প্রাইভেট প্রাকটিশ

২১১ পঠিত ... ১৭:০১, মার্চ ১১, ২০২৪

430489211_398949639503882_3492845266711690400_n

ডেরাডুন শহরটাকে পিছনে রেখে এগিয়ে যান চাক্ৰাতার রাস্তা ধরে। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় পাতলা হয়ে আসবে আর দূরের মুসৌরী পাহাড়টা আরো স্পষ্ট মনে হবে। ঐ যে কি একটা সিনেমা হলের কাছাকাছি কংক্রীটের ছোট্ট পুলটা পার হলেই ডেরাড়ুন শহরটাকে আর দেখা যাবে না।

আরো এগিয়ে যান। বেশি না, দুএক মাইল এগিয়ে গেলেই দূরের ফরেস্ট অনেকটা কাছে এগিয়ে আসবে। তারপর ছোটোখাটো দুটোএকটা কলকারখানা পড়বে। দাঁড়াবেন না। আরো একটু এগিয়ে যান। এই মাইলখানেক আর কি! ফাঁকা চাক্ৰাতা রোডের ওপর ছোটোখাটো দুচারটে দোকান চোখে পড়বে। চাপানবিড়িসিগারেটের দোকান। একটা দোকান থেকে বিবিধ ভারতীয় পচা হিন্দি গান আপনার কানে আসবে। কিছু লোককে আড্ডা দিতে দেখবেন। তবুও দাঁড়াবেন না।

এ বল্লুপুর পিছনে ফেলে সামান্য কয়েক পা এগিয়ে গেলেই এফআরআই ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক নম্বর গেট। খাকি উর্দি পরা রামবাহাদুরকে পাহারা দিতে দেখবেন। যদি প্রাইভেট গাড়ি করে যান, থামতে হবে না। আর যদি ট্যাক্সি বা অটো রিকশা করে যান, একটু থামুন। রামবাহাদুর একটা হলদে রঙের ছেঁড়া খাতা আর দেড় ইঞ্চি লম্বা একটা পেন্সিল এগিয়ে দেবে। ঐ খাতায় ট্যাক্সি বা অটোরিকশার নম্বর লিখে একটা দস্তখত দিন।

বল্লুপুরের এই গেট থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে এফআরআইএর কেন্দ্রবিন্দু। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের পিছনের ছোট্ট রাস্তাটাকে লাভার্স লেন বলে না? পদ্মপুকুরের ওদিকেও একটা ছোট্ট রাস্তার নাম লাভলক প্লেস। আসলে এফআর আইএর এই রাস্তাটাই প্রেমিক-প্রেমিকাদের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হওয়া উচিত ছিল। সত্যি কি সুন্দর এই রাস্তাটা! দুপাশে এফ-আর-আই এর নিজস্ব রিজার্ভ ফরেস্ট। ঐ ফরেস্টের মাঝখান দিযে পিচের রাস্তাটা লজ্জায় এঁকে বেঁকে পালিয়ে গেছে সেন্ট্রাল বিল্ডিংএর ওদিকে।

দুপাশে অত সুন্দর ফরেস্ট যে শুধু কিছু কোকিল ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না। হ্যাঁ, আর আছে কিছু বৌ কথা কও পাখি! এফআরআইএর এই ছোট্ট নিজস্ব শহর নিউ ফরেস্টে যারা বেশিদিন থাকেন, তাঁরা সাইকেল, মোটর, ট্যাক্সি বা অটো রিকশা করেই এই রাস্তা দিয়ে চলে যান। এই বিজননির্জন বনানীর আকর্ষণ তাদের নেই। কোকিলের ডাক বা বৌ কথা কও তাদের কানে যায় কিন্তু প্রাণে দোলা দেয় না।

কিন্তু নতুন যারা আসেন তারা বল্লুপুরের গেটে এসে ট্যাক্সি বা অটোরিকশা থেকে নেমে পড়েন। এই বনবীথিকা দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যান নিউফরেস্টের ঐ বাংলোগুলোর দিকে।

নিউ ফরেস্টের অফিসারের দল সপরিবারে এই রিজার্ভড় বেস্টে আসেন মাঝে মাঝে। বছরে দুতিনবার। তবে কোকিলের ডাক শুনতে নয়, পিকনিক করতে। মধু গন্ধে ভরা মৃদু মিছায়া নীপকুঞ্জে তলে বসে বসে লুচিআলুর দমচিকেনকারি আর চাটনি খাওয়া হয়। ফরেস্ট এদের কাছে মনের খোরাক নয়, ল্যাবরেটারির উপাদান মাত্র।

.

ব্যতিক্রম শুধু ডাক্তার।

ডাঃ বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জী।

ডাঃ ব্যানার্জী মাঝে মাঝেই আপন মনে ঘুরে বেড়ান এই শ্যামল বনানীর নির্জন পথে পথে। কোকিলের ডাক শোনেন, বৌ কথা কও পাখি খুঁজে বেড়ান গাছের ফাঁকে ফাঁকে, লতাপাতার আড়ালে।

নিউ ফরেস্টের কোনো অফিসারকে দেখলে ডাক্তার লজ্জা পান। ভীষণ লজ্জা পান। নিজের মনকে নিজেই লুকোতে হিমসিম খেয়ে যান। একটু সামলে নিয়ে বলেন, কী করব বলুন মিঃ সরকার? নিউ ফরেস্টের যে বাড়িতেই যাই না কেন, সেখানেই একটা একটা রুগী দেখতে হয়। প্রেসক্রিপশন লিখতে হয়। সব সময় কি ভালো লাগে?

একটু থেমে, একটু হেসে ডাক্তার বলেন, তাইতো মাঝে মাঝে সময় পেলে এদিকে একটু ঘুরতে আসি। এখানে কেউ প্রেসক্রিপশন লিখতে বলে না।

মিঃ সরকার হো হো করে হেসে উঠে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে যান ওদিকে। মনে মনে ভাবেন, ছোঁকরা বয়স, তারপর এইতো সেদিন এলোয় আরো কিছুদিন থাকলে এসব কবিত্ব কোথায় পালিয়ে যাবে।

ডাক্তারের ভাবতে অবাক লাগে। সত্যি নিউ ফরেস্টের মানুষগুলো যেন কেমন কেমন! নিউ ফরেস্টের মধ্যে এবা কি আশ্চর্যভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এত বড় হিমালয়ের কোলে থেকেও এদের জীবন কত সীমাবদ্ধ। সকাল সাড়ে নটা আর বিকেল সাড়ে চারটের সাইরেনের পরও এরা মুক্তি পায় না, মুক্তি পেতে পারে না, মুক্তি পেতে জানে না। সন্ধ্যার পর একটুআধটু মজলিস বসে, কিন্তু সেখানেও ট্রান্সফার প্রমোশনইনক্রিমেন্টের গল্প। অথবা টুরের কথা। অথবা পুরনো অফিসারের নিন্দা।

মেয়েরা?

নিউ ফরেস্টে মেয়ে কোথায়? মিঃ মুখার্জীর দুটি মেয়ে ছাড়া নিউ ফরেস্টে মেয়ে নেই, সবাই বিবাহিতা, সবাই গৃহিণী। সাড়ে সাতটার মধ্যে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে স্বামীকে ব্রেকফাস্ট দিতে দিতেই সকালবেলার মেয়াদ শেষ হয়। তারপর স্বামীকে লাঞ্চ খাইয়ে ছেলেমেয়েদের তদারক করতে করতেই সাড়ে চারটের সাইরেন বিকট আর্তনাদ করে বেজে ওঠে। স্বামীকে চা দিতে না দিতেই সূর্য নিউ ফরেস্ট থেকে পালিয়ে যায়। তারপর আবার সংসার, চাল-ডাল-আটা-ময়দার কোরাস।

সন্ধ্যার পর একটু মেলামেশা। একটু গল্পগুজব। হয়তো বা একটু হাসিঠাট্টাতামাসা। তারপর নিউ ফরেস্ট ঘুমিয়ে পড়ে। একটি একটি করে বাংলোর আলোগুলো নিভে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।

সবাই?

না, সবাই না। মিঃ মুখার্জীর ড্রইংরুমে দুটি একটি ব্যালির মৌমাছি মধুর গন্ধে অথবা কিছু খোস গল্প করে অনেক রাত অবধি। আর ফরেস্ট কলেজের হোস্টেলের পাশের বাংলোয় মিঃ পটাশকারের ড্রইংরুমে আলো জ্বলে। তবে বড় আলোটা নয়, ছোট আলোটা। নাইট ল্যাম্পটা। হোয়াইট হর্সের শেষ বিন্দু গলায় ঢেলে দেবার পর নাইট ল্যাম্পটাও আর নজরে পড়ে না।

তারপর নিউ ফরেস্টে ঘুমিয়ে পড়ে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ে?

.

না। স্বামীর পাশে শুয়ে থাকেন কিন্তু ঘুম আসে না অমিতাবৌদির। দূরের মুসৌরী পাহাড়ের আলোগুলো যেন হাতছানি দিয়ে অমিতাবৌদিকে ডাকে। নিউ ফরেস্টের ঐ বন্দিনী জীবনে ঐ দূরের আলো কত মিষ্টি, কত মনোরম, কত প্রিয়, কত আকর্ষণীয় মনে হয়। দূরের মুসৌরী পাহাড়ের আলোর মালার মতো ডাক্তারের হৃদয়দীপের আলোও যেন অমিতাবৌদিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

ডাক্তার?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাঃ বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জী। আমাদের ডাক্তার। নিউ ফরেস্টের মেডিক্যাল অফিসার।

আশ্চর্য হবার কি আছে? অমিতাবৌদি মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। আঠারো বছরে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে আইএ পাস করার পর স্বামীর হাত ধরে প্রথম যেদিন নিউ ফরেস্টে এসেছিলেন, সেদিন তার চোখে ছিল অনেক আশা, ছিল অনেক স্বপ্ন। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের সব শিক্ষিতা মেয়েই যেমন স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের। শিক্ষিত ভদ্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে স্বপ্ন দেখবে না? নিশ্চয়ই দেখবে কিন্তু ঐ লাল বেনারসীর মেয়াদ যে কত সীমিত তা ভাবতে পারে না স্বপ্নাতুর ভরাযৌবনাদের দল। স্বামীর একটু ছোঁয়া, একটু স্পর্শ, একটু আদর, একটু আলিঙ্গন মেয়েদের দেহে বন্যা আনে, মনে স্বপ্ন আনে।

তারপর?

তারপর বিনাইঞ্জিনের গ্লাইডারের মতো হঠাৎ আকাশে ভাসতে থাকে, উড়তে থাকে। মাটির পৃথিবী থেকে একটু উপরে গিয়েই পাগল হয় সদ্যবিবাহিতা, সদ্যপ্রস্ফুটিতার দল। কিন্তু বিনাইঞ্জিনের গ্লাইডার কতক্ষণ উড়বে? নেমে আসে মাটিতে, মাটির পৃথিবীতে। বারো বছর আগে এমএসসি পাস স্বামীর সঙ্গে যেদিন অমিতাবৌদি হাওড়া থেকে ডুন এক্সপ্রেসের কুপেতে চড়েছিলেন, তখন মনে করেছিলেন হাতে স্বর্গ পেলেন।

স্বর্গ?

স্বর্গ বৈকি। বৈঠকখানায় তিনখানা ঘরের বাড়িতে পাঁচ ভাইবোন আর বাবামা। মিত্র স্কুলের মাস্টারি আর দুটো টিউশনিব পঞ্চাশ টাকার মধ্যে সাতটি প্রাণীর সংসার চলত। থামত না ঠিক কিন্তু বনগাঁ লোকালের মতো থামতে থামতে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে চলত। কলকাতার বারো আনা লোকের সংসার যেমন চলে, অমিতাবৌদিদের সংসারও ঠিক তেমনি চলত। পাঁচপাঁচটি ভাইবোনকে স্কুলকলেজে পড়াতেই বাবার জান বেরিয়ে যেত।

সখ-আনন্দ? মীর্জাপুরের প্রতিমাদের বাড়ি যাওয়াই ছিল একমাত্র আনন্দ। প্রতিমাদের বাড়ির ছাদে উঠে একটু দূরের আকাশ দেখাই ছিল অমিতাবৌদির নিত্যকার চিত্তবিনোদনের একমাত্র সূত্র। আর কদাচিৎ কখনও এক টাকা চার আনা দিয়ে পূরবীতে সিনেমা দেখা।

ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হবার পর দৃষ্টিটা একটু পালটে গিয়েছিল। মনে রঙ লেগেছিল। দেহের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে মঞ্জরী দেখে অমিতাবৌদি নিজেই চমকে উঠেছিল। আশপাশের সবার থেকে নিজেকে একটু স্বতন্ত্র, একটু অনন্যা মনে হয়েছিল।

নিজেকে নিজের ভালো লাগত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সুযোগ কোথায়? তাইতো ঐ সিঁড়ির তলার কলকাতায় স্নান করতে গিয়ে অমিতাবৌদি নিজেকে দেখত। ভালো করে দেখত। সর্বাঙ্গ দেখত। অকারণে হাসি ফুটে উঠত নিজের মুখে।

আমহার্স্ট স্ট্রিট-মীর্জাপুর দিয়ে কলেজে যাবার সময় শুদ্ধানন্দ পার্কের কাছাকাছি প্রায়ই দেখা হত অশোকদার সঙ্গে। ছোটবেলার বন্ধু মিতালীর দাদা অশোক। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। অমিতাবৌদির সঙ্গে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তবুও শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের কাছে এসে অশোকদার সঙ্গে ঐ দেখাটুকুই ভালো লাগত। তখন যে ভালো লাগার বয়স।

কলেজের অন্য অনেক মেয়ের জীবনে বসন্ত এসেছিল। ওদের বসন্তে ভ্রমরগুঞ্জনের কথা শুনত অমিতাবৌদি। ভালো লাগত উপন্যাসের নায়িকাঁদের জীবনকাহিনি শুনতে। হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে তারও মনে মনে ইচ্ছা হতো নায়িকা হতে। ভালোবাসতে, ভালোবাসা পেতে। বহুর থেকে দূরে গিয়ে অনন্যা হতে।

.

সুধীরবাবুর সঙ্গে যেদিন ডুন এক্সপ্রেসে চাপল, তখন সে অনন্যা হয়েছিল। দুটি রাত্রের সে সফর যেন অনন্যার অভিষেক হয়েছিল। দেহে, মনে নতুন ঐশ্বর্যের স্বাদে ভরে উঠেছিল অমিতাবৌদির জীবন। জোয়ারের জল যে একদিন সরে যাবে, ভরা নদী যে একদিন শুকিয়ে যাবে, সেদিন অমিতাবৌদি ভাবতে পারেনি। কেউই পারে না।

দিনে দিনে, তিলে তিলে সুধীরবাবু যেন ল্যাবরেটরির মাইক্রোস্কোপের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। সাড়ে নটা আর সাড়ে চারটের সাইরেনের মধ্যে মাইক্রোস্কোপের তলায় গাছের সেল পরীক্ষা করতে করতে অমিতবেদির মনের সেল দেখতে ভুলে গেলেন। সুখী, সাধ্বী অমিতাবৌদির জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অনন্যা অমিতাবৌদির মৃত্যু হল। রঙিন নিউ ফরেস্ট হারিয়ে গেল। চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল। স্বামীর দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালোবাসার ফাঁক দিয়ে কবে, কখন কেমন করে হারিয়ে গেল অমিতাবৌদি নিজেও তা টের পেল না।

সুধীরবাবু কি পালটে গেছেন? বিন্দুমাত্র না। পৃথিবীর অন্য সব স্বামীর মতো তিনিও ছন্দা পড়াশুনা সেরে ঘুমিয়ে পড়লে অমিতাবৌদিকে কাছে টেনে নেন। আদর করেন, ভালোবাসেন। রাতের অন্ধকার আরো গাঢ় হলে, নিউ ফরেস্ট ঘুমিয়ে পড়লে সুধীরবার অমিতাবৌদিকে আরো আরো অনেক কাছে টেনে নেন। ডুবে যান, হারিয়ে যান অমিতাবৌদির মধ্যে! তাও কি রোজ? সপ্তাহে দুএকদিন। ঐ দুএকদিনই সুধীরবাবু আবার সেই বারো বছর আগের ডুন এক্সপ্রেসের যাত্রী হন।

অমিতাবোদির ভালো লাগে। বেশ ভালো লাগে। ডুন এক্সপ্রেসের কুপেতে চড়তে তার বড় আনন্দ হয়, বড় তৃপ্তি লাগে। কিন্তু ঐ রাতের অন্ধকারে যখন ডুন এক্সপ্রেস থেমে যায়, যখন একটি সপ্তাহের মতো সিগন্যাল ডাউন না পেয়ে ডুন এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে থাকে, তখন অমিতাবৌদির কানে ঐ সর্বনাশা কোকিলেব ডাক ভেসে আসে। হয়তো শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের মোড়ের আশোকদার কথা মনে পড়ে। হয়তো মনে মনে সন্দেহ হয়, একি ভালোবাসা? নাকি কর্তব্য? অভ্যাস? নাকি শুধু প্রয়োজন?

ঠিক বুঝতে পারে না অমিতাবৌদি। ভাবে সবারই কি এক ইতিহাস? সবাই কি শুধু অভ্যাস-কর্তব্য-প্রয়োজনের ত্রিসীমানার মধ্যে বন্দিনী? এর চাইতে বেশি কি পাওয়া যায় না? এর চাইতে বেশি পাবার কি অধিকার নেই? প্রয়োজন নেই?

অমিতাবৌদি চায় অনন্যা হতে। স্বপ্ন দেখে তার স্পর্শ, তার ভালোবাসা, তার হাসি, তার চোখের দৃষ্টি মাতাল করবে, পাগল করবে তার প্রাণের পুরুষকে। আর আর সেই প্রাণের পুক দায়িত্ব, কর্তব্য, অভ্যাসের দাস হয়ে ডন এক্সপ্রেসের কুপেতে সফর করবে

তবে?

তবে আবার কি? অমিতাবৌদি অনন্যা হবে। অন্তত একটি মানুষের জীবনে সে অনন্যা, অদ্বিতীয়া হবে। শুধু নিদ্রাহীন রাতে নিঃসঙ্গ হয়ে নয়, প্রতি দিন, প্রতি রাত্রে দুজনে মিলে শুনবে কোকিলের ডাক। শুনবে, বৌ কথা কও।

সকালবেলায় দিনের আলোয় অমিতাবৌদির স্বপ্ন হারিয়ে যায়, পালিয়ে যায়। সত্যি? নাকি লুকিয়ে পড়ে?

দুটোর সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সুধীরবাবু লাঞ্চ খেয়ে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে তার মাইক্রোস্কোপের ফোকাস ঠিক করতে শুরু করেন! সে লেন্সের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীব অসংখ্য সব গাছপালার অন্তরের কথা জানা যায়; কিন্তু অমিতাবৌদি তখন আউট অফফোকাস হয়ে যান। ঐ সুন্দর বাংলো বাড়ির বারান্দায় বা লনের পাশে গার্ডেন চেয়ারে বসে সুধীরবাবুর পুলওভার বুনতে বুনতে অমিতাবৌদির আবার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা রাতের কথা। স্বপ্নের স্মৃতি। আপন মনে নিজেই হেসে ওঠে পাগলামিরও একটা সীমা থাকা উচিত। তাই না? নিশ্চয়ই। অমিতাবৌদি নিজেই নিজেকে শাসন করেন। হাতের কাঁটা দুটো যেন একটু দ্রুত চলে।

.

রাত্রে খাবার সময় সুধীরবাবু একটু যেন রেগেই বলে উঠলেন, এতদিন ধরে বুকে ব্যথা, বুকে ব্যথা বলছ অথচ ডাক্তার দেখাবে না কেন বলতে পার?

ছন্দার খাওয়া হয়ে গেছে। সে ভিতরের বেসিনে হাত ধুতে যায়। সুধীরবাবু বামহাত দিয়ে কাছে টেনে নেন অমিতাবৌদিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ফিরে যান অতীতে। সেই বারো বছর আগে।

অমিতাবৌদির বেশ ভালো লাগে। মুহূর্তের জন্য তিনি যেন অনন্যা, অদ্বিতীয় হন। বলেন, আঃ ছেড়ে দাও। ছন্দা দেখবে।

সুধীরবাবু বোধহয় মাইক্রোস্কোপের লেন্সের ভিতর অমিতাবৌদির মনের সেল দেখতে পান। কি যেন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, অমিতাবৌদির দিকে, নিশ্বাসটাও যেন একটু ঘন, একটু গরম হয়। সুধীরবাবু কেমন যেন একটু পাগলামী শুরু করেন।

অমিতাবৌদির ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে। দেহ মনে পদ্মার মাতলামী দেখা দেয় লুকিয়ে লুকিয়ে। সর্বাঙ্গে যেন শিহরণ দেখা দেয়, কানে ভেসে আসে কোকিলের ডাক।

পরের দিন সকালে অফিস গিয়েই সুধীরবাবু ডাক্তার ব্যানার্জীকে টেলিফোন করলেন, ডাক্তার সাহেব, এই মাইক্রোস্কোপ আর ঘরের গিন্নি ঠিক না থাকলে বাঁচব কি করে?

ডাক্তার হেসে বলে, কোনটা ধর্মঘট করল? মাইক্রোস্কোপ না গিন্নি?

মাইক্রোস্কোপ হলে কি আর এই সাত সকালে ফোন করতাম? গিন্নি, ডাক্তার গিন্নি। কুইন এলিজাবেথ দি থার্ড!

কি হল কি?

কি হল তা বুঝলে তো নিজেই চিকিৎসা করতে পারতাম। কিছু কাল ধরেই বলছে বুকে ব্যথা, অথচ চিকিৎসা করবে না।

তাহলে আমি আর কি করব?

সুধীরবাবু এবার রসিকতা করে বলেন, ভায়া, সুন্দরী গিন্নির বুকে ব্যথা। সহ্য করতে পারলাম না। কাল অনেক কাণ্ড করে রাজি করিয়েছি।

ডাক্তার একটু ব্যস্ত ছিল। বলল, এক্ষুনি তো পারছি না। লাঞ্চের পর গেলে কি অসুবিধা হবে?

লাঞ্চে এসে সুধীরবাবু বলে গেলেন, ডাক্তার আসবে। সব কথা বোলো, কিছু লুকিয়ে চেপেটেপে রেখো না!

.

ডাক্তার এসেছিল। তবে লাঞ্চের পরেই আসতে পারেনি। আসতে আসতে প্রায় চারটে হয়েছিল।

সুধীরবাবুর জন্য রোজ কাটলেট বানাতে শরীরটাই খারাপ করে ফেললেন?

অমিতাবৌদি হাসে। অর্ধসমাপ্ত পুলওভারটা ছোট্ট টিপাইএর উপর রেখে ভিতরে যান। ড্রইংরুমে।

ডাক্তার বলল, শুয়ে পড়ুন। একটু পরীক্ষা করে দেখি কত কাটলেট খাইয়েছেন।

শোবার ঘরে অমিতাবৌদি শুয়ে পড়েন। ডাক্তার পাশে বসে চেয়ারটা টেনে নিয়ে চুপচাপ দেখেন কিছুক্ষণ।

বাঁ হাতটা দিন।

অমিতাবৌদি বাঁ হাত বাড়িয়ে দেন। ডাক্তার ঘড়ির কাটার সঙ্গে মিলিয়ে পালস পরীক্ষা করেন।

অমিতাবৌদি জোরে জোরে নিশ্বাস নেন। বুকটা একটু বেশি ফুলে ফুলে ওঠে। বোধহয় একটু লজ্জা করে। দৃষ্টিটা সরিয়ে ঘুরিয়ে নেন বাইরের দিকে।

ডাক্তার নাড়ী দেখে। কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে দৃষ্টিটা আটকে যায়। অমিতাবৌদির হৃদয় স্পন্দন দেখে ডাক্তার হয়তো একটু ভালো লাগে, মনে রং লাগে। না, না, ওসব কিছু না। ছাত্রজীবনে ওসব হতো। আজকাল আবার এসব দুর্বলতা কি? তিনবছর বিয়ের পরও কি এসব দুর্বলতা কারুর থাকে? ডাঃ বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জীরও নেই।

কিন্তু তবুও মুহূর্তের জন্য ভালো লেগেছিল ডাক্তারের। অমিতাবৌদির হৃদয়স্পন্দন দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, সুধীরবাবু সত্যি ভাগ্যবান।

পালস্ দেখা হয়ে গেল। ডাক্তার অমিতাবৌদির হাতটা নামিয়ে রাখে।

বুকে ব্যথা করে আপনার?

হ্যাঁ।

কোথায়? বাঁ দিকে না ডান দিকে?

বাঁ দিকে।

সব সময় ব্যথা করে?

হ্যাঁ, প্রায় সব সময়েই।

কম না বেশি?

মাঝে মাঝে খুব বেশি ব্যথা করে।

ডাক্তার স্টেথো বের করে। চেস্টপিস দিয়ে অমিতাবৌদির বুক পরীক্ষা শুরু করে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে। ডাক্তার কেন যেন একটু চিন্তিত হয়। ভ্রূ দুটো কুঁচকে ওঠে।

একটু জোরে জোরে নিশ্বাস নিন

অমিতাবৌদি জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। বুকটা ফুলে ফুলে উপরে ওঠে, নীচে নামে।

স্টেথোর চেস্টপিস কখনও পুরা পাশে, কখনও ব্রেস্টের পাশে ঘোরাঘুরি করে ডাক্তারের হাতটাও ঘুরে বেড়ায়। একটু এদিকওদিক লাগে বৈকি!

অমিতাবৌদির লজ্জা করে। চুপ করে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। শুধু দৃষ্টিটা বাইরের আকাশে ভেসে বেড়ায়। ডাক্তারের স্পর্শে কি মন একটু চঞ্চলা হয়? না না, তা হবে কেন?

ডাক্তার তো পরীক্ষা করবেই।

ওপাশ ফিরে শোন

অমিতাবৌদি ওপাশ ফিরে শোন। ডাক্তার পরীক্ষা করে চলে। ডাক্তারের ভ্রূ দুটো কুঁচকে ওঠে। কপালে যেন কয়েকটা চিন্তার রেখা দেখা দেয়।

উপুড় হয়ে শোন তো।

অমিতাবৌদি উপুড় হয়ে শোন। ডাক্তারের পরীক্ষা এগিয়ে চলে। পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তার বুঝিবা মুহূর্তের জন্য অমিতাবৌদির সর্বাঙ্গের উপর দিয়ে দৃষ্টিটা বুলিয়ে নেয়। বাঃ বেশ তো!

ডাক্তারের কথায় অমিতাবৌদি আবার চিৎ হয়ে শোন। স্টেথো নামিয়ে রেখে এবার হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। দুপাশের প্লুরার কাছে দুটো হাত দিয়ে জোর করে চেপে ধরে ডাক্তার।

খুব জোরে নিশ্বাস নিন।

খুব জোরে নিশ্বাস নিতে গিয়েই অমিতাবৌদি হঠাৎ বলেন, আঃ ভীষণ লাগছে।

কোথায়?

এইতো বাঁ দিকটার এইখানে।

ডাক্তার এবার দুটো আঙুল দিয়ে বাঁ দিকের নানা জায়গায় আঘাত করতে থাকে।

ব্যথা লাগলেই বলবেন।

 

ডাক্তার জেনে নেয় কোথায় ব্যথা।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে ডাক্তার বড় যত্ন করে পরীক্ষা করল। বড় ভালো লাগল অমিতাবৌদির।

দুজনে বেরিয়ে এসে বাইরের গার্ডেন চেয়ারে বসে।

এতদিন আমাকে খবর দেননি কেন? কাটলেট খাওয়াতে হবে বলে?

অমিতাবৌদি একটু হাসেন। বড় সুন্দর হাসি। ঢলে পড়া সূর্যের মতো মিষ্টি আলোয় ভরে যায় মুখখানা। বললেন, এমনি।

খুব বেশি পরিশ্রম করেন?

না, তেমন কি। সাধারণ সংসারে সবাই যেমন করে…

কোনোদিন হঠাৎ কোথাও পড়ে গিয়েছিলেন বা বুকে আঘাত লেগেছিল?

একটু ভাবেন অমিতাবৌদি। একটু দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে একটু ঠোঁটটা কামড়ান মুহূর্তের জন্য। বলেন, দিন পনেরো আগে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।

পড়ে গেলেন কীভাবে?

সারান দিয়ে স্নান করছিলাম। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলাম।

ডাক্তার একটু রসিকতা করেন। এখনও সারান দিয়ে স্নান করতে পারেন না?

দুজনেই একটু হাসে

বুকে চোট লেগেছিল?

ঠিক বুকে কোনো চোট লাগেনি কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন খচ করে উঠেছিল!

তারপর থেকেই বুকে ব্যথা তাইতো?

হ্যাঁ।

ডাক্তার আরো খোঁজখবর নেয়। শরীরের যত্ন করেন না কেন?

আর কি যত্ন করব?

অনেক দিন ধরে খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেন না, তাই না?

অমিতাবৌদি একটু হাসে। ভাবে খাওয়াদাওয়া তো রোজই আছে। কিন্তু একলা একলা কি খেতে ভালো লাগে? তাছাড়া কে খোঁজ করে আমার খাওয়াদাওয়ার? ডাক্তারকে বলেন, কেন? খাওয়াদাওয়া তো ঠিক মতোই করি।

কেন লুকোচ্ছেন? এবার আমি যখন নিজে খাইয়ে দেব, তখন দেখবেন মজাটা।

অমিতাবৌদি ভেতরে চলে যান। একটু পরে এক কাপ কফি আর দুটো ফ্রেঞ্চ টোস্ট নিয়ে আসেন।

স্বামীকে কাটলেট খাইয়ে তো একটা বুকে ব্যথা করেছেন। এবার আমাকে খাইয়ে আর একটা বুকে ব্যথা করবেন?

এবার অমিতাবৌদিও একটু রসিকতা করেন। স্বামীকে সেবা করে বুকে ব্যথা করেছি, আপনাকে সেবা করে সে ব্যথা সারিয়ে নেব।

সে বিশ্বাস আছে আপনার?

নিশ্চয়ই। তা নয়তো কি এত খাতির করতাম?

কফির পেয়ালা, প্লেট নামিয়ে রেখে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে, বুকে ব্যথা হবার পর থার্মোমিটার দিয়ে টেম্পারেচার দেখেছেন?

থার্মোমিটার দিইনি, তবে মাঝে মাঝে গাটা গরম মনে হয়।

শোবার সময় কোন দিকে ফিরে শুতে ভালো লাগে?

বাঁ দিকে ফিরে শুলেই যেন একটু ভালো লাগে।

.

সাড়ে চারটের সাইরেন বেজে উঠল! কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুধীরবাবু আসেন। অমিতাবৌদি আবার কফি করতে ভেতরে চলে যান।

কি দেখলেন ডাক্তার?

আই থিঙ্ক ইট ইজ এ কেস অফ ড্রাই প্লুরিসি।

তাই নাকি? সুধীরবাবু একটু চিন্তিত হন।

চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে আপনাকে কয়েকটা কাজ করতে হবে।

কি বলুন।

নিয়ম হচ্ছে কমপ্লিট রেস্ট ইন বেড। যদি সেটা নিতান্তই অসম্ভব হয় তাহলে অন্তত ওঁকে দিয়ে রান্নাবান্না করানো বন্ধ করতেই হবে।

সুধীরবাবু যেন একটু স্বস্তি পান। সেটা বিশেষ মুশকিলের কিছুই নয়। আমার একটা ছোকরা চাকর আছে। সে মোটামুটি ভালোই রান্না করে।

সেকেন্ডলি, বেশ ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু খেলে তো? এক কাপ দুধ খেতে বললেই ফাটাফাটি হয়ে যায়।

ছেলেমানুষি করলে তো চলবে না। এবার খেতেই হবে।

অমিতাবৌদি দু কাপ কফি নিয়ে আসেন।

সুধীরবাবু বললেন, নিজের কানে ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে শুনে নাও কি কি করতে হবে।

অমিতাবৌদি উড়িয়ে দেন কথাটা, যা সম্ভব তাই শুনব।

এবার ডাক্তার মুখ খোলে, ওসব ছেলেমানুষি ছেড়ে দিন।

পরের দিন অমিতাবৌদির চেস্ট এক্সরে হলো। রক্তের ডিফারেনসিয়াল কাউন্ট আর ইএসআর দেখা হল।

ডাক্তার সুধীরবাবুকে জানিয়ে দেয়, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। লেফট প্লুরায় বেশ খানিকটা প্যাঁচ হয়েছে।

.

অমিতাবৌদি শুয়ে পড়লেন বিছানায়। চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল।

কে জানত তখন, এ শুধু প্লুরিসির চিকিৎসা নয়?

ডাক্তার রোজ সকালের দিকে আসে ড্রাই-হাইড্রো স্ট্রেপটোমাইসিন ইনজেকশন দিতে। কোনদিন দশটা, কোনদিন আবার এগারোটায় আসে।

প্রথমে বুকের মুভমেন্ট পৰীক্ষা করেন। তারপর প্যালপেসন দেখেন। হুঁ, এখনও বেশ ঘড়ঘড়ানি আওয়াজ। ঠিক যেন বেড়ালের মতো। তারপর পারকাসান। আঙুল দিয়ে টোকা মেরে পরীক্ষা করেন। আওয়াজটাও ঠিক একই রকম আছে। তারপর স্টেথো বের করেন। ইয়ারপিস কানে দিয়ে চেস্টপিসটা ঘুরে বেড়ায় অমিতাবৌদির সারা বুকে।

রোগশয্যায় শুয়ে থেকেও অমিতাবৌদির যেন একটু ভালো লাগে, শরীরে যেন একটু রোমাঞ্চ লাগে। মনে যেন একটু দোলা লাগে। ডাক্তারকেও যেন একটু ভালো লাগে।

ডাক্তার সিরিঞ্জ বের করে। স্পিরিট দিয়ে মুছে নেয়। ইনজেক্শন বের করে, ডিসটিল্ড ওয়াটারের ফাইল বের করে। সিরিঞ্জে ইনজেকশন ভরে নেয়।

নিন, কোন্ হাতে দেব?

গলা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে ব্লাউজের বোতামগুলো খুলে দেন অমিতাবৌদি। তারপর অর্ধেক ব্লাউজ খুলে ডান হাতটা বের করে দেন।

ডাক্তার ডান হাতের উপরের মাংসপেশীতে স্পিরিটের তুলোটা বুলিয়ে নিয়ে ইনজেকশন দেন।

অমিতাবৌদি একবার আর্তনাদ করেন, আঃ মরে গেলাম।

ডাক্তার সিরিঞ্জটা বের করে নিয়ে দুচার মিনিট ম্যাসেজ করে দেয়।

অমিতাবৌদির সব ব্যথা সেরে যায়।

এফআরআই এর প্রেসিডেন্টের স্ত্রীকে দেখে ফেরার পথে ডাক্তার রাত্রের দিকে আর একবার আসে। সুধীরবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, কি গিন্নী ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছেন তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অমিতা সব কথা শুনছে।

পরের দিন ডাক্তার আসতে পারে না। কম্পাউডার এসে ইনজেকশন দিয়ে যায়। অমিতাবৌদির কেমন যেন একটু বিশ্রী লাগে।

পরের দিন ডাক্তার এলে অমিতাবৌদি জিজ্ঞাসা করেন, কাল এনেন না যে?

আসবো কেমন করে? শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা করলেন। রাজা দুষ্মন্তের তদারক করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় শালাবাবু আর শকুন্তলাকে ট্রেনে চড়িয়ে দিতে হয়েছে।

অমিতাবৌদি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনার খাওয়াদাওয়ার কি হবে?

মুখার্জী বৌদির ওখানে নন পেয়িং গেস্ট হবার ব্যবস্থা হয়েছে। কাল রাতেই ওপেনিং সেরিমনি হল।

দশদিনে অমিতাবৌদির বুকের ব্যথা বেশ কমে গেল কিন্তু রোজ রোজ ইনজেকশন নিতে হাতের ব্যথা বেড়ে গেল।

হাতে না নিলে কোমরে নিন।

কোমরে? একটু লজ্জা একটু সঙ্কোচ যেন ঘিরে ধরে অমিতাবৌদিকে। একটু এগিয়ে, একটু পিছিয়ে যায়। হাত দুটো ব্যথায় বিষ হয়ে গেছে। না, না কোমরেই ভালো।

অমিতাবৌদির শাড়ির বাঁধন, সায়ার বাঁধন খুলে একটু নীচে নামিয়ে দেন। মুখটা একটু ঘুরিয়ে নেন ওপাশে।

স্পিরিটের তুলোটা বুলোত বুলোতে যেন ডাক্তারের হাতটা একটু কেঁপে ওঠে, একটু যেন থমকে দাঁড়ায়।

অমিতাবৌদি টের পান। তবে কি ডাক্তারেরও!

ইনজেকশন দেবার পব স্পিবিটের তুলোটা দিয়ে ডাক্তার একটু ম্যাসেজ করে। একটু বেশি সময় ম্যাসেজ করল না? তুলোটা ফেলে দিয়ে এবার হাতের তালু দিয়ে আরো একটু ম্যাসেজ করে ডাক্তার।

অমিতাবৌদির দেহটা একটু দূলে দূলে নড়ে ওঠে।

ডাক্তারের কি একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল?

সিরিঞ্জ খুলতে খুলতে ডাক্তার হঠাৎ প্রশ্ন করে কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনার?

বারো বছর।

বারো বছর? তাহলে খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে আপনার?

আঠারো বছরে।

চিকিৎসা এগিয়ে চলে। অমিতাবৌদি আর ডাক্তার এগিয়ে চলে নিয়তির দিকে।

দুসপ্তাহ হয়ে গেল। দুজনে এখন অনেক সহজ অনেক সরল। রাতের বেলায় দুজনেই শুয়ে শুয়ে কোকিলের ডাক শোনে।

আর কতদিন শুয়ে থাকব ডাক্তারবাবু?

ডাক্তারবাবু অমিতাবৌদির কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, কোন কষ্ট হচ্ছে?

অমিতাবৌদির দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অন্যমনস্ক হয়েই একটা হাত ডাঙারের হাতের পরে চলে যায়।

ডাক্তার আবার প্রশ্ন করে, কোন কষ্ট হচ্ছে?

অমিতাবোদি মুখে কিছু বলে না। মাথা নেড়ে বলে, না না, কষ্ট হবে কেন?

ডাক্তার একটু অমিতাবোদির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। অমিতাবৌদি যেন দেহের বাঁধনটা একটু ঢিলা করে ডাক্তারকে আদর করতে আমন্ত্রণ জানান। দুজনেরই নিশ্বাসটা যেন একটু ঘন হয়।

অমিতাবৌদি দুটো হাত দিয়ে ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরেন।

সন্ধ্যার সময় ডাক্তার ঐ বল্লুপুরের যাবার রাস্তায় একলা একলা ঘুরে বেড়ায়। কোকিলের ডাক শোনে, বৌ কথা কও পাখি খুঁজে বেড়ায়।

অমিতাবৌদি লনে গার্ডেন চেয়ারে বসে সুধীরবাবু পুলওভারটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে চায়। পারে না। হাতটা থেমে যায়। কোকিলের ডাক কানে আসে।

তিন সপ্তাহ ধরে রোজ রোজ ইনজেকশান দেওয়া হল, একটা কোর্স শেষ হল, ডাক্তার ও অমিতাবৌদির একটা অধ্যায় শেষ হলো।

.

টেম্পারেচার আর বুকের ব্যথা চলে গেল। এখন আর রোজ ইনজেকশন নয়, একদিন অন্তর একদিন।

ডাক্তার আসে, নিশ্বাস নেবার সময় বুকের মুভমেন্ট দেখে, প্যালপেসান দেখে, পারকাসান দেখে, স্টেথো দিয়ে অস্কালটেশান দেখে, না, না, অনেকটা ভালো, তারপর ডাক্তার ইনজেকশন দেয়। কোনোদিন হাতে, কোনোদিন কোমরে।

তারপর?

তারপরও ডাক্তার থাকে কিছুক্ষণ, অমিতাবৌদির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনও বা হাতটা এদিকওদিক চলে যায়।

তারপর?

তারপর অমিতাবৌদি ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরে। গালের পাশে চেপে ধরে।

শেষ ইনজেকশন দেবার দিন আরো একধাপ এগিয়েছিল দুজনে। চাকরটা ক্যান্টিনে গিয়েছিল ডিম কিনতে, অমিতাবৌদি ডাক্তারকে বিদায় জানাবার জন্য ড্রইংরুমের দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন। ডাক্তার আর পারেনি। কাছে, বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল অমিতাবৌদিকে।

আর?

আর অমিতাবৌদির ঠোঁটে রেখে গিয়েছিল নিজের স্মৃতি।

ডাক্তার মুহূর্তের মধ্যে ঐ ছোট্ট ফিয়েট চড়ে নিউ ফরেস্টের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।

অমিতাবৌদি সেরে গেছে। সুধীরবাবু ভীষণ খুশি, ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞ।

অমিতাবৌদি ফিসফ্রাই পৌঁছে দেন ডাক্তারের বাংলোয়। ছন্দা লনে থাকে, ফুল দেখে। অমিতাবৌদি চলে যান ভেতরে। ড্রইংরুম পার হয়ে বেডরুমে। টিফিন ক্যারিয়ারটা খালি করে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু মন? সে জোয়ারের জলে ভরে যায়।

লরী রোডের মোড়ে পোস্টাপিসের কাছে মিঃ মুখার্জীর মেয়ে খুকু বলে, রোজ রোজ তুমি ডাক্তারবাবুকে ফিসফ্রাই খাওয়াবে তা চলবে না।

ঠোঁটটা একটু কামড়ে হাসিমুখে অমিতাবৌদি বলেন, কি করব বল? ডাক্তার রোগ সারাল কিন্তু ফি নিল না। তাই খেসারত দিচ্ছি।

নিউ ফরেস্ট ঘুমিয়ে পড়ে। মিঃ মুখার্জীর ড্রইংরুম থেকে মৌমাছিরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নেয়। মিঃ পটাশকার হোয়াইট হর্স চড়ে অমরাবতী বেড়াতে যান। সুধীরবাবু ডুন এক্সপ্রেসের কুপেতে চড়ে পাগল হন। তারপর ডুন এক্সপ্রেস থেমে যায়।

জেগে থাকে শুধু অমিতাবৌদি। দূরের মুসৌরী পাহাড়ের আলোগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।

আর?

আর ঐ সর্বনাশা কোকিলের ডাক শোনে শুধু অমিতাবৌদি।

ডাক্তারও বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। কিছুতেই ঘুম আসে না।

প্রাইভেট প্রাকটিশ

ডেরাডুন শহরটাকে পিছনে রেখে এগিয়ে যান চাক্ৰাতার রাস্তা ধরে। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় পাতলা হয়ে আসবে আর দূরের মুসৌরী পাহাড়টা আরো স্পষ্ট মনে হবে। ঐ যে কি একটা সিনেমা হলের কাছাকাছি কংক্রীটের ছোট্ট পুলটা পার হলেই ডেরাড়ুন শহরটাকে আর দেখা যাবে না।

আরো এগিয়ে যান। বেশি না, দুএক মাইল এগিয়ে গেলেই দূরের ফরেস্ট অনেকটা কাছে এগিয়ে আসবে। তারপর ছোটোখাটো দুটোএকটা কলকারখানা পড়বে। দাঁড়াবেন না। আরো একটু এগিয়ে যান। এই মাইলখানেক আর কি! ফাঁকা চাক্ৰাতা রোডের ওপর ছোটোখাটো দুচারটে দোকান চোখে পড়বে। চাপানবিড়িসিগারেটের দোকান। একটা দোকান থেকে বিবিধ ভারতীয় পচা হিন্দি গান আপনার কানে আসবে। কিছু লোককে আড্ডা দিতে দেখবেন। তবুও দাঁড়াবেন না।

এ বল্লুপুর পিছনে ফেলে সামান্য কয়েক পা এগিয়ে গেলেই এফআরআই ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক নম্বর গেট। খাকি উর্দি পরা রামবাহাদুরকে পাহারা দিতে দেখবেন। যদি প্রাইভেট গাড়ি করে যান, থামতে হবে না। আর যদি ট্যাক্সি বা অটো রিকশা করে যান, একটু থামুন। রামবাহাদুর একটা হলদে রঙের ছেঁড়া খাতা আর দেড় ইঞ্চি লম্বা একটা পেন্সিল এগিয়ে দেবে। ঐ খাতায় ট্যাক্সি বা অটোরিকশার নম্বর লিখে একটা দস্তখত দিন।

বল্লুপুরের এই গেট থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে এফআরআইএর কেন্দ্রবিন্দু। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের পিছনের ছোট্ট রাস্তাটাকে লাভার্স লেন বলে না? পদ্মপুকুরের ওদিকেও একটা ছোট্ট রাস্তার নাম লাভলক প্লেস। আসলে এফআর আইএর এই রাস্তাটাই প্রেমিক-প্রেমিকাদের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হওয়া উচিত ছিল। সত্যি কি সুন্দর এই রাস্তাটা! দুপাশে এফ-আর-আই এর নিজস্ব রিজার্ভ ফরেস্ট। ঐ ফরেস্টের মাঝখান দিযে পিচের রাস্তাটা লজ্জায় এঁকে বেঁকে পালিয়ে গেছে সেন্ট্রাল বিল্ডিংএর ওদিকে।

দুপাশে অত সুন্দর ফরেস্ট যে শুধু কিছু কোকিল ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না। হ্যাঁ, আর আছে কিছু বৌ কথা কও পাখি! এফআরআইএর এই ছোট্ট নিজস্ব শহর নিউ ফরেস্টে যারা বেশিদিন থাকেন, তাঁরা সাইকেল, মোটর, ট্যাক্সি বা অটো রিকশা করেই এই রাস্তা দিয়ে চলে যান। এই বিজননির্জন বনানীর আকর্ষণ তাদের নেই। কোকিলের ডাক বা বৌ কথা কও তাদের কানে যায় কিন্তু প্রাণে দোলা দেয় না।

কিন্তু নতুন যারা আসেন তারা বল্লুপুরের গেটে এসে ট্যাক্সি বা অটোরিকশা থেকে নেমে পড়েন। এই বনবীথিকা দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যান নিউফরেস্টের ঐ বাংলোগুলোর দিকে।

নিউ ফরেস্টের অফিসারের দল সপরিবারে এই রিজার্ভড় বেস্টে আসেন মাঝে মাঝে। বছরে দুতিনবার। তবে কোকিলের ডাক শুনতে নয়, পিকনিক করতে। মধু গন্ধে ভরা মৃদু মিছায়া নীপকুঞ্জে তলে বসে বসে লুচিআলুর দমচিকেনকারি আর চাটনি খাওয়া হয়। ফরেস্ট এদের কাছে মনের খোরাক নয়, ল্যাবরেটারির উপাদান মাত্র।

.

ব্যতিক্রম শুধু ডাক্তার।

ডাঃ বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জী।

ডাঃ ব্যানার্জী মাঝে মাঝেই আপন মনে ঘুরে বেড়ান এই শ্যামল বনানীর নির্জন পথে পথে। কোকিলের ডাক শোনেন, বৌ কথা কও পাখি খুঁজে বেড়ান গাছের ফাঁকে ফাঁকে, লতাপাতার আড়ালে।

নিউ ফরেস্টের কোনো অফিসারকে দেখলে ডাক্তার লজ্জা পান। ভীষণ লজ্জা পান। নিজের মনকে নিজেই লুকোতে হিমসিম খেয়ে যান। একটু সামলে নিয়ে বলেন, কী করব বলুন মিঃ সরকার? নিউ ফরেস্টের যে বাড়িতেই যাই না কেন, সেখানেই একটা একটা রুগী দেখতে হয়। প্রেসক্রিপশন লিখতে হয়। সব সময় কি ভালো লাগে?

একটু থেমে, একটু হেসে ডাক্তার বলেন, তাইতো মাঝে মাঝে সময় পেলে এদিকে একটু ঘুরতে আসি। এখানে কেউ প্রেসক্রিপশন লিখতে বলে না।

মিঃ সরকার হো হো করে হেসে উঠে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে যান ওদিকে। মনে মনে ভাবেন, ছোঁকরা বয়স, তারপর এইতো সেদিন এলোয় আরো কিছুদিন থাকলে এসব কবিত্ব কোথায় পালিয়ে যাবে।

ডাক্তারের ভাবতে অবাক লাগে। সত্যি নিউ ফরেস্টের মানুষগুলো যেন কেমন কেমন! নিউ ফরেস্টের মধ্যে এবা কি আশ্চর্যভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এত বড় হিমালয়ের কোলে থেকেও এদের জীবন কত সীমাবদ্ধ। সকাল সাড়ে নটা আর বিকেল সাড়ে চারটের সাইরেনের পরও এরা মুক্তি পায় না, মুক্তি পেতে পারে না, মুক্তি পেতে জানে না। সন্ধ্যার পর একটুআধটু মজলিস বসে, কিন্তু সেখানেও ট্রান্সফার প্রমোশনইনক্রিমেন্টের গল্প। অথবা টুরের কথা। অথবা পুরনো অফিসারের নিন্দা।

মেয়েরা?

নিউ ফরেস্টে মেয়ে কোথায়? মিঃ মুখার্জীর দুটি মেয়ে ছাড়া নিউ ফরেস্টে মেয়ে নেই, সবাই বিবাহিতা, সবাই গৃহিণী। সাড়ে সাতটার মধ্যে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে স্বামীকে ব্রেকফাস্ট দিতে দিতেই সকালবেলার মেয়াদ শেষ হয়। তারপর স্বামীকে লাঞ্চ খাইয়ে ছেলেমেয়েদের তদারক করতে করতেই সাড়ে চারটের সাইরেন বিকট আর্তনাদ করে বেজে ওঠে। স্বামীকে চা দিতে না দিতেই সূর্য নিউ ফরেস্ট থেকে পালিয়ে যায়। তারপর আবার সংসার, চাল-ডাল-আটা-ময়দার কোরাস।

সন্ধ্যার পর একটু মেলামেশা। একটু গল্পগুজব। হয়তো বা একটু হাসিঠাট্টাতামাসা। তারপর নিউ ফরেস্ট ঘুমিয়ে পড়ে। একটি একটি করে বাংলোর আলোগুলো নিভে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।

সবাই?

না, সবাই না। মিঃ মুখার্জীর ড্রইংরুমে দুটি একটি ব্যালির মৌমাছি মধুর গন্ধে অথবা কিছু খোস গল্প করে অনেক রাত অবধি। আর ফরেস্ট কলেজের হোস্টেলের পাশের বাংলোয় মিঃ পটাশকারের ড্রইংরুমে আলো জ্বলে। তবে বড় আলোটা নয়, ছোট আলোটা। নাইট ল্যাম্পটা। হোয়াইট হর্সের শেষ বিন্দু গলায় ঢেলে দেবার পর নাইট ল্যাম্পটাও আর নজরে পড়ে না।

তারপর নিউ ফরেস্টে ঘুমিয়ে পড়ে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ে?

.

না। স্বামীর পাশে শুয়ে থাকেন কিন্তু ঘুম আসে না অমিতাবৌদির। দূরের মুসৌরী পাহাড়ের আলোগুলো যেন হাতছানি দিয়ে অমিতাবৌদিকে ডাকে। নিউ ফরেস্টের ঐ বন্দিনী জীবনে ঐ দূরের আলো কত মিষ্টি, কত মনোরম, কত প্রিয়, কত আকর্ষণীয় মনে হয়। দূরের মুসৌরী পাহাড়ের আলোর মালার মতো ডাক্তারের হৃদয়দীপের আলোও যেন অমিতাবৌদিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

ডাক্তার?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাঃ বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জী। আমাদের ডাক্তার। নিউ ফরেস্টের মেডিক্যাল অফিসার।

আশ্চর্য হবার কি আছে? অমিতাবৌদি মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। আঠারো বছরে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে আইএ পাস করার পর স্বামীর হাত ধরে প্রথম যেদিন নিউ ফরেস্টে এসেছিলেন, সেদিন তার চোখে ছিল অনেক আশা, ছিল অনেক স্বপ্ন। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের সব শিক্ষিতা মেয়েই যেমন স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের। শিক্ষিত ভদ্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে স্বপ্ন দেখবে না? নিশ্চয়ই দেখবে কিন্তু ঐ লাল বেনারসীর মেয়াদ যে কত সীমিত তা ভাবতে পারে না স্বপ্নাতুর ভরাযৌবনাদের দল। স্বামীর একটু ছোঁয়া, একটু স্পর্শ, একটু আদর, একটু আলিঙ্গন মেয়েদের দেহে বন্যা আনে, মনে স্বপ্ন আনে।

তারপর?

তারপর বিনাইঞ্জিনের গ্লাইডারের মতো হঠাৎ আকাশে ভাসতে থাকে, উড়তে থাকে। মাটির পৃথিবী থেকে একটু উপরে গিয়েই পাগল হয় সদ্যবিবাহিতা, সদ্যপ্রস্ফুটিতার দল। কিন্তু বিনাইঞ্জিনের গ্লাইডার কতক্ষণ উড়বে? নেমে আসে মাটিতে, মাটির পৃথিবীতে। বারো বছর আগে এমএসসি পাস স্বামীর সঙ্গে যেদিন অমিতাবৌদি হাওড়া থেকে ডুন এক্সপ্রেসের কুপেতে চড়েছিলেন, তখন মনে করেছিলেন হাতে স্বর্গ পেলেন।

স্বর্গ?

স্বর্গ বৈকি। বৈঠকখানায় তিনখানা ঘরের বাড়িতে পাঁচ ভাইবোন আর বাবামা। মিত্র স্কুলের মাস্টারি আর দুটো টিউশনিব পঞ্চাশ টাকার মধ্যে সাতটি প্রাণীর সংসার চলত। থামত না ঠিক কিন্তু বনগাঁ লোকালের মতো থামতে থামতে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে চলত। কলকাতার বারো আনা লোকের সংসার যেমন চলে, অমিতাবৌদিদের সংসারও ঠিক তেমনি চলত। পাঁচপাঁচটি ভাইবোনকে স্কুলকলেজে পড়াতেই বাবার জান বেরিয়ে যেত।

সখ-আনন্দ? মীর্জাপুরের প্রতিমাদের বাড়ি যাওয়াই ছিল একমাত্র আনন্দ। প্রতিমাদের বাড়ির ছাদে উঠে একটু দূরের আকাশ দেখাই ছিল অমিতাবৌদির নিত্যকার চিত্তবিনোদনের একমাত্র সূত্র। আর কদাচিৎ কখনও এক টাকা চার আনা দিয়ে পূরবীতে সিনেমা দেখা।

ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হবার পর দৃষ্টিটা একটু পালটে গিয়েছিল। মনে রঙ লেগেছিল। দেহের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে মঞ্জরী দেখে অমিতাবৌদি নিজেই চমকে উঠেছিল। আশপাশের সবার থেকে নিজেকে একটু স্বতন্ত্র, একটু অনন্যা মনে হয়েছিল।

নিজেকে নিজের ভালো লাগত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সুযোগ কোথায়? তাইতো ঐ সিঁড়ির তলার কলকাতায় স্নান করতে গিয়ে অমিতাবৌদি নিজেকে দেখত। ভালো করে দেখত। সর্বাঙ্গ দেখত। অকারণে হাসি ফুটে উঠত নিজের মুখে।

আমহার্স্ট স্ট্রিট-মীর্জাপুর দিয়ে কলেজে যাবার সময় শুদ্ধানন্দ পার্কের কাছাকাছি প্রায়ই দেখা হত অশোকদার সঙ্গে। ছোটবেলার বন্ধু মিতালীর দাদা অশোক। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। অমিতাবৌদির সঙ্গে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তবুও শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের কাছে এসে অশোকদার সঙ্গে ঐ দেখাটুকুই ভালো লাগত। তখন যে ভালো লাগার বয়স।

কলেজের অন্য অনেক মেয়ের জীবনে বসন্ত এসেছিল। ওদের বসন্তে ভ্রমরগুঞ্জনের কথা শুনত অমিতাবৌদি। ভালো লাগত উপন্যাসের নায়িকাঁদের জীবনকাহিনি শুনতে। হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে তারও মনে মনে ইচ্ছা হতো নায়িকা হতে। ভালোবাসতে, ভালোবাসা পেতে। বহুর থেকে দূরে গিয়ে অনন্যা হতে।

.

সুধীরবাবুর সঙ্গে যেদিন ডুন এক্সপ্রেসে চাপল, তখন সে অনন্যা হয়েছিল। দুটি রাত্রের সে সফর যেন অনন্যার অভিষেক হয়েছিল। দেহে, মনে নতুন ঐশ্বর্যের স্বাদে ভরে উঠেছিল অমিতাবৌদির জীবন। জোয়ারের জল যে একদিন সরে যাবে, ভরা নদী যে একদিন শুকিয়ে যাবে, সেদিন অমিতাবৌদি ভাবতে পারেনি। কেউই পারে না।

দিনে দিনে, তিলে তিলে সুধীরবাবু যেন ল্যাবরেটরির মাইক্রোস্কোপের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। সাড়ে নটা আর সাড়ে চারটের সাইরেনের মধ্যে মাইক্রোস্কোপের তলায় গাছের সেল পরীক্ষা করতে করতে অমিতবেদির মনের সেল দেখতে ভুলে গেলেন। সুখী, সাধ্বী অমিতাবৌদির জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অনন্যা অমিতাবৌদির মৃত্যু হল। রঙিন নিউ ফরেস্ট হারিয়ে গেল। চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল। স্বামীর দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালোবাসার ফাঁক দিয়ে কবে, কখন কেমন করে হারিয়ে গেল অমিতাবৌদি নিজেও তা টের পেল না।

সুধীরবাবু কি পালটে গেছেন? বিন্দুমাত্র না। পৃথিবীর অন্য সব স্বামীর মতো তিনিও ছন্দা পড়াশুনা সেরে ঘুমিয়ে পড়লে অমিতাবৌদিকে কাছে টেনে নেন। আদর করেন, ভালোবাসেন। রাতের অন্ধকার আরো গাঢ় হলে, নিউ ফরেস্ট ঘুমিয়ে পড়লে সুধীরবার অমিতাবৌদিকে আরো আরো অনেক কাছে টেনে নেন। ডুবে যান, হারিয়ে যান অমিতাবৌদির মধ্যে! তাও কি রোজ? সপ্তাহে দুএকদিন। ঐ দুএকদিনই সুধীরবাবু আবার সেই বারো বছর আগের ডুন এক্সপ্রেসের যাত্রী হন।

অমিতাবোদির ভালো লাগে। বেশ ভালো লাগে। ডুন এক্সপ্রেসের কুপেতে চড়তে তার বড় আনন্দ হয়, বড় তৃপ্তি লাগে। কিন্তু ঐ রাতের অন্ধকারে যখন ডুন এক্সপ্রেস থেমে যায়, যখন একটি সপ্তাহের মতো সিগন্যাল ডাউন না পেয়ে ডুন এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে থাকে, তখন অমিতাবৌদির কানে ঐ সর্বনাশা কোকিলেব ডাক ভেসে আসে। হয়তো শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের মোড়ের আশোকদার কথা মনে পড়ে। হয়তো মনে মনে সন্দেহ হয়, একি ভালোবাসা? নাকি কর্তব্য? অভ্যাস? নাকি শুধু প্রয়োজন?

ঠিক বুঝতে পারে না অমিতাবৌদি। ভাবে সবারই কি এক ইতিহাস? সবাই কি শুধু অভ্যাস-কর্তব্য-প্রয়োজনের ত্রিসীমানার মধ্যে বন্দিনী? এর চাইতে বেশি কি পাওয়া যায় না? এর চাইতে বেশি পাবার কি অধিকার নেই? প্রয়োজন নেই?

অমিতাবৌদি চায় অনন্যা হতে। স্বপ্ন দেখে তার স্পর্শ, তার ভালোবাসা, তার হাসি, তার চোখের দৃষ্টি মাতাল করবে, পাগল করবে তার প্রাণের পুরুষকে। আর আর সেই প্রাণের পুক দায়িত্ব, কর্তব্য, অভ্যাসের দাস হয়ে ডন এক্সপ্রেসের কুপেতে সফর করবে

তবে?

তবে আবার কি? অমিতাবৌদি অনন্যা হবে। অন্তত একটি মানুষের জীবনে সে অনন্যা, অদ্বিতীয়া হবে। শুধু নিদ্রাহীন রাতে নিঃসঙ্গ হয়ে নয়, প্রতি দিন, প্রতি রাত্রে দুজনে মিলে শুনবে কোকিলের ডাক। শুনবে, বৌ কথা কও।

সকালবেলায় দিনের আলোয় অমিতাবৌদির স্বপ্ন হারিয়ে যায়, পালিয়ে যায়। সত্যি? নাকি লুকিয়ে পড়ে?

দুটোর সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সুধীরবাবু লাঞ্চ খেয়ে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে তার মাইক্রোস্কোপের ফোকাস ঠিক করতে শুরু করেন! সে লেন্সের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীব অসংখ্য সব গাছপালার অন্তরের কথা জানা যায়; কিন্তু অমিতাবৌদি তখন আউট অফফোকাস হয়ে যান। ঐ সুন্দর বাংলো বাড়ির বারান্দায় বা লনের পাশে গার্ডেন চেয়ারে বসে সুধীরবাবুর পুলওভার বুনতে বুনতে অমিতাবৌদির আবার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা রাতের কথা। স্বপ্নের স্মৃতি। আপন মনে নিজেই হেসে ওঠে পাগলামিরও একটা সীমা থাকা উচিত। তাই না? নিশ্চয়ই। অমিতাবৌদি নিজেই নিজেকে শাসন করেন। হাতের কাঁটা দুটো যেন একটু দ্রুত চলে।

.

রাত্রে খাবার সময় সুধীরবাবু একটু যেন রেগেই বলে উঠলেন, এতদিন ধরে বুকে ব্যথা, বুকে ব্যথা বলছ অথচ ডাক্তার দেখাবে না কেন বলতে পার?

ছন্দার খাওয়া হয়ে গেছে। সে ভিতরের বেসিনে হাত ধুতে যায়। সুধীরবাবু বামহাত দিয়ে কাছে টেনে নেন অমিতাবৌদিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ফিরে যান অতীতে। সেই বারো বছর আগে।

অমিতাবৌদির বেশ ভালো লাগে। মুহূর্তের জন্য তিনি যেন অনন্যা, অদ্বিতীয় হন। বলেন, আঃ ছেড়ে দাও। ছন্দা দেখবে।

সুধীরবাবু বোধহয় মাইক্রোস্কোপের লেন্সের ভিতর অমিতাবৌদির মনের সেল দেখতে পান। কি যেন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, অমিতাবৌদির দিকে, নিশ্বাসটাও যেন একটু ঘন, একটু গরম হয়। সুধীরবাবু কেমন যেন একটু পাগলামী শুরু করেন।

অমিতাবৌদির ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে। দেহ মনে পদ্মার মাতলামী দেখা দেয় লুকিয়ে লুকিয়ে। সর্বাঙ্গে যেন শিহরণ দেখা দেয়, কানে ভেসে আসে কোকিলের ডাক।

পরের দিন সকালে অফিস গিয়েই সুধীরবাবু ডাক্তার ব্যানার্জীকে টেলিফোন করলেন, ডাক্তার সাহেব, এই মাইক্রোস্কোপ আর ঘরের গিন্নি ঠিক না থাকলে বাঁচব কি করে?

ডাক্তার হেসে বলে, কোনটা ধর্মঘট করল? মাইক্রোস্কোপ না গিন্নি?

মাইক্রোস্কোপ হলে কি আর এই সাত সকালে ফোন করতাম? গিন্নি, ডাক্তার গিন্নি। কুইন এলিজাবেথ দি থার্ড!

কি হল কি?

কি হল তা বুঝলে তো নিজেই চিকিৎসা করতে পারতাম। কিছু কাল ধরেই বলছে বুকে ব্যথা, অথচ চিকিৎসা করবে না।

তাহলে আমি আর কি করব?

সুধীরবাবু এবার রসিকতা করে বলেন, ভায়া, সুন্দরী গিন্নির বুকে ব্যথা। সহ্য করতে পারলাম না। কাল অনেক কাণ্ড করে রাজি করিয়েছি।

ডাক্তার একটু ব্যস্ত ছিল। বলল, এক্ষুনি তো পারছি না। লাঞ্চের পর গেলে কি অসুবিধা হবে?

লাঞ্চে এসে সুধীরবাবু বলে গেলেন, ডাক্তার আসবে। সব কথা বোলো, কিছু লুকিয়ে চেপেটেপে রেখো না!

.

ডাক্তার এসেছিল। তবে লাঞ্চের পরেই আসতে পারেনি। আসতে আসতে প্রায় চারটে হয়েছিল।

সুধীরবাবুর জন্য রোজ কাটলেট বানাতে শরীরটাই খারাপ করে ফেললেন?

অমিতাবৌদি হাসে। অর্ধসমাপ্ত পুলওভারটা ছোট্ট টিপাইএর উপর রেখে ভিতরে যান। ড্রইংরুমে।

ডাক্তার বলল, শুয়ে পড়ুন। একটু পরীক্ষা করে দেখি কত কাটলেট খাইয়েছেন।

শোবার ঘরে অমিতাবৌদি শুয়ে পড়েন। ডাক্তার পাশে বসে চেয়ারটা টেনে নিয়ে চুপচাপ দেখেন কিছুক্ষণ।

বাঁ হাতটা দিন।

অমিতাবৌদি বাঁ হাত বাড়িয়ে দেন। ডাক্তার ঘড়ির কাটার সঙ্গে মিলিয়ে পালস পরীক্ষা করেন।

অমিতাবৌদি জোরে জোরে নিশ্বাস নেন। বুকটা একটু বেশি ফুলে ফুলে ওঠে। বোধহয় একটু লজ্জা করে। দৃষ্টিটা সরিয়ে ঘুরিয়ে নেন বাইরের দিকে।

ডাক্তার নাড়ী দেখে। কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে দৃষ্টিটা আটকে যায়। অমিতাবৌদির হৃদয় স্পন্দন দেখে ডাক্তার হয়তো একটু ভালো লাগে, মনে রং লাগে। না, না, ওসব কিছু না। ছাত্রজীবনে ওসব হতো। আজকাল আবার এসব দুর্বলতা কি? তিনবছর বিয়ের পরও কি এসব দুর্বলতা কারুর থাকে? ডাঃ বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জীরও নেই।

কিন্তু তবুও মুহূর্তের জন্য ভালো লেগেছিল ডাক্তারের। অমিতাবৌদির হৃদয়স্পন্দন দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, সুধীরবাবু সত্যি ভাগ্যবান।

পালস্ দেখা হয়ে গেল। ডাক্তার অমিতাবৌদির হাতটা নামিয়ে রাখে।

বুকে ব্যথা করে আপনার?

হ্যাঁ।

কোথায়? বাঁ দিকে না ডান দিকে?

বাঁ দিকে।

সব সময় ব্যথা করে?

হ্যাঁ, প্রায় সব সময়েই।

কম না বেশি?

মাঝে মাঝে খুব বেশি ব্যথা করে।

ডাক্তার স্টেথো বের করে। চেস্টপিস দিয়ে অমিতাবৌদির বুক পরীক্ষা শুরু করে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে। ডাক্তার কেন যেন একটু চিন্তিত হয়। ভ্রূ দুটো কুঁচকে ওঠে।

একটু জোরে জোরে নিশ্বাস নিন

অমিতাবৌদি জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। বুকটা ফুলে ফুলে উপরে ওঠে, নীচে নামে।

স্টেথোর চেস্টপিস কখনও পুরা পাশে, কখনও ব্রেস্টের পাশে ঘোরাঘুরি করে ডাক্তারের হাতটাও ঘুরে বেড়ায়। একটু এদিকওদিক লাগে বৈকি!

অমিতাবৌদির লজ্জা করে। চুপ করে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। শুধু দৃষ্টিটা বাইরের আকাশে ভেসে বেড়ায়। ডাক্তারের স্পর্শে কি মন একটু চঞ্চলা হয়? না না, তা হবে কেন?

ডাক্তার তো পরীক্ষা করবেই।

ওপাশ ফিরে শোন

অমিতাবৌদি ওপাশ ফিরে শোন। ডাক্তার পরীক্ষা করে চলে। ডাক্তারের ভ্রূ দুটো কুঁচকে ওঠে। কপালে যেন কয়েকটা চিন্তার রেখা দেখা দেয়।

উপুড় হয়ে শোন তো।

অমিতাবৌদি উপুড় হয়ে শোন। ডাক্তারের পরীক্ষা এগিয়ে চলে। পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তার বুঝিবা মুহূর্তের জন্য অমিতাবৌদির সর্বাঙ্গের উপর দিয়ে দৃষ্টিটা বুলিয়ে নেয়। বাঃ বেশ তো!

ডাক্তারের কথায় অমিতাবৌদি আবার চিৎ হয়ে শোন। স্টেথো নামিয়ে রেখে এবার হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। দুপাশের প্লুরার কাছে দুটো হাত দিয়ে জোর করে চেপে ধরে ডাক্তার।

খুব জোরে নিশ্বাস নিন।

খুব জোরে নিশ্বাস নিতে গিয়েই অমিতাবৌদি হঠাৎ বলেন, আঃ ভীষণ লাগছে।

কোথায়?

এইতো বাঁ দিকটার এইখানে।

ডাক্তার এবার দুটো আঙুল দিয়ে বাঁ দিকের নানা জায়গায় আঘাত করতে থাকে।

ব্যথা লাগলেই বলবেন।

 

ডাক্তার জেনে নেয় কোথায় ব্যথা।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে ডাক্তার বড় যত্ন করে পরীক্ষা করল। বড় ভালো লাগল অমিতাবৌদির।

দুজনে বেরিয়ে এসে বাইরের গার্ডেন চেয়ারে বসে।

এতদিন আমাকে খবর দেননি কেন? কাটলেট খাওয়াতে হবে বলে?

অমিতাবৌদি একটু হাসেন। বড় সুন্দর হাসি। ঢলে পড়া সূর্যের মতো মিষ্টি আলোয় ভরে যায় মুখখানা। বললেন, এমনি।

খুব বেশি পরিশ্রম করেন?

না, তেমন কি। সাধারণ সংসারে সবাই যেমন করে…

কোনোদিন হঠাৎ কোথাও পড়ে গিয়েছিলেন বা বুকে আঘাত লেগেছিল?

একটু ভাবেন অমিতাবৌদি। একটু দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে একটু ঠোঁটটা কামড়ান মুহূর্তের জন্য। বলেন, দিন পনেরো আগে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।

পড়ে গেলেন কীভাবে?

সারান দিয়ে স্নান করছিলাম। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলাম।

ডাক্তার একটু রসিকতা করেন। এখনও সারান দিয়ে স্নান করতে পারেন না?

দুজনেই একটু হাসে

বুকে চোট লেগেছিল?

ঠিক বুকে কোনো চোট লাগেনি কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন খচ করে উঠেছিল!

তারপর থেকেই বুকে ব্যথা তাইতো?

হ্যাঁ।

ডাক্তার আরো খোঁজখবর নেয়। শরীরের যত্ন করেন না কেন?

আর কি যত্ন করব?

অনেক দিন ধরে খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেন না, তাই না?

অমিতাবৌদি একটু হাসে। ভাবে খাওয়াদাওয়া তো রোজই আছে। কিন্তু একলা একলা কি খেতে ভালো লাগে? তাছাড়া কে খোঁজ করে আমার খাওয়াদাওয়ার? ডাক্তারকে বলেন, কেন? খাওয়াদাওয়া তো ঠিক মতোই করি।

কেন লুকোচ্ছেন? এবার আমি যখন নিজে খাইয়ে দেব, তখন দেখবেন মজাটা।

অমিতাবৌদি ভেতরে চলে যান। একটু পরে এক কাপ কফি আর দুটো ফ্রেঞ্চ টোস্ট নিয়ে আসেন।

স্বামীকে কাটলেট খাইয়ে তো একটা বুকে ব্যথা করেছেন। এবার আমাকে খাইয়ে আর একটা বুকে ব্যথা করবেন?

এবার অমিতাবৌদিও একটু রসিকতা করেন। স্বামীকে সেবা করে বুকে ব্যথা করেছি, আপনাকে সেবা করে সে ব্যথা সারিয়ে নেব।

সে বিশ্বাস আছে আপনার?

নিশ্চয়ই। তা নয়তো কি এত খাতির করতাম?

কফির পেয়ালা, প্লেট নামিয়ে রেখে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে, বুকে ব্যথা হবার পর থার্মোমিটার দিয়ে টেম্পারেচার দেখেছেন?

থার্মোমিটার দিইনি, তবে মাঝে মাঝে গাটা গরম মনে হয়।

শোবার সময় কোন দিকে ফিরে শুতে ভালো লাগে?

বাঁ দিকে ফিরে শুলেই যেন একটু ভালো লাগে।

.

সাড়ে চারটের সাইরেন বেজে উঠল! কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুধীরবাবু আসেন। অমিতাবৌদি আবার কফি করতে ভেতরে চলে যান।

কি দেখলেন ডাক্তার?

আই থিঙ্ক ইট ইজ এ কেস অফ ড্রাই প্লুরিসি।

তাই নাকি? সুধীরবাবু একটু চিন্তিত হন।

চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে আপনাকে কয়েকটা কাজ করতে হবে।

কি বলুন।

নিয়ম হচ্ছে কমপ্লিট রেস্ট ইন বেড। যদি সেটা নিতান্তই অসম্ভব হয় তাহলে অন্তত ওঁকে দিয়ে রান্নাবান্না করানো বন্ধ করতেই হবে।

সুধীরবাবু যেন একটু স্বস্তি পান। সেটা বিশেষ মুশকিলের কিছুই নয়। আমার একটা ছোকরা চাকর আছে। সে মোটামুটি ভালোই রান্না করে।

সেকেন্ডলি, বেশ ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু খেলে তো? এক কাপ দুধ খেতে বললেই ফাটাফাটি হয়ে যায়।

ছেলেমানুষি করলে তো চলবে না। এবার খেতেই হবে।

অমিতাবৌদি দু কাপ কফি নিয়ে আসেন।

সুধীরবাবু বললেন, নিজের কানে ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে শুনে নাও কি কি করতে হবে।

অমিতাবৌদি উড়িয়ে দেন কথাটা, যা সম্ভব তাই শুনব।

এবার ডাক্তার মুখ খোলে, ওসব ছেলেমানুষি ছেড়ে দিন।

পরের দিন অমিতাবৌদির চেস্ট এক্সরে হলো। রক্তের ডিফারেনসিয়াল কাউন্ট আর ইএসআর দেখা হল।

ডাক্তার সুধীরবাবুকে জানিয়ে দেয়, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। লেফট প্লুরায় বেশ খানিকটা প্যাঁচ হয়েছে।

.

অমিতাবৌদি শুয়ে পড়লেন বিছানায়। চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল।

কে জানত তখন, এ শুধু প্লুরিসির চিকিৎসা নয়?

ডাক্তার রোজ সকালের দিকে আসে ড্রাই-হাইড্রো স্ট্রেপটোমাইসিন ইনজেকশন দিতে। কোনদিন দশটা, কোনদিন আবার এগারোটায় আসে।

প্রথমে বুকের মুভমেন্ট পৰীক্ষা করেন। তারপর প্যালপেসন দেখেন। হুঁ, এখনও বেশ ঘড়ঘড়ানি আওয়াজ। ঠিক যেন বেড়ালের মতো। তারপর পারকাসান। আঙুল দিয়ে টোকা মেরে পরীক্ষা করেন। আওয়াজটাও ঠিক একই রকম আছে। তারপর স্টেথো বের করেন। ইয়ারপিস কানে দিয়ে চেস্টপিসটা ঘুরে বেড়ায় অমিতাবৌদির সারা বুকে।

রোগশয্যায় শুয়ে থেকেও অমিতাবৌদির যেন একটু ভালো লাগে, শরীরে যেন একটু রোমাঞ্চ লাগে। মনে যেন একটু দোলা লাগে। ডাক্তারকেও যেন একটু ভালো লাগে।

ডাক্তার সিরিঞ্জ বের করে। স্পিরিট দিয়ে মুছে নেয়। ইনজেক্শন বের করে, ডিসটিল্ড ওয়াটারের ফাইল বের করে। সিরিঞ্জে ইনজেকশন ভরে নেয়।

নিন, কোন্ হাতে দেব?

গলা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে ব্লাউজের বোতামগুলো খুলে দেন অমিতাবৌদি। তারপর অর্ধেক ব্লাউজ খুলে ডান হাতটা বের করে দেন।

ডাক্তার ডান হাতের উপরের মাংসপেশীতে স্পিরিটের তুলোটা বুলিয়ে নিয়ে ইনজেকশন দেন।

অমিতাবৌদি একবার আর্তনাদ করেন, আঃ মরে গেলাম।

ডাক্তার সিরিঞ্জটা বের করে নিয়ে দুচার মিনিট ম্যাসেজ করে দেয়।

অমিতাবৌদির সব ব্যথা সেরে যায়।

এফআরআই এর প্রেসিডেন্টের স্ত্রীকে দেখে ফেরার পথে ডাক্তার রাত্রের দিকে আর একবার আসে। সুধীরবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, কি গিন্নী ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছেন তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অমিতা সব কথা শুনছে।

পরের দিন ডাক্তার আসতে পারে না। কম্পাউডার এসে ইনজেকশন দিয়ে যায়। অমিতাবৌদির কেমন যেন একটু বিশ্রী লাগে।

পরের দিন ডাক্তার এলে অমিতাবৌদি জিজ্ঞাসা করেন, কাল এনেন না যে?

আসবো কেমন করে? শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা করলেন। রাজা দুষ্মন্তের তদারক করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় শালাবাবু আর শকুন্তলাকে ট্রেনে চড়িয়ে দিতে হয়েছে।

অমিতাবৌদি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনার খাওয়াদাওয়ার কি হবে?

মুখার্জী বৌদির ওখানে নন পেয়িং গেস্ট হবার ব্যবস্থা হয়েছে। কাল রাতেই ওপেনিং সেরিমনি হল।

দশদিনে অমিতাবৌদির বুকের ব্যথা বেশ কমে গেল কিন্তু রোজ রোজ ইনজেকশন নিতে হাতের ব্যথা বেড়ে গেল।

হাতে না নিলে কোমরে নিন।

কোমরে? একটু লজ্জা একটু সঙ্কোচ যেন ঘিরে ধরে অমিতাবৌদিকে। একটু এগিয়ে, একটু পিছিয়ে যায়। হাত দুটো ব্যথায় বিষ হয়ে গেছে। না, না কোমরেই ভালো।

অমিতাবৌদির শাড়ির বাঁধন, সায়ার বাঁধন খুলে একটু নীচে নামিয়ে দেন। মুখটা একটু ঘুরিয়ে নেন ওপাশে।

স্পিরিটের তুলোটা বুলোত বুলোতে যেন ডাক্তারের হাতটা একটু কেঁপে ওঠে, একটু যেন থমকে দাঁড়ায়।

অমিতাবৌদি টের পান। তবে কি ডাক্তারেরও!

ইনজেকশন দেবার পব স্পিবিটের তুলোটা দিয়ে ডাক্তার একটু ম্যাসেজ করে। একটু বেশি সময় ম্যাসেজ করল না? তুলোটা ফেলে দিয়ে এবার হাতের তালু দিয়ে আরো একটু ম্যাসেজ করে ডাক্তার।

অমিতাবৌদির দেহটা একটু দূলে দূলে নড়ে ওঠে।

ডাক্তারের কি একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল?

সিরিঞ্জ খুলতে খুলতে ডাক্তার হঠাৎ প্রশ্ন করে কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনার?

বারো বছর।

বারো বছর? তাহলে খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে আপনার?

আঠারো বছরে।

চিকিৎসা এগিয়ে চলে। অমিতাবৌদি আর ডাক্তার এগিয়ে চলে নিয়তির দিকে।

দুসপ্তাহ হয়ে গেল। দুজনে এখন অনেক সহজ অনেক সরল। রাতের বেলায় দুজনেই শুয়ে শুয়ে কোকিলের ডাক শোনে।

আর কতদিন শুয়ে থাকব ডাক্তারবাবু?

ডাক্তারবাবু অমিতাবৌদির কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, কোন কষ্ট হচ্ছে?

অমিতাবৌদির দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অন্যমনস্ক হয়েই একটা হাত ডাঙারের হাতের পরে চলে যায়।

ডাক্তার আবার প্রশ্ন করে, কোন কষ্ট হচ্ছে?

অমিতাবোদি মুখে কিছু বলে না। মাথা নেড়ে বলে, না না, কষ্ট হবে কেন?

ডাক্তার একটু অমিতাবোদির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। অমিতাবৌদি যেন দেহের বাঁধনটা একটু ঢিলা করে ডাক্তারকে আদর করতে আমন্ত্রণ জানান। দুজনেরই নিশ্বাসটা যেন একটু ঘন হয়।

অমিতাবৌদি দুটো হাত দিয়ে ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরেন।

সন্ধ্যার সময় ডাক্তার ঐ বল্লুপুরের যাবার রাস্তায় একলা একলা ঘুরে বেড়ায়। কোকিলের ডাক শোনে, বৌ কথা কও পাখি খুঁজে বেড়ায়।

অমিতাবৌদি লনে গার্ডেন চেয়ারে বসে সুধীরবাবু পুলওভারটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে চায়। পারে না। হাতটা থেমে যায়। কোকিলের ডাক কানে আসে।

তিন সপ্তাহ ধরে রোজ রোজ ইনজেকশান দেওয়া হল, একটা কোর্স শেষ হল, ডাক্তার ও অমিতাবৌদির একটা অধ্যায় শেষ হলো।

.

টেম্পারেচার আর বুকের ব্যথা চলে গেল। এখন আর রোজ ইনজেকশন নয়, একদিন অন্তর একদিন।

ডাক্তার আসে, নিশ্বাস নেবার সময় বুকের মুভমেন্ট দেখে, প্যালপেসান দেখে, পারকাসান দেখে, স্টেথো দিয়ে অস্কালটেশান দেখে, না, না, অনেকটা ভালো, তারপর ডাক্তার ইনজেকশন দেয়। কোনোদিন হাতে, কোনোদিন কোমরে।

তারপর?

তারপরও ডাক্তার থাকে কিছুক্ষণ, অমিতাবৌদির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনও বা হাতটা এদিকওদিক চলে যায়।

তারপর?

তারপর অমিতাবৌদি ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরে। গালের পাশে চেপে ধরে।

শেষ ইনজেকশন দেবার দিন আরো একধাপ এগিয়েছিল দুজনে। চাকরটা ক্যান্টিনে গিয়েছিল ডিম কিনতে, অমিতাবৌদি ডাক্তারকে বিদায় জানাবার জন্য ড্রইংরুমের দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন। ডাক্তার আর পারেনি। কাছে, বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল অমিতাবৌদিকে।

আর?

আর অমিতাবৌদির ঠোঁটে রেখে গিয়েছিল নিজের স্মৃতি।

ডাক্তার মুহূর্তের মধ্যে ঐ ছোট্ট ফিয়েট চড়ে নিউ ফরেস্টের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।

অমিতাবৌদি সেরে গেছে। সুধীরবাবু ভীষণ খুশি, ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞ।

অমিতাবৌদি ফিসফ্রাই পৌঁছে দেন ডাক্তারের বাংলোয়। ছন্দা লনে থাকে, ফুল দেখে। অমিতাবৌদি চলে যান ভেতরে। ড্রইংরুম পার হয়ে বেডরুমে। টিফিন ক্যারিয়ারটা খালি করে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু মন? সে জোয়ারের জলে ভরে যায়।

লরী রোডের মোড়ে পোস্টাপিসের কাছে মিঃ মুখার্জীর মেয়ে খুকু বলে, রোজ রোজ তুমি ডাক্তারবাবুকে ফিসফ্রাই খাওয়াবে তা চলবে না।

ঠোঁটটা একটু কামড়ে হাসিমুখে অমিতাবৌদি বলেন, কি করব বল? ডাক্তার রোগ সারাল কিন্তু ফি নিল না। তাই খেসারত দিচ্ছি।

নিউ ফরেস্ট ঘুমিয়ে পড়ে। মিঃ মুখার্জীর ড্রইংরুম থেকে মৌমাছিরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নেয়। মিঃ পটাশকার হোয়াইট হর্স চড়ে অমরাবতী বেড়াতে যান। সুধীরবাবু ডুন এক্সপ্রেসের কুপেতে চড়ে পাগল হন। তারপর ডুন এক্সপ্রেস থেমে যায়।

জেগে থাকে শুধু অমিতাবৌদি। দূরের মুসৌরী পাহাড়ের আলোগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।

আর?

আর ঐ সর্বনাশা কোকিলের ডাক শোনে শুধু অমিতাবৌদি।

ডাক্তারও বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। কিছুতেই ঘুম আসে না।

২১১ পঠিত ... ১৭:০১, মার্চ ১১, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top