গর্ভনগরের কথা

১৬০ পঠিত ... ১৭:৫৭, এপ্রিল ২৮, ২০২৪

28

লিফটের দরজার কাছে এক বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। একা। লিফটের দরজা খোলাই রয়েছে। ওপরে যাওয়ার যাত্রী আজকাল আর নেই। কিন্তু সীমন্তককে যেতেই হবে। ওপরেই তার কাজ।

আজ সকাল থেকে সীমন্তক খুশিই রয়েছে। খুশি হওয়া খুব বিচিত্র নয়। কারণ আজ সকালের রেশনেই সে পেয়েছে আধবুড়ি পালং শাক আর দু-মুঠো কড়াইশুটি। কী সবুজ! কী সবুজ! কৃত্রিম খাবার আর ভিটামিন আর ধাতব ট্যাবলেট খেয়ে-খেয়ে জিভ অসাড়। বহুকাল পরে সে আজ টাটকা তরকারি খেল। কড়াইশুঁটির খোসাগুলোও সে ফেলে দেয়নি, পালং শাকের শেকড়টুকুও।

খোশমেজাজে লিফটে উঠবার মুখে সে বৃদ্ধের করুণ চাউনি দেখে হাসিমুখে জিগ্যেস করল–ওপরে যাবেন নাকি?

–নেবেন?

সীমন্তক মাথা নাড়ল–আসুন।

বুড়োকে চেনে সীমন্তক। প্রায়ই এখানে সেখানে দেখা হয়। বয়স বোধহয় দুশো পঁচাত্তর বছর। আসলে এইসব বুড়ো মানুষেরা হলো প্রদর্শনীর বস্তু। মানুষের বিজ্ঞান কতদূর কী করতে পারে এ হচ্ছে তারই এক উদাহরণ। যে কজন এরকম প্রবৃদ্ধ হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগেরই অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতির অনেক অদল-বদল ঘটে গেছে। কারও বুকে অন্যের হৃদযন্ত্র, কারও ফুসফুস কৃত্রিম, কারও পাকস্থলী কেটে বাদ দিয়ে কৃত্রিম পাকযন্ত্র বসানো হয়েছে, কারও ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে মস্তিষ্ক। আর এইভাবেই এদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তবে বেশিরভাগেরই স্মৃতি ধূসর, বোধ বা বুদ্ধি খুবই ক্ষীণ, আচরণ অনির্দিষ্ট। সীমন্তক এদের এড়িয়েই চলে। কিন্তু আজ সে বড় খোশমেজাজে আছে, তাই বৃদ্ধকে উপেক্ষা করল না।

বুড়ো লোকটি লিফটে উঠে চারদিকে সভয়ে চেয়ে দেখছেন। মস্ত এক ঘরের মতো এই লিফটে নানা রকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানো। বিশেষজ্ঞ ছাড়া এই লিফট চালানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

সীমন্তক বিশেষজ্ঞ। সে নানারকম চাবি টিপে, হাতল ঘুরিয়ে লিফট চালু করে এবং গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। এক সময়ে আনমনে বলে ওপরে তো বরফ ছাড়া আর কিছু নেই, তবু কী দেখতে যান বলুন তো!

বৃদ্ধ খুবই কাঁচুমাচু হয়ে বললেন—কিছু না। মাটির নীচে থাকতে ভালো লাগে না তো, তাই।

–মাটির নীচটা কি খারাপ?

–আকাশ দেখা যায় না তো।

–ওপরেও কি আকাশ দেখা যায়?

–তা নয়। তবে ওই আর কী। কিছুটা ফাঁকা তো দেখা যায়। সীমন্তক এসব ভাবপ্রবণতার মানে বোঝে না। পৃথিবীর ওপরে এক সময়ে জনবসতি ছিল এ তো জানা কথা। কিন্তু মাটির নীচের জনবসতি তার চেয়ে এক বিন্দু খারাপ কি? সীমন্তক অবশ্য জন্মেছেই মাটির নীচে; তাই তার কাছে আকাশ বা ফাঁকা জায়গা দেখার কোনো আকর্ষণ নেই।

 

লিফট উঠতে-উঠতে মাঝে-মাঝে বিভিন্ন চেক পোস্টে থামছে। পৃথিবীর ওপরে প্রতি মুহূর্তে পুরু হয়ে উঠেছে বরফের আস্তরণ। তাই প্রতি মুহূর্তের খবর লিফটের যাত্রাপথে সংগ্রহ করে নিতে হয়। পৃথিবীর মাটির মাত্র একশো থেকে দেড়শো ফুট নীচে এখানকার জনবসতি। কিন্তু মাটির ওপর আরও দুশো তিনশো-চারশো বা তারও বেশি ফুট বরফ জমে আছে। শূন্যের বহু-বহু ডিগ্রি নীচে নেমে গেছে তাপাঙ্ক অ্যালকোহল ব্যারোমিটারেও মাপা সম্ভব নয়। মৃত, সাদা। অবিরল তুষার ঝটিকায় আক্রান্ত বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তবু সংযোগ রাখতে হয় গর্ভনগরগুলোর। কারণ সংগ্রহ করতে হয় শ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় বাতাস জল বিদ্যুৎ। বহুদূর মহাকাশে পৃথিবীর চারদিককার বিমর্ষ প্রায়ান্ধকার তুষারমণ্ডলের বাইরে পরিক্রমারত রয়েছে মানুষের সৃষ্ট অসংখ্য কৃত্রিম উপগ্রহ সেগুলোর সঙ্গেও অব্যাহত রাখতে হয় যোগাযোগ। তাই পৃথিবীর উপরিভাগে মানুষ বরফ ভেদ করে তৈরি করেছে বহু সংখ্যক বুদ্বুদ। নামে বুদ্বুদ, দেখতেও তাই। এস্কিমোদের ঘর ইগলু যেমন দেখতে ছিল অবিকল সেই রকম। তবে বরফ দিয়ে তৈরি নয়, এগুলো তৈরি হয়েছে মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে ঘাতসহ তাপসহ অসম্ভব শক্তিশালী পলিথিন দিয়ে। বুদ্বুদগুলো প্রতিদিনই বরফে ঢাকা পড়ে যায়। প্রতিদিনই সেগুলোকে ঠেলে আরও উঁচুতে তুলে দিতে হয় নীচে থেকে চাপ দিয়ে।

এইরকম একটি বুদ্বুদেই কাজ করতে হয় সীমন্তককে। প্রতিদিন সে বুদ্বুদে বসে মৃত তুষার যুগের সাদা পৃথিবীর দৃশ্য দেখে। প্রতিদিন তাকে মাটির ওপর প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে উপরিভাগের বরফের চাপের হিসেব নিতে হয়, ভূকম্পন তুষারস্তরের ঘর্ষণজনিত দুর্বিপাক ও আবহাওয়ার প্রতি মুহূর্তের মতিগতির দিকে নজর রাখতে হয়। কোনওদিন যদি বরফের চাপে, গর্ভনগরের ছাদ ধসে যায় তবে মানুষের সর্বনাশ। তুষার যুগের শৈত্য সহ্য করা যে কোনও প্রাণীরই সাধ্যাতীত। একটা দীর্ঘ শ্যাফটের ভিতর দিয়ে লিফট ধীরগতিতে উঠছে। সর্বশেষ চেক পোস্টে থাকে সীমন্তক। দরজা খোলে। সামনে ছোট্ট একটা ইস্পাতের তৈরি ঘরে নানা যন্ত্রপাতির মধ্যে একটি হাসিখুশি ছেলে বসে আছে। সে মাথা নেড়ে বলল –আমাদের বাবলাটায় হয়তো কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। বড্ড বেশি বরফ পড়েছে দু-দিন। আর বেশি ঠেলে তোলা যাবে না।

সীমন্তক ভ্রূ কুঁচকে ফিরে আসে। চেক পোস্ট থেকে ছেলেটি তাকে সবুজ বাতি দেখায়।

বুড়ো লোকটি এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। একটি টুলের ওপর চুপ করে বসে আছেন।

শেষ পর্যায়ে লিফট খুব ধীরে-ধীরে চলে। এখানে শ্যাফট বা লিফটের সুড়ঙ্গ পথটি টেলিস্কোপিক। অর্থাৎ সে ইচ্ছে করলে জিরাফের মতো গলা লম্বা করতে পারে। তবে সে ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। শেষ পর্যায়ে পুরোটাই গভীর কঠিন বরফের ভিতর দিয়ে যাওয়া। লিফেটের ভিতরটা অবশ্য সম্পূর্ণভাবে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রিত। তবু গর্ভনগরের তুলনায় এখানে যেন একটু শীত বেশি, নীরবতা বেশি।

লিফট থামলে সীমন্তক দরজা খোলে।

বিশাল আয়তনের ঘরখানা সাদা আলোয় ভরে আছে।

গর্ভনগরের জীবনে সকাল বিকাল বা রাত্রিবেলা কিছু নেই। সেখানে সব সময়ে কৃত্রিম আলোর জগৎ, সূর্যোদয় সূর্যাস্ত, পূর্ণিমা বা অমাবস্যা নেই, তারাভরা আকাশের দিকে তাকানোর উপায় নেই

সাদা আলোয় ভরা বুদ্বুদের ভিতরে পা রেখেই নাক কুঁচকে যায় সীমন্তকের। প্রাকৃতিক আলো তার সহ্য হয় না। জন্মাবধি সে বড় হয়েছে কৃত্রিম আলোর মধ্যে।

আজ মেঘলা আকাশ ভেদ করে ক্ষীণ সূর্যরশ্মি দেখা দিয়েছে। চারদিককার লক্ষ কোটি বরফের স্ফটিকে সেই আলো চতুগুণ তেজে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। বাইরের দিকে চোখ রাখা দুষ্কর।

সীমন্তক কর্মরত আর-একজন লোককে ছুটি দিয়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজে বসে গেল। মহাকাশে অনেকগুলো মস্ত-মস্ত উপগ্রহ আছে, যাদের বলা হয় স্বর্গনগর। কোনও-কোনওটার দৈর্ঘ্য এক মাইল দেড় মাইল। পাশবালিশের মতো চেহারার এইসব উপগ্রহের ব্যাসও কয়েক হাজার ফুটের মতো। কয়েক সহস্র লোক স্থায়ীভাবে এগুলিতে বসবাস করছে। সেখানে কৃত্রিম উপায়ে চাষবাস, চিকিৎসা, মেরামতের কাজ সবই হয়। সন্তান জন্মায়, বড় হয়। সীমন্তকের কাজ এইসব কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। কাজ করতে-করতে সীমন্তক বুড়ো লোকটির কথা একদম ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ নজরে পড়ল, বুদ্বুদের সুদূর একটি কোণে স্বচ্ছ দেওয়ালে শরীর সিঁটিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বাইরের দিকে নিথরভাবে চেয়ে আছেন।

মহাকাশ থেকে নতুন কোনও খবর নেই। শুধু জানা গেল ওপর থেকে তারা পৃথিবীর দিকে অবিরল নজর রেখে চলেছে। দক্ষিণ মেরুর দিকে গত কয়েকদিন তুষারপাত খুবই কম হয়েছে।

সীমন্তক খোশ-মেজাজে উঠে বুড়ো লোকটির কাছাকাছি এসে বলল  কী দেখছেন? বৃদ্ধ তাঁর বলিরেখাবহুল মুখখানা ফিরিয়ে তাকালেন। কিন্তু সীমন্তককে যেন চিনতে পারলেন। বিড়বিড় করে বললেন–সূর্য উঠেছে!

সীমন্তক হাসল। সূর্যের প্রতি তার নিজের কোনও দুর্বলতা নেই। বলল –মাঝে-মাঝে ওঠে। কিন্তু ওদিকে অত চেয়ে থাকবেন না। চোখের ক্ষতি হতে পারে।

বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–চোখের ক্ষতি আর কী হবে! আমার পুরোনো চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে সেই কবে! এটা হচ্ছে চতুর্থ চোখ। আবার না হয় পালটাব। একটু দেখতে দাও।

এরা কী দেখে, কী মজাই না পায় তা সীমন্তক ভেবেও পায় না। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল –দেখুন না। তবে দেখার তো কিছু নেই। শুধু সাদা বরফ।

লোকটা আবার বাইরের দিক মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করে বলল –সূর্য উঠেছে! বাইরে সূর্য উঠেছে। ওদের খবর দেবে না?

একটু ঝুঁকে সীমন্তক জিগ্যেস করে–কাকে খবর দেব?

ওই যারা নীচে রয়েছে। খবর দাও। তারপর চলো আমরা রোদ্দুরে যাই।

সীমন্তক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুড়োটার মগজ বদলের সময় এসেছে। বাইরে গিয়ে স্বাভাবিক বাতাসের একটি শ্বাসও বুক ভরে নিলে সঙ্গে-সঙ্গে ফুসফুস জমে পাথর হয়ে যাবে। এক মুহূর্তের মধ্যে জমে কাঠ হয়ে যাবে শরীর। তাই বাইরে যাওয়ার দরকার হলে সম্পূর্ণ বায়ু-নিরোধক এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একরকমের পোশাক পরে যেতে হয়।

বুড়ো লোকটি উন্মুখ হয়ে সীমন্তকের দিকে চেয়ে বলল –আমি যখন খুব ছোট তখন মাটির ওপর সবুজ গাছপালা দেখেছি। তারপর হৈম হাওয়া আর তুষার আসতে লাগল। তখন পাতালে গর্ভনগর তৈরির কাজ করতেন আমার বাবা। যখন আমরা নীচে চলে গেলাম তখন খুব কেঁদেছিলাম আমি। বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন–পৃথিবী আবার কয়েক বছরের মধ্যেই সবুজ হবে।

সীমন্তক এই বৃদ্ধের দুঃখকে সঠিক বোঝে না, তবু কিছু সমবেদনা বোধ করে সে বলে–পৃথিবী খুব শিগগির সবুজ হবে না।

–কেন?

সীমন্তক ম্লান হেসে বলে–যত বরফ জমে আছে পৃথিবীর ওপর তা গলতে বহু বছর লেগে যাবে। তারপর বরফ গলে নেমে আসবে মহা প্লাবন। ওপরের সমস্ত ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে যাবে সেই প্লাবনে। জল সরতে লাগবে আরও বহু বহু বছর। সবুজ আসবে তারও বহু পরে।

–অরণ্য তৈরি হবে না, গাছে–গাছে পাখি ডাকবে না, ফুলে–ফুলে পতঙ্গের ওড়ার শব্দ শুনব কেউ কোনওদিন? আমাদের সকালের সূর্যোদয়, বিকেলের বিষণ্ণতা, রাত্রির নিস্তব্ধতা বলে কিছু থাকবে না ততদিন?

বুড়ো মানুষরা শিশুর মতোই। সীমন্তক তাই ছেলে–ভুলানো স্বরে বলে–চিন্তা কী? আমাদের গর্ভনগরের পক্ষী নিবাসে যথেষ্ট পাখি রয়েছে, আমরা রাসায়নিক পদ্ধতিতে মাটির নীচে অরণ্য না হোক যথেষ্ট গাছপালা তৈরি করেছি, পতঙ্গেরও অভাব নেই আমাদের কীট প্রজনন ক্ষেত্রে।

বিস্বাদে ভরে গেল বৃদ্ধের চাহনি। মাথা নত করে বলল –তোমরা কেন লেজার রশ্মি এবং বিস্ফোরণের সাহায্যে সব বরফ গলিয়ে ফেলছ না?

–লাভ কী? শূন্যের বহু নীচে নেমে গেছে তাপাঙ্ক। বরফ গলে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার তা জমাট বাঁধবে।

–কেন কৃত্রিম সূর্য সৃষ্টি করছ না?

সীমন্তক বৃদ্ধের পিঠে হাত রেখে বলে–আমরা সে চেষ্টাও করছি। কিন্তু কৃত্রিম সূর্যেরও সাধ্য নেই পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপ ফিরিয়ে আনার।

বৃদ্ধ কথা বললেন না। বাইরের স্তিমিত সূর্যরশ্মির দিকে চেয়ে রইলেন। ঝোড়ো হাওয়ায় গুঁড়ো বরফ বালির মতো উড়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বরফের স্তম্ভ, খিলান, গম্বুজ, আবার আপনা থেকেই ভেঙে যাচ্ছে সব।

বেতার যন্ত্র মহাকাশের বার্তা আসছে। সীমন্তক তার টেবিলে ফিরে গেল এবং বৃদ্ধের কথা তার আর মনে রইল না। বার্তা আসছে, মহাকাশ থেকে পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে দক্ষিণ মেরুতে একটি জায়গায় সামান্য কিছু বরফ গলে ছোট্ট একটু জলাশয় তৈরি হয়েছে। খবরটা অবিশ্বাস্য। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। তবু সীমন্তক গর্ভনগরের বিশেষজ্ঞদের কাছে খবরটা পাঠিয়ে দিল। দীর্ঘ টানেলে যুক্ত পৃথিবীর গর্ভনগরের বিশেষজ্ঞরা কয়েক মিনিটেই দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছোতে পারবেন।

যখন সীমন্তক তার অত্যন্ত জরুরি বার্তাটি যথাস্থানে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত তখন সেই বৃদ্ধ মানুষটি প্রাণপণে নিজেকে স্বচ্ছ কঠিন দেওয়ালে চেপে ধরে নিবিড় নিষ্পলক দৃষ্টিতে বাইরে চেয়েছিলেন। হঠাৎ তার দৃষ্টির বিভ্রম ঘটল।

তিনি দেখতে পেলেন অফুরান তুষার-স্তূপের একঘেয়ে সাদা রঙের ভিতর থেকে হঠাৎ ছোট্ট রামধনু রঙা গিরগিটির মতো একটি প্রাণী বরফের স্তর ভেদ করে মাথা তুলল। কী একটু দেখল চারদিকে। বিঘতখানেকের বেশি বড় নয়। তারপরই আবার টুক করে সরে গেল গর্তের মধ্যে। অবিশ্বাস্য! সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য! নিশ্চয়ই চোখের ভুল। বুড়ো লোকটি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন –রোদ্দুর! গিরগিটি! রোদ্দুর! গিরগিটি! তবে কি অরণ্যও জেগেছে? সবুজ। পাখি?

বৃদ্ধ লোকটি চারদিকে চেয়ে দেখেন বুদ্বুদের ভিতরে কয়েকজন মানুষ তাদের যন্ত্রপাতির মধ্যে মগ্ন হয়ে রয়েছে, কেউ তাঁকে দেখছে না।

বৃদ্ধ চুপিসারে বুদ্বুদের দক্ষিণ প্রান্তে একটি সুড়ঙ্গের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। একদম শক্ত করে আঁটা ভারী এই ধাতব দরজা। কিন্তু বৃদ্ধ দরজা খোলার কৌশল জানেন। মাথার ওপরকার একটি হুইল ঘুরিয়ে তিনি দরজা ফাঁক করলেন এবং টুক করে নেমে পড়লেন সুড়ঙ্গে। পথ অল্পই। পথের শেষে আর-একটি ঢাকনি। সুড়ঙ্গের মধ্যে গরম হাওয়া বওয়ানো হচ্ছে তবু এখানে দুর্দান্ত শীতের আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু বৃদ্ধ শীতকে গ্রাহ্য করেন না। বিড়বিড় করে বলতে থাকেন–ওরা জানে না বাইরে রোদ উঠেছে। বরফ গলছে। গিরগিটি দেখা দিয়েছে। ওরা জানে না বরফের নীচে ঘাস জন্মেছে…বলতে-বলতে তিনি বাইরের দরজা খুলে এক লাফে বেরিয়ে এলেন বাইরের সাদা মৃত হৈম পৃথিবীতে।

একবারের বেশি শ্বাস টানতে হলো না তাকে। পরমুহূর্তেই জমে কাঠ হয়ে পড়ে গেল তার শরীর।

ব্যাপারটা টের পেতে সীমন্তকের দেরি হয়নি। টি ভি চ্যানেলেই সে দৃশ্যটা দেখেছে। বাইরে যাওয়ার পোশাকটুকু পরে নিতেই যেটুকু সময় নিয়েছে, পরমুহূর্তেই সে বাইরে এসে বৃদ্ধের কাঠের মতো শক্ত শরীরটা বয়ে আনল ভিতরে। শরীরে প্রাণের চিহ্ন নেই।

একটা কাঁচের বাক্সে বৃদ্ধের শরীরটা শুইয়ে দিল সে। সুইচ টিপল। বৃদ্ধকে বাঁচিয়ে তোলাটা তেমন কঠিন হবে না। এই বাক্সের মধ্যে ক্রমশ এক হিটার শরীরটাকে গরম করে তুলবে, বুক মালিশ করবে, শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখবে। বাকি কাজটুকু করবেন গর্ভনগরের মহান চিকিৎসকবৃন্দ। সীমন্তক অবাক হয়ে দেখল। বৃদ্ধের মৃত মুখে একটু নির্মল আনন্দের হাসিও তার শরীরের মতোই জমে বরফ হয়ে আছে।

সীমন্তক কাঁচের বাক্সে শোয়ানো বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর আপন মনেই বলল –কেন বুড়োবাবা তোমরা একটু রোদ্দুরে দেখে অমন পাগলাপারা হয়ে ওঠো?

বৃদ্ধের শরীর আস্তে-আস্তে গরম হচ্ছে, প্রাণের চিহ্ন ফিরে আসছে। সীমন্তক জানে বুড়ো লোকটি বেঁচে উঠবে। তবে হয়তো এবার সত্যিই বুড়োর মগজ বদলে ফেলবেন ডাক্তাররা। কিছু কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বদলাতে হবে।

সীমন্তক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল–বেঁচে উঠবে বটে বুড়োবাবা, তবে হয়তো আর কোনওদিন রোদ্দুর দেখে আনন্দে হেসে উঠবে না।

কিন্তু যতক্ষণ না মগজ বদল হচ্ছে, যতক্ষণ না মৃত্যুর ছায়া সরে যাচ্ছে শরীর থেকে ততক্ষণ বৃদ্ধ এক অমলিন রোদ্দুর গিরগিটি, অরণ্য ও সবুজের স্মৃতির মধ্যে ডুবে থেকে হাসতে থাকেন।

১৬০ পঠিত ... ১৭:৫৭, এপ্রিল ২৮, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top