যার কাহিনি বলছি, তার নামে কোনোদিন ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল হবে না৷ এই নামটি লোকে চিরদিন মনেও রাখবে না৷
তবু তোমাদের কাছে তার গল্প করছি এই জন্যে যাতে আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা অন্তত তাকে মনে রাখবে৷
লোকটি একজন শিকারি৷ সে যে অঞ্চলে শিকার করে সেটা আসামের গোয়ালপাড়া জেলা৷ তার বাইরে সে শিকার করে না তা নয়, কিন্তু গোয়ালপাড়া জেলাতেই তার আধিপত্য বেশি৷
নাম তার সাত্তার৷ ওর বাবা মারা গেছেন বাঘের হাতে, এর মধ্যে ওরও ঘোরা হয়ে গেছে হাসপাতাল বার কতক বাঘের থাবা খেয়ে৷ খেতে গরুকে বাঘে ধরেছিল বলে ওর বাবা একদিন গিয়েছিলেন গরুকে উদ্ধার করতে৷ সোজা গিয়ে গরুর ঘাড়ে বসে থাকা বাঘকে গুলি করলেন৷ গুলি লাগল গায়ে কিন্তু তিরের মতো ঝাঁপিয়েও পড়ল বাঘ সাত্তারের বাবার ওপর, তারপর দুজনেই মাটিতে পড়ে গেলেন৷ সাত্তার তখন খুব ছোটো, ভালো করে জানেও না বন্দুক চালাতে৷ সে চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে বাবার অবস্থা দেখে পাগলের মতো বাবার হাত থেকে ছিটকে পড়া বন্দুকটাকে নিয়ে বাঘের বুকে ঠেকিয়ে দিল ঘোড়া টিপে৷ বাঘ মারল কিন্তু ওর বাবা বাঁচলেন না৷ সাত্তার বলে, ওর সান্ত্বনা, তাও তো মেরেছে পিতৃহন্তাকে নিজ হাতে।
একটি রাতের গল্পই বলি আজ৷ সাত্তারের সঙ্গে চলেছি পায়ে হেঁটে কচুগাঁওয়ের জঙ্গলের কাছে৷ বন্দুকে টর্চ লাগানো রয়েছে৷ হঠাৎ ডানদিকে ছোটো ছোটো ঝোপের পাশে চারটে সবুজ চোখ জ্বলে উঠল৷ অমাবস্যার রাত, কালির মতো অন্ধকার চারদিকে, চাইলে চোখ ব্যথা করে, রাতও প্রায় দুটো৷ সাত্তার বলল হরিণ৷ কিন্তু জন্তু দেখা যাচ্ছিল না—শুধু চারটে চোখ কখনও সবুজ, কখনও নীল জ্বল জ্বল করছে, সে চোখের দিকে চাইলে গা ছম ছম করে৷ সাত্তার ফিস ফিস করে বলল— চলুন, মারা যাক৷ এগোলাম সন্তর্পণে৷ যখন বেশ কাছাকাছি এসেছি, আবার আলো জ্বালতেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম৷ দেখি এক জোড়া বিরাট চিতাবাঘ, চুপ করে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে, লেজ দুটো শুধু এদিক-ওদিক করছে৷ সাত্তারকে ইশারা করলাম৷ বলল— ঠিক আছে, এগিয়ে চলুন, ঠিক মারা যাবে৷
বলেই সে এগিয়ে যেতে লাগল, বাধ্য হয়ে আমাকেও যেতে হলো ওর সঙ্গে৷ তখন আমরা বাঘের থেকে বড় জোর হাত পঁচিশেক দূরে, ওদিকে বাঘ আর বাঘিনি দুজনই কিন্তু গর গর করে আওয়াজ করতে আরম্ভ করেছে৷ সে-আওয়াজে যেন অত্যন্ত বিরক্তি মাখানো৷ ততক্ষণে আমরা আরও এগিয়ে গেছি, কাঁধে লাগিয়েছি বন্দুক যাতে যখনই দরকার হয় তখনই ছুড়তে পারি৷ সাত্তার যে এখন কেন গুলি ছুড়ছে না আর আমাকেও মারতে বলছে না, বুঝতে পারছি না৷
এদিকে বাঘেরা গর গর করেই চলেছে, লেজ আছড়িয়েই চলেছে৷ যে কোনো মুহূর্তে লাফিয়ে পড়তে পারে৷ আর লাফালে এই অমাবস্যার অন্ধকারে কেবলমাত্র টর্চ সম্বল করে গুলি করলে গুলি লাগবে কি না ভগবান জানেন৷ উত্তেজনায় ঘামতে থাকলাম আমি৷ আমরা তখন বাঘের প্রায় পনেরো হাতের মধ্যে এসে পড়েছি, এখন গুলি না করে ফেরার উপায়ও নেই৷ হঠাৎ, আমাদের সম্পূর্ণ চমকে দিয়ে বাঘিনিটা পেছনের জঙ্গলে ঢুকে গেল, এবং তার একটু পরেই বাঘটাও৷ যে ঝোপে তারা ঢুকল ঠিক তার পেছনেই একটা নালা ছিল, কোমর সমান জল প্রায় তাতে৷ বাঘ দুটো অদৃশ্য হতেই সাত্তার বলল টর্চ নিভিয়ে দিতে৷ নিভিয়ে দিলাম, নিভিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ আকাশে তখন মিট মিট তারার আলো৷
এবার সাত্তার বলল, বসে পড়ুন মাটিতে৷ ওর সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়লাম৷ মাটি থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরুচ্ছে, পিটাস ঝোপের থোকা থোকা ফুল থেকে বিশ্রী একটা বুনো বুনো গন্ধ আসছে৷ আমরা নিঃশব্দে বসে আছি সেই ঝোপটার দিকে চেয়ে, যে ঝোপটাতে বাঘ দুটো অদৃশ্য হয়েছে হঠাৎ৷
অনেকক্ষণ কেটে গেছে৷ এক মিনিট, দুই মিনিট, কত মিনিট কে জানে৷ ঝিঁঝিরা ডাকছে চিপ চিপ৷ ফিস ফিস করে সাত্তার বলল, বাঘ দুটো এক্ষুনি বেরুবে ওই শিশু গাছটার পাশ দিয়ে৷ খুব সাবধান, প্রথমে যেটা বেরুবে সেটাকে আমি ওইখানেই মারব, তারপর যেটা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আক্রমণ করবে, সেটাকে আপনার মারা চাই কিন্তু৷ উত্তেজনায়, ভয়ে আমার হাত ঘেমে গেছিল, তবুও সাহস দেখিয়ে বললাম, ঠিক আছে৷ কিন্তু আমার কথা বলার আগেই বোধহয় হুড়মুড় করে ঝোপ ভেঙে বেরিয়ে এল বাঘটা সোজা আমাদের দিকে৷ বিদ্যুতের মতো বেরিয়েই লাফ মারতে যাবে, কিন্তু লাফাবার আগেই সাত্তারের বন্দুক গর্জে উঠল৷ তীব্র আক্রোশে কাতরোক্তি করে বাঘটার সবল দেহ প্রায় গড়িয়ে এসেই থেমে গেল আমাদের কিছু সামনে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট গর্জন করে আকাশ-বাতাস, বন-জঙ্গল কাঁপিয়ে লাফাল বাঘিনী আমাদের উপর৷ এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে এত কাণ্ড ঘটে গেল৷ কী করে যে ওত তাড়াতাড়ি বিপদ এসে পড়ল, ভালো করে বোঝবার আগেই অস্পষ্ট আলোতে দেখতে পেলাম নখে দাঁতে চোখে মৃত্যুর ক্ষুধা নিয়ে লাফিয়ে পড়েছে, একটা আবছায়া প্রেত৷
সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজ্ঞাতেই বন্দুক তুলে গুলি করলাম আর গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই সরে যেতে চেষ্টা করলাম একপাশে লাফিয়ে৷ কিন্তু সরতেও পারলাম না, তাড়াতাড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম একটা জংলি কুলঝোপের উপর মুখ থুবড়ে৷ তার পরক্ষণে কী ঘটে গেল মনে নেই, দিব্যচক্ষে ভেসে উঠল আমার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহ৷ কিন্তু আমার ভাবনারও আগে বোধহয় সাত্তারের বন্দুক আবার গর্জন করে উঠল, আর শুনতে পেলাম আমার কাছেই কুলঝোপের ঠিক পাশেই সেই বাঘিনির আছড়ে পড়ার শব্দ৷ মনে হচ্ছিল যেন অজ্ঞানই হয়ে গেছি৷ সাত্তার সেদিন না থাকলে তোমাদের এই গল্প আর বলতে পারতাম না কোনোদিন৷ আমার গুলিটাও লেগেছিল, কিন্তু বাঘটা তখন প্রায় আমার মাথার উপরেই চলে এসেছিল৷ সেই বিপদের সময় একটুও বুদ্ধি না হারিয়ে বিদ্যুৎগতিতে সাত্তার যদি না বাঘের বুক লক্ষ্য করে নির্ভুল গুলি করত তবে মৃত্যুই আমার সাথী হত৷
যাই হোক, সে যাত্রা পুনর্জীবন লাভ করে যখন ভালো করে চাইলাম মাটির দিকে—ভারী আনন্দ হলো, বাঘ আর বাঘিনিকে দেখে৷ মৃত্যুর দোসরেরা মৃত্যুর কোলে৷ চোখেমুখে তখনও হিংসার ভাব ফুটে রয়েছে তাদের৷
ধন্য সাত্তারের সাহস, ধন্য তার নিশানা৷
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন