করোনাভাইরাসের ঢাকা সেক্টর কমান্ডার নির্দেশ দেন, 'এবার অপারেশন বুক ফেয়ারে যেতে হবে তোমাদের।' করোনা সৈনিকেরা বেঁকে বসে। এক করোনা মেরিন বলে, 'স্যার যদি বেয়াদবি না নেন একটা কথা বলি; সারা দুনিয়া ঘুরে এতো ভালো ভালো বই পড়ে এইসব ট্র্যাশ বই পড়া আমাদের পক্ষে আর সম্ভব না।'
সেক্টর কমান্ডার খুশিজলে চুমুক দিয়ে বলেন, 'সে কী; টিভিতে দেখি এতো লেখক নক্সী পাঞ্জাবি পরে সাক্ষাৎকার দেয়; কী একটা আলো পত্রিকায় সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ের রিভিউ দেয়; লেখকদের দক্ষিণীয় গামছা পরিয়ে সম্মাননা দেয়। তারা নিশ্চয়ই ভালো বই লেখে। তোমরা না পড়েই সমালোচনা কোরোনা করোনাসব।'
ডেপুটি সেক্টর কমান্ডার করোনা সৈনিকদের ধমক দিয়ে বলেন, 'এইখানে যে সংখ্যক লেখক ফেসবুক লাইভ করে; এতো সংখ্যক লেখক তো গোটা বিশ্বে ফেসবুক লাইভ করে না। প্রিয় সৈনিকেরা প্লিজ তোমরা বইমেলায় যাও। পড়ে এসো আলোক গ্রন্থগুলো। এটা কবিতার দেশ; গানের দেশ। আমি কিন্তু বিউটি বোর্ডিং আর রেকসের সাহিত্য আড্ডার অনেক নাম শুনেছি।'
একজন করোনা মেরিন বলে, 'স্যার কবে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছিলো এরা; সেই হাত শুঁকে আর লাভ নেই স্যার। এখানে এখন দলীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাহিত্য পুরস্কার দেয়। ঐ ধরেন রাজনীতির মাজারের স্তবকীর্তন কিংবা বিষাদসিন্ধু টাইপের ভেউ ভেউ কান্নার আবছায়া সাহিত্যকেই সাহিত্য বলে গণ্য করা হয়। এইভাবে তো আর জীবনমুখী সাহিত্য হয় না।'
সেক্টর কমান্ডার বলেন, 'বি স্পেসিফিক; ফেসবুকের ক্রিটিকদের মতো জেনেরিক কমেন্ট কোরোনা।' এক করোনা মেরিন একটা বই খুলে বলে, 'এই বাতাবি লেবু নামের বইটা প্রবন্ধ না উপন্যাস নাকি জীবনী তা বুঝতেছি না। কিন্তু গোটা বিশেক লোক পিঠ চুলকে দিচ্ছে লেখকের, বাহ বাহ বলে; অমনি সাহিত্য পাতায় কিছু রিভিউ; বাতাবি মিডিয়ায় ইন্টারভিউ; লেখকের লেখার চেয়ে সাজ গোজ, গাম্ভীর্য, দেশপ্রেমের গভীর প্রণতি এগুলোই তখন বিবেচ্য; কনটেন্ট তো দেখছি জিরো।'
ডেপুটি কমান্ডার বলেন, 'আরেকটা বই দেখাও দেখি।' করোনা সৈনিক আরেকটা বই দেখিয়ে বলে, 'এটা একটা সোনালি আঁশের মতো চুলের লেখকের বই; সে শুধু ম্যাঁ ম্যাঁ করে কাঁদছে। জোলো গদ্য; জোর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঢেলে দিচ্ছে। রঙ্গভবনে জাতির আপার সঙ্গে পিঠাপুলির আসরে ছবি তুলে লেখক রাজ লেখক হয়ে উঠেছে। আমি তো স্যার এর বইয়ের দুই প্যারার বেশি আগাইতে পারিনা। ভুল হয়েছে স্যার ইউভাল নোয়াহ-র বই পড়াটা। টেস্টটা এতো উপরে উঠে গেছে; যে এইখানে যা দেখি ঐটাই ট্র্যাশ লাগে।'
কমান্ডার বলেন, 'ইউভাল নোয়াহ-র অনুবাদ কেমন হয়েছে দেখে এসো।' করোনা সৈনিক বলে, 'দেখেছি স্যার ইংরেজি বাক্যে যে 'দ্যাট' থাকে ঐটার সরাসরি অনুবাদ করে 'যে' বসিয়ে দেয়; অমনি বাংলা বাক্যের কাঠামো ঝুর ঝুর করে খুলে গিয়ে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।'
ডেপুটি কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন, 'বেস্ট সেলারগুলো নিশ্চয়ই পড়া যায়।' আরেক করোনা সৈনিক উত্তর দেয়, 'বেস্ট সেলার ভদ্রলোক বাদশা হুমায়ূন মারা গেছেন। তারপর থেকেই উনার কতগুলো কপিক্যাট বেরিয়েছে; এক্কেবারে খারাপ ছাত্র ওগুলো। নেহাত পাঠকের অবস্থা ত্যানা হয়ে যাওয়ায় ওরা এসব গামছা কিনে নিয়ে যায়।'
কমান্ডার বলেন, 'শিওর তো তোমরা পড়ার মতো কোন বই নেই!' করোনা সৈনিক বলে, 'কেউ ধরেন প্রয়াত সেলিম আল দীনকে অনুসরণ করে মহাকাব্যিক দ্যোতনায় উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্যার আপনি তো জানেন স্যার শেক্সপীয়ারের কাজ সেক্সপেয়ার দিয়ে হয় না।'
ডেপুটি কমান্ডার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, 'যাই বলো; এদেশের কবিতার অনেক নাম শুনেছিলাম।' করোনা সৈনিক বলেন, 'সেই সোনালি প্রজন্মের কবিরা প্রয়াত। তাদের একজন বলেছিলেন, "সব হালায় কবি হইতে চায়।" তার কথাই সত্যি হয়েছে স্যার।'
কমান্ডার বলেন, 'অনেক উজ্জ্বল ছিলো এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত। কী হলো সত্যি বুঝতে পারছিনা।' করোনা সৈনিক বলেন, 'এইখানে সহমতযন্ত্র আর হেফাযতযন্ত্রের প্রেসে বই ছাপে। সুতরাং দেশপ্রেম চেতনা আর ধর্মপ্রেম চেতনায় সব শেষ হয়ে গেছে স্যার। বাক-স্বাধীনতা নাই। পুলিশ বইয়ের গন্ধ শুঁকে দেখে কোনটা উন্নয়নের সরকার বিরোধী; কোনটা ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। এইখানে টেকাটুকাটাই এখন আসল। বরং দুর্নীতিবাজ আর উন্নয়নের ঋণখেলাপি পদ্ম-শাপলাদের প্রাসাদ্গুলোতে অপারেশান চালাই স্যার।'
ডেপুটি কমান্ডার আরেকটু অনুরোধ করতে গেলে এক করোনা মেরিন হাত জোড় করে বলে, 'ড্যান ব্রাউন কিংবা পাওলো কোয়েলহো পড়ার পর; এইসব বই পড়তে গেলে অজ্ঞান হয়ে যাবো স্যার। আমাদের মাফ করে দেন।'
কমান্ডার নির্দেশ দেন, 'ঠিক আছে; প্যাক আপ। অপারেশান বুক ফেয়ার এবানডন করা হলো।'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন