন্যাড়া মাথায় লম্বা। টিকি!
বাবুদের বাগানের এককোণে মেয়েটির বাবা রাজ্যের বুনো ঘাস নিড়িয়ে নেড়া করেছে। সারাদিন ঝরে পড়ে শুকনো গাছের পাতা। সেইসব পাতা কুটো শিমুলের ডাল থেকে খসে পড়া একটা বাবুইয়ের বাসা–এইসব দিয়ে একটা স্কুপ তৈরি করেছে সে। তারপর সাবধানে দেশলাই জ্বেলে সে একটা বিড়ি ধরায়, তারপর জ্বলন্ত সেই কাঠিটা দিয়ে বাবুইয়ের বাসাটার আগুন দিয়ে শুকনো পাতার স্তূপটা ধরিয়ে দেয়। পাতা পোড়ার মিষ্টি ঝাঁঝালো ধোঁয়ার গন্ধ পায় সে। আগুন জ্বলে ওঠে। একটু দূরে ঘাসের ওপর উদাসী ভঙ্গিতে বসে সে বিড়ি খায়।
ভুট্টা খেতের মধ্যে মেয়েটি সেই গন্ধ পায়। পাতা পোড়ার মিষ্টি গন্ধ। তাহলে বাবা আগুন জ্বেলেছে। ঝলসে নিয়ে খাবে বলে সে দুটো ভুট্টা ছিঁড়ে কোঁচড়ে নিয়ে খেত থেকে বেরোয়। অমনি দেখতে পায়, খরগোশের কাণ্ড। চিনেবাদাম গাছের শিকড় খুঁড়ে বেগোছ করছে। মুখ ফিরিয়ে সে ছেলেটাকে ডাকে–এ গেনিয়া, মোমফালি খা লেল কৈ।
কৌন?
হৌ দেখ।
গেনিয়া ভিখমাঙা সুরদাসের ছেলে। তার হাতে সব সময়ে একটা খেটে লাঠি থাকে। ওই লাঠির এক প্রান্ত ধরে তার বাবা অন্যপ্রান্ত ধরে সে। ওই ভাবে লাঠি ধরে, সে বাবাকে ভিখ মাঙতে নিয়ে যায় রাস্তায়–রাস্তায়, বাড়িতে–বাড়িতে। চলে যায় যশিডির সাটল গাড়িতে উঠে মেল ট্রেনে ঝাঁকা কিংবা মধুপুর ঘুরে আসে। সেই লাঠি হাতে ছেলেটা লাফ দিয়ে বেরোল।
তিনটে খরগোশ ছুটে পালায়। তারা বেশি দূরে যায় না। এ বাগানের সীমা পেরিয়ে কাঁটা গাছের বেড়ার তলা দিয়ে উত্তরে আর একটা বাড়ির বাগানে ঢুকে যায়। গেনিয়া মেয়েটাকে বীরত্ব দেখাতে খেটে লাঠিটা হাতে নিয়ে দু-চারবার লাফ ঝাঁপ করে, চেঁচায়। তার লেংটির একটা প্রান্ত দু-পায়ের মাঝখান বরাবর ঝুলে থাকে, এখন লাফ ঝাঁপ দেওয়ার সময়ে সেই অংশটা লেজের মতোনড়ে। মেয়েটা তাই দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
চিনেবাদামের খেত পার হয়ে তারা প্রকাণ্ড নিস্তব্ধ বাড়িটা ঘুরে আগুনের কাছে চলে আসে। আগুনের আঁচ থেকে দূরে ঘাসে বসে উদাস ভঙ্গিতে মাটি–মাখা হাতে বিড়ি খায় ভূতনাথ। তার চোখ শূন্যে নিবদ্ধ। মেয়েটা বাবার ওই ভঙ্গি দেখে আসছে জন্মাবধি। সে জানে এ দেশের মাটি তার বাবার পছন্দ না। তার বাবা যে–মাটির দেশে ছিল সে-মাটির দেশে আরও নিবিড় গাছপালা জন্মাত। সেখানে ছিল অনেক জল। জলে–মাটিতে মাখামাখি হত খুব। এখানে তা হয় না। সেই ঢাকার দেশে বাবার ছিল বউ, একটা ছেলেও। তারা দুজনেই ঘরের আগুনে মারা যায় দাঙ্গার। সময়ে। তার বাবা একা পালিয়ে আসে কলকাতায়। সাহাবাবুরা দেশের লোক, তারা ভুতনাথকে দু-একটা কাজ দিয়েছিল। কিন্তু লোকটার মাটির নেশা দেখে বুড়ো কর্তা বললেন–বৈদ্যনাথ ধামে আমার বাড়িটা পড়ে আছে। মালিটা বুড়ো–হাবড়া, তা তুমি সেখানে গিয়ে বরং মাটি ছানো গিয়ে। তোমার হাতে গুণ আছে, গাছপালা করো গে সেখানে–
বুড়ো বিহারি মালির চাকরি গেল। বড় কষ্ট হয়েছিল ভূতনাথের। সেই কষ্ট থেকেই ভূতনাথ এক ঢিলে দুই পাখি মারল। বুড়োর এক মেয়ে ছিল, যদিও বাঙালি না, তবু তার মুখচোখে বিহারের সহজ লাবণ্য দেখা যায়। বুড়োকে কন্যাদায় থেকে উদ্ধার করতে গেল সে, তার নিজের তখনও বিয়ের বয়স যায়নি। বুকে খামচে থাকা স্ত্রী পুত্রের দুঃখটাতেও একটা প্রলেপ পড়া দরকার। বুড়ো বিড়বিড় করে বলল –মেয়ে আমাদের দুধেল গাইয়ের মতো। বিয়ে করতে চাও করো–নগদ দুশো টাকা ধরে দাও। ভূতনাথ থ। কোথায় সে বিনাপণে দায় উদ্ধার করতে এসেছিল, কোথায় আবার উলটে কন্যাপণ? তবু নিয়ম। রফা হল একশোয়। কিন্তু এক দফায় না, চার দফায়। ইনস্টলমেন্টে বিয়ে করে ঘর বাঁধল ভূতনাথ, সাহাবাবুদের বাড়ির আউট হাউসে। চারদিকে জমি মেলাই। মনের আনন্দে মাটিতে ডুব দিল সে। ফুল–ফলের বুদবুদে ভরে দিল। বাগান। এতোয়ারির কোলে এল কমলি।
সেই কমলি এখন ওই পাতার আগুনের দিকে সাবধানে হাত বাড়িয়ে কচি ভুট্টা সেঁকছে, সঙ্গে ভিখিরির ছেলে গেনিয়া। উদাস চোখে দৃশ্যটা দেখে ভূতনাথ। আমার বউ, আমার সন্তান, আবার সেই জমি নিয়ে মাখামাখি, তবু কোথা থেকে এক অন্যমনস্কতা এসে বাসা বেঁধেছে ভূতনাথের মাথায়। মাঝে-মাঝে তার বোধে আসে যে, সে যেন এই পৃথিবীর সঙ্গে ঠিকমতো আটকে নেই। কোথায় একটু ঢিলে বাঁধুনি রয়েছে, একটা আলগা ভাব। মাঝে-মাঝে তাই সে বসে গাছের ছায়ায় ঘাসগজারির মধ্যে চুবিয়ে–জলের কথা ভাবে, জমির রঙের কথা ভাবে, কখনও বা তার মনে পড়ে সেই বউ–ছেলের মুখ, কখনও মনে পড়ে দুঃসময়ের আগুনরঙা আকাশ। কিংবা কিছুই মনে পড়ে না, কেবল এক কাতরতা তাকে বকের মতো একা করে রাখে। এক ঠাঁই ঝিম মেরে থেকে থেকে মাঝে-মাঝে মাথার মধ্যে টের পায়, চিন্তার মাছ পলকে ঘাই মেরে ডুব দেয়। আর ধরা যায় না। খেলাটা বেলাভোর তাকে বসিয়ে রাখে, বিড়ি নিভে তেতো হয়ে যায়। তখন কখনও কমলি ‘বাবা’ বলে ডাক দিলে সে ভারী চমকে উঠে ভাবে–কে রে মেয়েটা?
ভুট্টার দানা দাঁতে নিতেই পোড়া ভুট্টার সুঘ্রাণে ভরে গেল শরীর। গেনিয়া কমলির দিকে চেয়ে হাসে, কমলি গেনিয়ার দিকে চেয়ে।
গেনিয়া আস্তে করে বলে–একটু নুন হলে–
কমলি তখন লক্ষ করে বাবার পিঠে একটা ডাঁশ বাইচে। তড়িতে উঠে গিয়ে আঁচল ঝাঁপটে ডাঁশ তাড়ায়….
বাবা মুখ তুলে বলে–কী রে?
ডাঁশ।
বাবা আবার চুপ করে বসে থাকে। বিড়ি খায়।
বাবা পাগলা ডাক্তারের খরগোশগুলো রোজ এসে বাদামের খেত ভেঙে যায়।
তাড়িয়ে দিস।
তাড়াই না বুঝি! এবার আমি একটা কুকুর পুষব। গেনিয়ার চমেলি কুকুরের বাচ্চা হোক–কেমন বাবা! হ্যাঁ?–আচ্ছা।
বাবা বড় ভালো। কুকুরের ওপর মায়ের বড় রাগ।
সুনসান বাগানখানা রোদ মাখছে, বাতাস মাখছে। ফুলের গর্ভকোষে পরাগ–সঞ্চার করে ফিরছে পোকারা। তাদের ওড়াওড়ি শব্দ। ফুলের বেড লাফিয়ে-লাফিয়ে পার হয় গেনিয়া, পিছনে কমলি। নিস্তব্ধ ভয়াল বাড়িটার দিকে তাকালেই তাদের বুকে নানা ইচ্ছের রং এসে পড়ে।
দুজনে এসে বারান্দার গ্রিলের ভেজানো দরজা খুলে ঢোকে। বারান্দায় ওপাশে সারিবদ্ধ ঘর। বড় তালা ঝুলছে। বহুবার দেখেছে তারা, তবু রোজ একবার করে দরজার পাখি তুলে অন্দর দেখে। ভিতরে গোধূলির মতো অন্ধকার। তবু বিচিত্র আসবাব দেখা যায়। ইংলিশ বেড, ড্রেসিং টেবিল, জাপানি ফুলদানি, দেওয়ালে প্রকাণ্ড সব ছবি, খেলনার আলমারি, বইয়ের শেলফ। তারা। ঘুরে এক-এক ঘরের দরজার পাখি তুলে এক-এক রকমের জিনিস দেখে। পনেরো দিন অন্তর ভূতনাথ দরজা খোলে, এতোয়ারি বালতি করে জল আনে, ঝাঁটা আনে। ঘর ভোলাই হয়। তখন ঘুরে ঢুকে এটা ওটা ছুঁয়েছে কমলি। গোনিয়াকে এতোয়ারি ঢুকতে দেয় না, বলে–ওটা চোট্টা। এক পলকে জিনিস তুলে উধাও হবে।
গেনিয়া তাই তৃষিত চোখে ভিতরটা দেখে। রোজ।
কিন্তু কমলি বেশিক্ষণ দেখতে দেয় না। গেনিয়ার চোখ বড্ড লোভী।
দরজার পাখি ফেলে দিয়ে কমলি বলে–আর না।
একগাল হাসে গেনিয়া, বলে–আলমারিতে একটা সোনার ঘোড়া আছে–না রে?
কমলি ঠোঁট ওলটায়, বলে–কী জানি! কত কিছু আছে!
উত্তরের ঘরটায় জানালায় একটা শিক নেই। গেনিয়া তা দেখে রেখেছে।
*
অন্ধ রামজি সারা সকাল বিছানায় শুয়ে। বুড়ো হলে শরীরের তাপ কমে যায় নাকি! বিছানার ওম বড় ভালো লাগে। বাঁশের ওপর খড় পাতা, তার ওপর চিটচিটে ন্যাকড়া আর ন্যাকড়া। এই বিছানা, তবু ওম দেয়! রাতে গেনিয়া শোয় পাশে, তার শরীরের ওমটিও ভালো লাগে। কোন ভোরবেলা উঠে গেছে গেনিয়া বুড়ো বাপকে একা ফেলে রেখে।
চোখ দুটো পাথর হয়ে গেছে বটে তবু আন্দাজে বেলা ঠাহর পায় রামজি। পেটে খিদে চাগাড় দিয়ে ওঠে। খিদের সঙ্গেই বসবাস, তাই অস্থির হয় না। ধীরেসুস্থে উঠে, মাচান থেকে নামতে নামতে চেঁচিয়ে গেনিয়াকে ডাকে। ডাকটা কর্কশ, তবু ডাকের মধ্যে আদর আছে।
গেনিয়ার সাড়া পাওয়া যায় না। রামজি উঠে ঘরের পিছনের জঙ্গলে পেচ্ছাপ করে আসে। মাটির খোরায় দু-মুঠো ভেজানো ভাত আছে। জল খায়। তারপর গেনিয়াকে সঙ্গে করে রামজি বেরোবে মাংতে।
গেনিয়াকে আরও কয়েকবার ডাকে রামজি। সাড়া নেই।
মাটির খোরায় হাত দিয়েই টের পায়, একটা অবধি ভাতও খুঁটে খেয়ে গেছে রেন্ডির ব্যাটা। বুড়ো বাপের জন্যে একদানাও রেখে যায়নি।
এ গেনি–ইই–রেন্ডির ব্যাটা–
রোদে বসে প্রাণপণ ডাক দিতে থাকে রামজি–ভিখমাঙ্গা সুরদাস।
.
এ বাড়ির কলে কেমন হিলহিল করে জল পড়ে। মিঠে জল। হাঁটু গেড়ে কলের তলায় বসে আঁজলা ভরে জল খায় গেনিয়া। অদূরে চৌবাচ্চার চাতালে বসে মাথার চুলে আঙুল ডুবিয়ে গম্ভীর মুখে উকুন খোঁজে কমলি।
জলে পেট ভরে ওঠে। তবু কল থেকে জল পড়া দেখতে ভালো লাগে বলে গেনিয়া আঁজলা পেতে মুখ ডুবিয়ে রাখে। জল পড়ে যায়।
কমলি উঠে এসে কল বন্ধ করে বলে–জল মাগনা না? এবার ভাগ।
আউট–হাউসের সামনে শাকের খেত। সেখান এতোয়ারি খুঁটে-।খুঁটে শাক তুলছে। সেইখান থেকেই দেখতে পায় ভিখমাঙ্গা সুরদাসের চোর ছেলে গেনিয়াটার সঙ্গে কমলি বাইরের কলের চাতালে বসে। মেয়েটার নজর নীচু হয়ে যাচ্ছে। সে ডাক দেয়–এ কমলি–
কমলি চলে যেতেই এক লাফে গেনিয়া ভুট্টার খেতে সেঁধোয়। মটমট করে ভুট্টা ভেঙে নেয় আট দশটা। বুকে জড়ো করে ধরে নিঃসাড়ে বাড়ির উত্তর দিকের ধার ঘেঁষে দ্রুত পায়ে এগোয়। কাঁটা বেড়ার ভিতরে একটা গোপন ফোকর আছে, তাই দিয়ে গলে রাস্তায় পড়ে।
গেনিয়ার পায়ের শব্দ পেতেই রামজি নিঃসাড়ে লাঠিটার দিকে হাত বাড়ায়।
আওল তু?
গেনিয়া উত্তর দেয় না। কিন্তু তবু তার শরীরের অবস্থিতি টের পায় রামজি। লাঠিটা আচমকা তুলে প্রাণপণে বসায়।
কিন্তু গেনিয়ার অভ্যাস আছে। খরগোশের মতো লাফ দিয়ে সরে যায় সে। বুক থেকে দুচারটে ভুট্টা খসে পড়ে। লাঠিটা মাটিতে পড়ে খট করে ওঠে।
রেন্ডির ব্যাটা, শরম নেই? বুড়ো আন্ধা বাপের জন্য একটা দানা রেখে যাসনি।
দূর থেকে বাপের দিকে একটা ভুট্টা ছুঁড়ে মারে গেনিয়া। সুরদাস রামজি প্রথমটায় চেঁচিয়ে ওঠে–আমাকে মারছিস শালা চুহা? অ্যাঁ! আমাকে বুড়ো আন্ধা বাপকে তোর–অ্যাঁ?
আবার লাঠিটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে ভুট্টাটা হাতে পায়ে। তুলে নেয়। খোসা ছাড়িয়ে হাত বোলায় দানাগুলের গায়ে। তারপর হাসে।
কোথায় পেলি? ভুতুয়ার বাগানে বুঝি! একটু সেঁকে দিবি গেনি? একটু আগুন কর না ব্যাটা।
গেনিয়া উত্তর দেয় না। চুপচাপ ঝোঁপড়ায় ঢোকে আর ক্যাম্বিসের ময়লা ছেঁড়া টুপিটা পরে বেরিয়ে আসে!
তার বাবা ভিখমাঙ্গা সুরদাস রামজি রোদে বসে ভুট্টার দানা ভাঙে দাঁতে। মুখে, শরীরে খড়ি উঠছে, চোখের কোল ফোলা–ফোলা, উড়ো চুল, ভাঙা গালে দাড়ি আর ন্যাকড়া পরা লোকটাকে অমানুষের মতো দেখায়। গেনিয়ার চোখে অবশ্য বাপের কোনওটাই অস্বাভাবিক ঠেকে না।
সে লাঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে–চলি চল।
সুরদাস রামজি বাতাস হাতড়ে লাঠিটা ধরে উঠে দাঁড়ায়।
ভিক্ষের বাজারে এখন আকাল। বাড়িগুলো খালি পড়ে আছে। বৈদ্যনাথধামে কোনও তীর্থযাত্রার সময়ও এটা নয়। শহর তাই ফাঁকা। নিরিবিলি রাস্তায় দুজন হাঁটে লাঠির দুই প্রান্তে দুজন। সঙ্গে গা–ঘেঁষে হাঁটে চমেলি কুকুর।
সেই রেন্ডিটার কাছে তুই যাস নাকি?
না তো?
না তো! অ্যাঁ? আমি টের পাই না ভেবেছিস? আন্ধা বলে টের পাই না? তুই যাস?
কখন গেছি?
রোজ যাস। মাঝে-মাঝে আমি তোকে ডেকে পাই না কেন? তুই গিয়ে ওইখানে ভালোমন্দ গিলে আসিস। ঘুমোলে আমি তোর পেট হাতিয়ে টের পাই তোর পেট ঢাক হয়ে আছে। কোথায় খেতে পাস তুই?
না। কির–
কীসের কির?
বৈদ্যনাথজির।
সুরদাস চুপ করে থাকে। রেন্ডিটা চার বছর তাকে ছেড়ে গিয়ে মহিন্দরের ঘর করছে লাইনের পারে। ছেলেটাকে ফেলে গেছে কিন্তু ছেলেটা মাঝে-মাঝে মা পানে ছুটতে চায়। অন্ধের নড়ি, এটা ছুটে গেলে সুরদাস রামজির নৌকো হাল ছাড়বে। তাই সে সাবধান করে দেয়।
যাবি না কখনও। আমি তোকে খাওয়াব, দেখিস। আমার পয়সা আছে।
জানি।
শুনে অমনি খরগোসের মতো তার কান খাড়া হয়ে ওঠে। মিহিন সতর্ক গলায় বলে কী জানিস?
পয়সার কথা।
রামজি ভারী বিপদে পড়ে যায়। জানে নাকি! সত্যিই জানে! আনমনে হাঁটে। হঠাৎ বলে তাড়াতাড়ি চল। গাড়ি আসছে।
কোথায়?
এই যে মাটি কাঁপছে! টের পাচ্ছিস না?
গেনিয়া টের পায় না। তার বাপ এইসব টের পায়।
.
উদাসী স্বামীর চেয়ে ঝগড়াটে মারকুটে স্বামী ভালো। তার স্বামী ভূতনাথ যে উদাসী তা বুঝতে একটু সময় লেগেছে এতোয়ারির। সে যখন মেহদিতে হাত পায়ের নকশা করত, কপালে পরত টিকলি, চোখে সুর্মা, তখন কদাচিৎ ভূতনাথ তার সে সাজগোজ লক্ষ করত। বোধহয় পশ্চিমা সাজ ওর পছন্দ নয়–এই মনে করে এতোয়ারি তারপর পায়ে পরত আলতা, সিঁথিতে ভুরভুরে লাল সিঁদুর দিত, ডানদিকের বদলে বাঁ-দিকে আঁচল নিত। তারপর বুঝল, লোকটা এ সব দেখে না। বাগানের মাটি ঘেঁটে–ঘেঁটে মাঝে-মাঝে চুপ করে ঝিম মেরে থাকা–ওই হচ্ছে ওর স্বভাব। এই ভেবে এতোয়ারির বুক ভারী হয়েছে কতবার। এখন সয়ে গেছে। এতোয়ারি ঝগড়াটে কম নয়। কিন্তু এ লোকটার সঙ্গে সে ঝগড়া করে না। বয়সে ভূতনাথ তার চেয়ে অনেক বড়। এখনই মানুষটার চুলে পাক ধরে গেছে। সবসময়ে চিন্তা নিয়ে থাকে বলে মুখে গম্ভীর বুড়োটে ভাব। এইসব মিলে একটা সমীহের ভাব আসে এতোয়ারির মনে। তার ওপর মানুষটা ভিনদেশি।
দুপুরে খেয়ে মানুষটা বাইরের খাঁটিয়ায় বসে বিড়ি ধরিয়েছে। তেমনি উদাস ভঙ্গি। এঁটো ফেলতে বাইরে এসে একপলক নীরবে স্বামীকে দেখল। দেখতে ভালোই লাগে। একটু পরেই কমলি খেয়ে এসে বাপের হাত-পা দাবাতে বসবে। তখন রাজ্যের গল্প ফাঁদবে কমলি। তারপর গল্পের মাঝখানেই কখন বাপের বুক ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। পিপুলের ছায়ায় রোদের একটা জাল মৃদুমন্দ নড়বে ওদের মুখে, শরীরে।
.
ইস্টিশানে বাপ-ব্যাটাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চমেলি কুকুর রোজ ল্যাং–ল্যাং করে একা ফেরে। মাঝে বাতাস শুকে দাঁড়ায়, এধার যায় ওধার যায়। ঘুরে ফিরে এক সময়ে ঠিক দুপুরবেলা এসে দাঁড়ায় কমলিদের উঠোনে। দাঁড়িয়ে হাঁক ছেড়ে জানান দেয় যে সে এসেছে। কমলিও তৈরি থাকে শেষ কয়েকটা গ্রাস সে খায় না। সেটা মুঠোভরে নিয়ে দৌড়ে আসে। নাড়তে-নাড়তে ল্যাজটা বুঝি আনন্দে খসেই যায় চমেলির। যদিও সে গেনিয়ার কুকুর, তবু বাপ-ব্যাটার খাওয়ার পর ভুক্তাবশেষ কিছুই থাকে না বলে চমেলির পেট ভরে না। প্রায়দিনই তাই তাকে কমলির কাছে আসতে হয়। দু-মুঠো ভাতের পরিবর্তে সে বিস্তর অত্যাচার সহ্য করে যায়। কমলি চিরুনি। দিয়ে তার গা আঁচড়ে দেয়, মেহদি বেটে গায়ে নকশা আঁকে, গলার চামড়া টেনে আদর করে।
ভাঙা একটা সানকি পড়ে আছে আঁস্তাকুড়ে। তাতে পাতের ভাত ঢেলে দিয়ে কমলি চমেলির সঙ্গে কথা বলে কঁহা গৈল তোহর মালিক। বিজনেসমে?
শুখা অন্ধকে লোকে খুব একটা দয়া করে না। বিজনেস ভালো হয় গলায় গান থাকলে।
সেই কথা মাঝে-মাঝে বাপকে বোঝায় গেনিয়া। কিন্তু সুরদাস রামজির গানের গলা নেই। হাঁ করলে ফাটা বাঁশের আওয়াজ বেরোয়।
তুই শেখ গেনি। হিন্দি ফিলিমের গানা দু-চারটে কাবেজে রাখ।
গেনিয়ার লজ্জা করে। আড়ালে অবশ্য সে গায়। গাইবার চেষ্টা তার আছে। দুটো চ্যাপটা পাথর আঙুলে বাজিয়ে যশিডির ভিখন এই এত পয়সা রোজগার করে। দুটো পাথর গেনিয়ারও জোগাড় আছে।
সন্ধেবেলা সীতারামপুর কি ঝাঁঝা থেকে ফিরতি গাড়ি ধরে ফেরে বাপ-ব্যাটা। ঝোঁপড়ার কাছে এসে বাপকে একা ছেড়ে দেয় গেনিয়া, তারপর পিছন ফিরে জোর কদমে হাঁটতে থাকে। পিছন থেকে তার বাপ প্রাণপণে তাকে ফিরে ডাকে, শাপ–শাপান্ত করে, মিনতি করে, গেনিয়া ফেরে না। এক দৌড়ে লাইন পার হয়ে চলে আসে গুমটি ঘরের পিছনে ব্যারাকবাড়িতে। রোজ সন্ধেবেলা গান গায় মহিন্দর–যার সঙ্গে তার মা আছে এখন। পুরোনো একটা হারমোনিয়ম আছে মহিন্দরের, খাঁটিয়ায় চাগিয়ে বসে সে, এক পা তুলে দেয় হারমোনিয়মের ওপর গোঁড়ালি দিয়ে বেলো করে, দুই হাতে রিড চেপে আওয়াজ বের করে হারমোনিয়মের। দরাজ গলায় গান গায় তার সামনের দুটো উঁচু দাঁতে দু-ফোঁটা সোনা চিকচিক করে। শৌখিন লোকটা। তার সামনে। চমেলির মতোই খাপ পেতে বসে থাকে গেনিয়া। মনপ্রাণ দিয়ে গান শোনে, তুলে নিতে চেষ্টা করে মনে-মনে।
তার মায়ের দুটো বাচ্চা হয়েছে, তারা কিলকিল করে ঘরে। চেঁচায়। আস্তে-আস্তে রাত বেড়ে যায়। প্রায় দিনই পেঁয়াজ রসুন আলুর চচ্চড়ি দিয়ে মা তাকে বাচ্চা দুটোর সঙ্গে ভাত খাইয়ে দেয়। ভাত দিতে-দিতে বলে–খবরদার, ওই বুড়োটার মতো ভিখিরি হবি না।
গেনিয়া হাসে-কিন্তু গান জানলে মাঙ্গা ভালো বিজনেস।
হোক গে, তোর তাতে দরকার নেই। বুড়ো মরলে আমি তোকে নিয়ে আসব।
কথাটা কাজের নয়। গেনিয়া জানে, শত হলেও মা তার পরের ঘর করে। মহিন্দরের দুটো ভৈষ আছে, একটা চায়ের দোকান আছে বটতলায়, সেই দোকানে চোর ছ্যাঁচোড়দের আড্ডা। বড় রাগি মহিন্দর। মাকে মাঝে-মাঝে বাশডলা মার দেয়। নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলে থুথু ফেলে। মাকে দিয়ে চাটায়। এক-এক বেলা বেঁধে রেখে চলে যায়, কতদিন গিয়ে সেই দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়ে এসেছে গেনিয়া, মার মুখ দিয়ে টসটসে রক্ত পড়ে শুকিয়ে আছে, চোখ ফোলা, পিছমোড়া করে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অসহায় বসে আছে, দুটো বাচ্চা সেই অবস্থাতেই বুক খুলে চুষছে। এ সবের চেয়ে তার সুরদাস অন্ধ ভিখমাঙ্গা বাপের কাছেই সে সুখে আছে। যদিও বুড়োটা খচাই, পয়সাকড়ি কোথায় যে লুকোয় কে জানে, তবু গেনিয়ার বিশ্বাস, বুড়োর বিল একদিন সে-ই পাবে। বুড়ো মরলে সে একদিন ঝোঁপড়াটা তোলপাড় করে দেখবে, মাটি খুঁড়বে, ঝোঁপড়া ভেঙে বাঁশের গর্তে খুঁজবে। থাকবেই কোথাও না কোথাও। সেই পয়সায় ঘর ভাড়া নেবে সে, কিনবে হারমোনিয়ম, গলায় বেঁধে চলে যাবে ট্রেনে–ট্রেনে, বিজনেস করে এত পয়সা নিয়ে আসবে।
গেনিয়া রাত করে ফেরে। হঠাৎ পৃথিবীর সব দারিদ্র্য মোচন করে শাঁকালুর মতো সাদা একটা ক্ষয়া চাঁদ তার দুধ ঝরিয়ে দেয় চারদিকে। সাদা ফটফটে ইউক্যালিপটাস গাছ বেয়ে দুধ ঝরে পড়তে থাকে। ফুলের গন্ধে ম–ম করে বাতাস। নির্জন রাস্তায় বেভুল দাঁড়িয়ে পড়ে গেনিয়া। তারপর আনন্দে উদ্ভাসিত গলায় গান ধরে সে, দু-চক্র নাচ নেচে নেয়, পাথর তুলে দু-হাতে খঞ্জনির মতো বাজায়।
গেনিয়া এগোতে থাকে। সামনেই কমলিদের বাড়ি। বাগানের গাছপালার ভিতর দিয়ে দেখা যায়। ওদের ঘরে বিজলির আলো জ্বলছে। বড় বাড়িটা অন্ধকার, বাইরের ফটক বন্ধ। চারদিক। নিঃঝুম। সেই নিঃঝুমতার মধ্যে একটা সোনার ঘোড়া আকাশ থেকে লাফ দিয়ে নামে। দুধের মতো স্বাদু জ্যোৎস্নায় সেই ঘোড়াটাকে গেনিয়া মনশ্চক্ষে দেখে আর দেখে। সোনার দাম অনেক। গেনিয়া জানে।
অভাবের সংসার বলেই তার মা অভাবী অন্ধ বাপকে ছেড়ে গেছে। খুব বেশিদূর যেতে পারেনি অবশ্য। লাইনের ওপারে রাগি মহিন্দরের লাথিঝাঁটা খেয়ে আছে। সোনার ঘোড়াটা পেলে সে ঝোঁপড়া ভেঙে পাকা ঘর তুলবে একটা। রাগি মহিন্দরের কাছ থেকে নিয়ে আসবে মাকে। সুরদাস ভিখমাঙ্গা রামজি শীতের রোদে একখানা ভাগলপুরি চাদর গায়ে দিয়ে রোদ পোয়াবে। আর গেনিয়া গলায় হারমোনিয়ম বেঁধে চলে যাবে যশিডির মেল ট্রেন ধরে ঝাঁঝা কিংবা মধুপুর হয়ে গিরিডি অবধি।
নিঃসাড়ে গেটটা ডিঙোলো গেনিয়া। গাছগাছালির ভিতরে ভিতরে দুধ টলটল করছে। ছায়া পড়ছে বিচিত্র। তার ছায়াটা ঠিক যেন ন্যাংটো মানুষের ছায়া। গাছপালা ভেদ করে সে ধীরে-ধীরে অন্ধকার বাড়িটার ছায়ায় এসে দাঁড়ায়। চারদিকে চেয়ে দেখে। কোনওখানে কোনও নড়াচড়া নেই।
উত্তরের জানলাটার সামনে এসে দাঁড়ায়, জানলাটার একটা শিক ভাঙা। সন্তর্পণে জানলার পাল্লাটা টেনে দেখে সে। বন্ধ হলেও খুব আঁট নয় পাল্লাটা। ঢকঢক করে একটু নড়ে। গেনিয়া একটা পাল্লা চেপে ধরে আর-একটা টানে, মাঝখানে এক আঙুল পরিমাণ একটা ফাঁক দেখা যায়। ডান হাতের কচি আঙুলগুলো ঢোকে, আটকায় হাতের তেলোটা। প্রাণপণে পাল্লাটা টেনে ধরে গেনিয়া। আপ্রাণ চেষ্টা করে হাত ঢোকাতে। ভারী পাল্লাদুটো কামড়ে ধরে তার কচি হাত, চিবিয়ে খেতে থাকে। তবু ছিটকিনির গোল মুখটা তার আঙুলে লাগে। কিন্তু সেটাকে ধরার মতো অবস্থা তার হাতের নয়। তার ওপর পাল্লা টান থাকায় ছিটকিনিটা শক্ত হয়ে জমে আছে। তবু সে চেষ্টা করতে থাকে। জানলার দুই ভারী পাল্লা রাক্ষসের মুখের মতো নিবিড় আনন্দে তার হাতখানা চিবোতে থাকে। যন্ত্রণায় সে গোঙানির শব্দ করে।
কাছেপিঠে একটা কুকুর ডাকছে। হারামিরা হরবখত কেন যে ডাকে গেনিয়া ভেবে পায় না। হাতটা টেনে বের করার সময়ে ছাল ছড়ে যায়, হাতটা জ্বালা করতে থাকে খুব। জ্যোৎস্নায় বাগানের মধ্যে সে একটুকরো কাঠ কি কাঠি খুঁজে দেখে। পেয়েও যায়। ছোট একটুকরো পাতলা কাঠ। আবার জানলা ফাঁক করে সে কাঠের গোঁজা ঢোকায়। তারপর আবার হাত ভরে। ক্রমে ক্রমে প্রচন্ড চেষ্টায় সে কবজি পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতে পারে।
কুকুরের ডাকটা এগিয়ে আসছে। দূরে কমলির গলা শোনা যাচ্ছে। সে ডাকছে–চমেলি–এ চমেলি–ই-ই—ই–
কুকুরটা চমেলিই। রেন্ডি কোথাকার। ভাতের লোভে দু-বেলা এইখানে এসে বসে থাকে।
নিবিষ্ট মনে ছিটকিনির মাথাটা ধরার চেষ্টা করতে থাকে গেনিয়া। ধরেও। সেই সময়ে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটে আসে চমেলি। দুটো বুকফাটা আনন্দের ডাক দিয়ে সে কুঁইকুই করতে করতে প্রবল ল্যাজের তাড়নায় গেনিয়ার দুই পায়ের ফাঁকে মাথা গুঁজে দেয়। লাফিয়ে ওঠে গায়ে, পা চেটে দেয়।
–রেন্ডি! চাপা গলায় গাল দেয় গেনিয়া। তারপর প্রবল লাথি কষায় একটা। কেঁউ করে ছিটকে পড়ে চমেলি। পরমুহূর্তেই অপমান ভুলে আবার কুঁইকুঁই করে এগিয়ে আসে, ল্যাজের ঝাঁপটা মারে, নানারকম আদরের শব্দ করতে থাকে। ওদিকে গেনিয়ার আঙুলের ডগায় ছিটকিনিটা ঘুরে যাচ্ছে। বিনবিন করে ঘাম ফুটে উঠছে তার মুখে।
একটা টেমি উঁচু করে ধরে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে কমলি, ডাকছে–চমেলি–এ চমেলি –ই–ই–
ছিটকিনিটা ঘুরছে। ঘুরে যাচ্ছে। ঘরের ভিতরে অন্ধকারে লাফ দিচ্ছে সোনার ঘোড়াটা। ঘুরছে ঘরময়। বেরোবার পথ খুঁজছে। কিন্তু হাতটা জ্বলে যাচ্ছে গেনিয়ার, মটমট করছে হাতের হাড়, ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে সে। কামড়ে ধরছে জানালার পাল্লা, দাঁতে–দাঁত ঘষছে।
ধোঁয়াটে টেমি হাতে এগিয়ে আসছে কমলি ডাকছে চমেলি–ই—
গেনিয়ার দুপায়ের ভিতর থেকে আনন্দে সাড়া দিচ্ছে চমেলি।–ঘে-উ-উ ঘেউ–
ঠক করে ছিটকিনিটা উঠে পাল্লাটা হাঁ হয়ে যায়। অবশ হাতটা পড়ে যায় গেনিয়াব। আর এক হাতে কবজিটা চেপে ধরে গেনিয়া। আর-একটা লাথি কষায় চমেলির পেটে।
চোখের পলকে গেনিয়া জানালায় উঠে পাল্লাটা টেনে দেয়। বাইরে জানলার দিকে মুখ করে প্রবল চিৎকার করতে তাকে চমেলি। টেমির আলোটা উঁচু করে ধরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কমলি দৃশ্যটা দেখে। তার ভয় করতে থাকে।
সে হঠাৎ পিছন ফিরে বাবা আর মাকে ডাকতে–ডাকতে দৌড়োত থাকে।
অন্ধকারে এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে চলে যায় গেনিয়া। দরজার গায়ে হাতড়ে ছিটকিনি খোলে, আর এক ঘরে যায়। ধাক্কা খায় আসবাবপত্রের সঙ্গে। হোঁচট খায় কার্পেটে, পাপোশে। অন্ধকারে ঠাহর পায় না, তবু প্রাণপণে সেই ঘরটা খুঁজতে থাকে যে ঘরে আলমারি, আলমারিতে সোনার ঘোড়া। খুঁজতে-খুঁজতে ঘুরে মরে। দুটো ঘর খুলে তৃতীয় ঘর খুলতে গিয়ে সে ভারী বেকুব বনে যায়। এ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজা হাতড়ে সে এই তত্ব বুঝে যায়। এইটাই মাঝখানের ঘর বলে তার বোধহয়। এই ঘরেই সেই আলমারিটা রয়েছে। দরজাটা আক্রোশে প্রাণপণে টানে সে। পাথরের মতো অনড় থাকে ভারী পাল্লা। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে সে! বৃথা তারপর হাঁফিয়ে যায়। ক্লান্ত লাগে।
অন্ধকারে সে তখন বেভুল ঘোরে। ধাক্কা খায়। আবার ঘোরে। রাস্তা ঠিক করতে পারে না। ইঁদুর দৌড়োয় মেঝের ওপর দিয়ে। আরশোলা পিড়পিড় করে। বাইরে থেকে চেনা বাড়িটা ভিতর থেকে অন্ধকারে কেমন ভীষণ অচেনা লাগে। সে প্রতিটি জানলা হাতড়ায়। শিকভাঙা জানালাটা খুঁজে পায় না কিছুতেই। বাইরে চমেলি আর ডাকছে না। নিঃঝুম হয়ে গেছে চারধার। এখন গেনিয়া করে কী? যদিও সে চোর, রেন্ডির ব্যাটা, ভিখমাঙ্গা, তবু তারও আছে ভয়ডর। কমলি গেছে লোকজন ডেকে আনতে। এদিকে অন্ধকারে ভুল রাস্তায় টক্কর খেয়ে মরছে সে। বন্ধ দরজার ওপাশে–সে স্পষ্টই টের পায়–সোনার ঘোড়াটা চক্কর দিয়ে ফিরছে। বেরোবার রাস্তা পাচ্ছে না।
.
ভূতনাথের হাতে মশাল, কমলির হাতে টেমি। তারা দুজন বাড়িটা ঘুরে-ঘুরে দেখে। জানলাগুলি টেনে দেখে ভালো করে। সবই ঠিক আছে। উদাস গলায় ভূতনাথ বলে–কোথায় কী! তুই ভুল দেখেছিস।
তারপর নিশ্চিন্ত মনে তারা শুতে যায়।
.
গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে শীতবোধ করে সুরদাস রামজি। আজ বিছানায় তেমন ওম নেই। ওম-এর জন্য খুঁতখুঁত করে সে কোঁকায়। ঘুমের ঘোরেই বিছানা হাতড়ে গেনিয়াকে খোঁজে। অন্ধের নড়ি। ওর শিশু শরীর বুকের মধ্যে নিলে তাপ আসে। কিন্তু বিছানাটা শূন্য। কোনও চোরচোট্টার শাগরেদি করতে গেছে গেনিয়া কে জানে? নাকি ওই রেন্ডিটা ফুসলে রেখে দিল! হা। ভগবান, জীবনভর তবে দুনিয়া হাতড়ে প্রাণটা যাবে তার। আধোঘুমেই সে গাল পাড়ে, বিলাপ করে। আবার ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে।
বাইরের উঠোনে জ্যোৎস্নার নদী বয়ে যাচ্ছে। চমেলি সেই দৃশ্য দেখে মাঝে-মাঝে ঘুমচোখে খায়। একটা দুটো ডাক ছাড়ে। আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে চোখ বোজে।
রাত বাড়ে।
.
নরম গদির ইংলিশ বেড-এর ওপর উদোম গায়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে গেনিয়া! ভারী ক্লান্ত সে। কেঁদেছিল, চোখের জল শুকিয়ে আছে গালে। দু-এক ফোঁটা জমে আছে চোখের কোলে।
মাঝরাতে বাগানের ছায়াগুলো বেঁকে ভেঙে যাচ্ছিল। জ্যোৎস্না তীব্র হয়েছে, ফুলের গন্ধে গাঢ়, মন্থর হয়েছে বাতাস।
দুঃখীদের জন্য স্বপ্নের সন্ধানে বেরিয়েছেন ঈশ্বর। আনাচে-কানাচে ঘুরে তিনি চরাচর থেকে স্বপ্নদের ধরেন নিপুণ জেলের মতো। আঁজলা ভরা সেই স্বপ্ন তিনি আবার ছড়িয়ে দেন। মাঝরাতে তারার গুঁড়োর মতো সেই স্বপ্নেরা ঝরে পড়ে পৃথিবীতে।
গেনিয়া দেখে সোনার ঘোড়ার পিঠে চেপে তারা চলেছে। পিঠের কাছে অন্ধ বাপ, তার কোমর জড়িয়ে মা। গেনিয়ার দুই হাতে খঞ্জনির মতো দুটো পাথর। সে পাথর বাজিয়ে ভারী সুন্দর গান। গাইছে। সামনেই সোনালি নদী, নদী পেরোলেই আকালের দেশ শেষ হয়ে যাবে। ওই পাড়ে ভিক্ষে পাওয়া যাবে খুব।
চোখে জল নিয়েই ঘুমের মধ্যে একটু হাসে গেনিয়া।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন