প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আমার প্রথম কাজ হলো ঘুমঘুম চোখে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করা। আজকেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ঘুম ভাঙার পর কম্বলের ভেতর থেকে হাতটা বের করে মোবাইলটা খুঁজলাম। হাতের নাগালে পেলে কচ করে মোবাইলটা কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলব। জিনিসটা অনেকটা গভীর পানিতে ডুব দিয়ে মাগুর মাছ ধরার মতো। কিন্তু আজ কোনোভাবেই ফোনটা হাতের নাগালে পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে কম্বলের ভেতর থেকে মুখটা বের করলাম। কিন্তু চোখ মেলে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই যা দেখলাম, নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারলাম না।
দেখলাম— আমার হাত দু'টো মানুষের হাতের মতো নেই। ছাগলের পায়ে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আঙুলের জায়গায় পায়ের খুর। সারা হাতে কালো কালো কেশ। হাতের এই অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলাম। ‘হোয়াদ্দা....’ বলে জোরে চিৎকার দিতে যাব, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। শুধু কয়েকবার 'ম্যাঁ ম্যাঁ' করে কর্কশ আওয়াজ বের হলো।
আমার সাথে এসব কী ঘটছে, কেন ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। মুহুর্তেই লাফ দিয়ে কম্বলের ভিতর থেকে বের হয়ে গেলাম। আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, আমার সমস্ত শরীর ছাগলের শরীরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ দেহ কালো কালো কেশে ঢেকে গেছে। আমার পা দুটোও ছাগলের পায়ের মত হয়ে গেছে। পেছনের দিকে ছাগলের লেজের মতো বিশেষ অঙ্গ গজিয়ে উঠেছে।
আমি কি তবে সত্যি সত্যি ছাগলে পরিণত হয়েছি? কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্ন দেখছি। দ্রুত চার পায়ে দৌড় দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি পুরাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সোজা বাংলায় যাকে বলে বাকরুদ্ধ।
আমার মাথায় দুইটা শিং গজিয়েছে। থুতনির নীচের চারটা দাঁড়ি। আমি কোনো কথা বলতে চাইলেই মুখ দিয়ে কেবল 'ম্যাঁ' 'ম্যাঁ' করে শব্দ বের হচ্ছে।
এভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে ওয়াশরুম থেকে বের হলাম। নিজের ভেতরে অস্থিরতাটাকে কাটানোর চেষ্টা করলাম। বিছানায় গিয়ে স্থির হয়ে বসলাম। নিজেকে নিজেই যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে— এটা আসলে একটা স্বপ্ন। আমি এখনো ঘুমের ঘোরে আছি। অথবা দিবাস্বপ্ন দেখছি। রাতে যে জিনিসটা খেয়েছি, তার প্রভাবে বোধয় এমন হচ্ছে। আমি নিজেকে বুঝালাম, একটা মানুষ কোনভাবেই ছাগল হয়ে যেতে পারে না। বিবর্তনবাদেও মানুষ থেকে ছাগলে পরিণত হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। এইসব যুক্তির সপক্ষে নানানরকম তত্ত্ব আমার মাথায় খেলা করতে লাগলো।
কিন্তু ধীরে ধীরে সব যুক্তিতত্ত্বকে নাকচ করে দিয়ে আমার মস্তিষ্ক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, আমি আসলে সত্যিই একটা চারপেয়ে ছাগলে পরিণত হয়েছি। কিন্তু ঠিক কোন প্রজাতির ছাগলে পরিণত হয়েছি, সেটা নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্দ আছে। দেশি প্রজাতির ব্ল্যাক বেঙ্গলও হতে পারি, আবার যমুনাপাড়ি বা রামছাগলও হতে পারি। অথবা সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির কোনো ছাগলও হতে পারি। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার ভেতরে কোন ধরণের ছাগলিক সত্ত্বা বিরাজ করছে।
হঠাৎ আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে স্যুট টাই পড়া কয়েকজন ভদ্রলোক আমার রুমে ঢুকে পড়লো। তারা আমাকে দেখে একটুও অবাক হলো না। বরং 'স্লামালাইকুম, স্যার' বলে সমবেত স্বরে একটা সালাম দিল।
আমি ওয়ালাইকুম আসসালাম বলতে চাইলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে কেবল 'ম্যাঁ' 'ম্যাঁ' শব্দই বের হলো। আমার মুখে ম্যাঁ ম্যাঁ শব্দ শুনে লোকগুলো মোটেও অবাক হলো না। তারা, 'স্যার, বসি' বলে সোফায় বসে পড়লো।
আমার যে একটা ছাগলে পরিণত হয়েছি, ওরা কি সেটা বুঝতে পারছে না? নাকি না বুঝার ভান ধরেছে? ভান ধরলেও তার পেছনের উদ্দেশ্যটা কী? আমার মাথায় কিছুই খেলছে না।
ওরা কেউ কিছু বলছে না কেন? আমি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, এখন আমি একটা ছাগল। নানানরকম অঙ্গভঙ্গি করেও আমার ছাগলিক সত্ত্বাটাকে প্রকাশের চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা উল্টো আমাকে 'জ্বি স্যার, জ্বি স্যার' করছে।
তাহলে কি আমি তাদের জন্য বিশেষ কোনো কেউ? বুঝতে পারছি না। যাই হোক, বেশ কয়েকবার বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম যে আমি এখন আর মানুষ নেই। আমি এখন একটা ছাগলে পরিণত হয়েছি। সেটা চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রত্যেকবার সেই চিৎকার পরিবর্তিত হয়ে ছাগলের ডাকে রূপ নিচ্ছে। 'ম্যাঁ' 'ম্যাঁ' ছাড়া আর কোন শব্দই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
এভাবে 'ম্যাঁ' 'ম্যাঁ' করতে করতে একবার আমার মুখ দিয়ে বিড়ালের মতো 'ম্যাঁও' ধ্বনি বের হয়ে গেল। আর আমার মুখের 'ম্যাঁও' শুনে উপস্থিত ভদ্রলোকগুলো হো হো করে হেসে উঠলো।
তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, 'আপনি এত রসিকতা করেন না, স্যার! আপনার মধ্যে এত রসবোধ, মাশাল্লাহ!' একজন উঠে বললো, 'স্যার, আপনার একদিন মীরাক্কেলে যাওয়া উচিত।' আরেকজন বললো, ‘অথবা কপিল শর্মা শোতে যেতে পারেন।‘
আমি জবাবে 'ম্যাঁ' 'ম্যাঁ' করে ডাক দিলাম।
এরমধ্যে আরেকজন ভদ্রলোক এসে ঢুকলো রুমে। আমি তাকেও চিনতে পারলাম না। রুমে ঢুকেই সে আমাকে সালাম দিল। তারপর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘পোলাপান রেগে আছে, স্যার। কিছু করেন।’
তারপর আরও কিছু কথা বললো। এসব কথা শুনে আমি রেগেমেগে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু যথারীতি আমার কোনো চিৎকারই বাইরে বের হলো না শুধুমাত্র 'ম্যাঁ' 'ম্যাঁ' শব্দ ছাড়া।
আমার ম্যাঁ ম্যাঁ শুনে লোকটা তার জবাব পেয়ে গেল। তারপর ‘ওকে,স্যার। মিডিয়াকে তাহলে এই কথা-ই জানিয়ে দিচ্ছি, স্যার। স্লামালাইকুম, স্যার।’ বলে বের হয়ে গেল। তার সাথে সাথে সোফায় বসা ভদ্রলোকগুলোও ‘আমরা সবসময় আপনার পাশেই আছি স্যার, কোনো চিন্তা করবেন না স্যার, এখন আসি স্যার, স্লামালাইকুম স্যার’ বলে বের হয়ে গেল।
রুমে পড়ে রইলাম কেবল আমি...একটা নতুন প্রজাতির ছাগল।
...
পরদিন সকালে......
আমি এখন সোফায় বসে আছি। ইতোমধ্যে আমার ছাগলে পরিণত হওয়ার ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। এরমধ্যেই নানান ঘটনা ঘটে গেছে। সকালে একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে কিছু কাঁঠালপাতা দিয়ে গেছে আমার সামনে। তারপর থেকে আমি সোফায় বসে বসে সেই কাঁঠাল পাতা চিবুচ্ছি। আনার কাছে এই কাঁঠালপাতার স্বাদ অনেকটা সুলতান্স ডাইনের কাচ্চির মতো মনে হচ্ছে। কাচ্চির কথা মনে পড়তেই মনে হলো, আহারে! আমার মতো ছাগলগুলাকেই তো জবাই দিয়ে কাচ্চি বানানো হয়। কী জানি! হয়তো আমি নিজেই কাচ্চি হয়ে একদিন অন্যের পেটে চলে যাব! কী নির্মম! কী নৃশংস! আহা!
কাঁঠালপাতা খাওয়া শেষ হলে আমার পিএস এসে একটা পত্রিকা দিয়ে গেলো। পত্রিকা খুলতেই দেখি, পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল করে আমার একটা ছবি ছাপা হয়েছে। জার্নালিস্টরা গতকাল বিকেলে এসে ছবিটা তুলে নিয়ে গেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আমি— মানে একটা নতুন জাতের ছাগল, চেয়ারের উপর পা তুলে বসে আছি। ছবিটার উপরে মোটা হরফে লেখা পত্রিকার হেডলাইন —‘কিছুতেই গদি ছাড়বেন না উনি।’
সামনে পড়ে থাকা কাঁটাল পাতাটা তৃপ্তির সাথে চিবিয়ে আমি ডেকে উঠলাম, ‘ম্যাঁ… ম্যাঁ…’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন