মুলতানের জলহাওয়ায় ভালো কাটছিলো খসরুর। কিন্তু মোঙ্গলদের একের পর এক হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলো শাসক খান মুহাম্মদ। অবশেষে মোঙ্গলদের হামলায় তার প্রাণহানি ঘটে। মুলতানের সুফিরা লড়তে থাকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। খসরু ফিরে আসে দিল্লিতে। খান মুহম্মদ স্মরণে দুটি শোকগাঁথা রচনা করে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়তে থাকে দিল্লি সালতানাতের সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন। বড় ছেলে খান মুহম্মদের মৃত্যুতে মুষড়ে পড়ে সুলতান। মেজো ছেলে বাংলার লখনৌতি সালতানাত ছেড়ে দিল্লিতে আসতে রাজি নয়। অস্থির সময়; অনিশ্চয়তার দোলাচল দিল্লি সালতানাতে।
শিল্প রসিক আমির আলী হাতিম খসরুকে একদিন বলে, চলো তোমায় অভধে নিয়ে যাই। হিমালয় আর গঙ্গা-যমুনার মাঝখানে সমৃদ্ধ এক জনপদ। সংস্কৃত রামায়ণের একটি কপি হাতে দিয়ে বলে, কী মহাকাব্যিক দ্যোতনা এতে। কোসালা রাজ্যের অযোধ্যার যুবরাজ রামকে নিয়ে বাল্মিকীর এই অমর সৃষ্টি। খসরু আকুল হয় অযোধ্যায় যেতে। ঠিক হয় ফায়েজাবাদে খ্যাতিমান সুফি কবি আযাদ বিলগ্রামি গৃহে আতিথ্য নেবে তারা।
ফারসি ভাষার কবি আবদ জলিল বিলগ্রামি গঙ্গা-যমুনার এই মিলন মোহনায় এসে কাব্যচর্চা শুরু করেছিলো। আযাদ সেই ধারার নতুন কবি। তারা দুজনেই রামায়নের ভক্তিরসে সিক্ত হয়ে মুসলমান শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরেছে এর আধ্যাত্মিকতার দিক। আবার হিন্দু শ্রোতা তাদের কাছ থেকে আরবি ও ফারসি সাহিত্যের সুধা পান করেছে। রাজা আসে রাজা যায়। কিন্তু ছোটখাটো মানুষেরা বেঁচে থাকে যেখানে যা কিছু সুন্দর তা গ্রহণ করে।
ফয়েজাবাদে খসরুর সম্মানে স্থানীয় কবিদের আমন্ত্রণ জানায় আযাদ বিলগ্রামি। জমে ওঠে আড্ডা। কথায় কথায় একজন প্রস্তাব দেয়, অযোধ্যায় সীতা কাহিনী নিয়ে একটি আখ্যান দেখতে যেতে। খসরু উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে।
লাল ইটের একটি মন্দিরকে পেছনে রেখে পৌরাণিক আবহে; সীতা কাহিনী মঞ্চস্থ হয়। সীতার অগ্নিপরীক্ষা দৃশ্যে খসরুর মনে গভীর অনুরাগ ও অনুযোগ তৈরি হয়। সীতার মুখচ্ছবিতে মা দৌলত নাজ, লখনৌতির দিল বাহার, পাতিয়ালির যাহরা নাজ, লাহোরের গুড়িয়াকে যেন দেখতে পায় সে। এই যে নারীজীবন; জগত সংসারে কত প্রেম-বিরহ-সন্তাপ-পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যেতে হয়; নারীকে। সে যেন ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা; নিসর্গের মতো সুন্দর। পুরুষতন্ত্র নিরাপত্তার কথা বলে তার চারপাশে লক্ষ্মণরেখা এঁকে দেয়। তবু কী নিরাপদ সে। সীতা কাহিনীতে রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করে; মনের মধ্যে অজানা আশংকা উঁকি দেয়; মোঙ্গলদের আক্রমণের পরে গুড়িয়ার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা কে জানে।
খসরু অশ্রুসিক্ত হয়। তাকিয়ে দেখে চারপাশের সবার চোখে অশ্রু। সে উঠে পড়ে। অযোধ্যা নগর জুড়ে মন্দির-মসজিদের গম্বুজ। প্রার্থনারত মানুষের চোখে আত্মসমর্পণের অশ্রু। খসরু ফিসফিস করে নিজেকে বলতে থাকে,
হার কউম রাস্ত রাহে, দীন-ই ওয়া কিবলা গাহে
মুন কিবলা রাস্ত কারদাম, বার সামত কাইকুলাহে
সংসার হার কো পূজায়ে কুল কো জগত সারাহে
মক্কামে কোই ঢুধে, কাশি কো কৌই যায়ে
গয়া মে আপনে পি কে পায়া পাদুন না কাহে
হার রাস্ত রাহে, দীন-ই ওয়া কিবলা গাহে
সব ধর্মের একটা বিশ্বাস আছে; কোনদিকে ঘুরতে হবে সে পথের দিশা আছে
আমি মুখ ঘুরিয়েছি এক প্রেমময় দিশার দিকে
গোটা পৃথিবী কাউকে না কাউকে উপাসনা করে
কেউ মক্কা খোঁজে, কেউবা কাশীতে যায়
আমি কেন পারি না! হে প্রজ্ঞাবান, প্রেমময়ের পায়ে পড়ো
সবধর্মের একটি বিশ্বাস আছে আছে দিশা।
খসরু দিল্লিতে ফিরে শোনে আশি বছর বয়সে মারা গেল বলবন। মেজ ছেলে বুঘরা খান তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলা থেকে দিল্লিতে না আসায় মনে বড় আঘাত পেয়েছে সে। ১২৮৭ সালে বলবনের মৃত্যুর পর তার নাতি মুইজ উদ দিন কায়কোবাদ মাত্র ১৭ বছর বয়সে দিল্লির সুলতান হয়। খসরু এসময় তার সঙ্গে কাজ করে। আর এরইমাঝে লিখে শেষ করে তার প্রথম মসনবি ‘কিরান উস সা'দাইন’ (দুই অনন্ত নক্ষত্রের দেখা) । সুলতান কায়কোবাদ তার শাসনকালে তার পিতা বাংলার শাসক বুঘরা খানের সঙ্গে মত বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে পিতা-পুত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। উভয়ের সেনাদলের দেখা হয় সরযু নদীর তীরে। পিতা-পুত্রের মাঝে চলতে থাকে মান অভিমানের অদৃশ্য দাবা খেলা কিছুটা সময়। অবশেষে বিনা রক্তপাতে সন্ধি হয়। এই সাক্ষাত পর্বটি নিয়েই খসরু তার দুই অনন্ত নক্ষত্রের দেখা লেখে।
১২৯০ সালে সুলতান কায়কোবাদ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে । প্রবীণেরা তার তিন বছরের সন্তান কাইয়ুমারসকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করে। বলবন শাসনের অবসান তখন সময়ের ব্যাপার। জালালুদ্দিন ফিরুজ খান নামে এক তুর্কী-আফঘান তার সেনাদল নিয়ে কুচকাওয়াজ করে দিল্লিতে প্রবেশ করে; কায়কোবাদকে হত্যা করে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করে। এইভাবে মামলুক বংশের শাসনের অবসান হলে শুরু হয় খিলজি বংশের শাসন।
ফিরুজ খিলজি কাব্য পছন্দ করতো। অনেক কবিকে তার রাজ দরবারে আমন্ত্রণ করা হয়। খসরুকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে তাকে ‘আমির’ উপাধি দেয়া হয়। এসময় খসরু তার গজল রচনায় মনোনিবেশ করে; সুরসংযোজন করে আর গায়িকাদের তালিম দিতে থাকে। চারিদিকে খসরুর সুখ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
প্রত্যেক রাতেই গজলের আসর বসে। সংগীতের সুর মূর্ছনায় প্রাসাদ জুড়ে খুশির রঙ ছড়িয়ে পড়ে। ফিরুজ খিলজি অপার মুগ্ধতায় খসরুকে বলে, হে আমির; সুর শব্দের সম্রাট! আপনার সৃষ্টিতে জীবনের গভীরের জীবন হঠাৎ আমাদের পাশে এসে বসে। অর্থহীন করে দেয় পার্থিব সব অর্জন। এক একটা গীতিকবিতার, সুরের আলাপে যে নিখুঁত সৃজনশীলতা; আহা আমাদের কাজগুলো যদি এমন সুচারু হতে পারতো।
খসরুর সুরের ছাত্রীরা তাকে ঘিরে বসে থাকে; ওস্তাদজীর জীবন পাত্রে খুশিজল ঢেলে দেয় এক একজন। অনিন্দ্য সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী সে গায়িকারা। তাদের মধ্যে আনন্দময় প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হয়; কে নিখুঁত সুরে গাইতে পারে; তাল লয়ের স্থিরতায় কার সংগীত বৃষ্টি আনতে পারে। খসরু কি প্রেমের নদী; প্রশ্ন করে মেঘবালিকা; যার কন্ঠে বৃষ্টির প্রার্থনা।
খসরু দরিয়া প্রেম কা,উল্টি ওয়া কি ধার
জো উতরা সো ডুব গ্যায়া, যো ডুবা সো পার
ও খসরু প্রেমের নদী
অদ্ভুত দিকবিদিক ছুটে যায়
যে ঝাঁপ দেয় সে ডুবে যায়
যে ডুবে যায় সে পার হয়
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন