স্কুল থেকে যে আমরা পালাতাম, এখনো পালাতে চাই কিন্তু বড় হয়ে যাওয়ায় আর আমরা পারি না। সবকিছু থেকেই পালাতে চাই... এই পালিয়ে বেড়ানোই আমাদের নিয়তি। সবকিছু থেকে। কথা বলা থেকে... কথা শোনা থেকে... কথার মারপ্যাঁচ থেকে;কথার এক্কা দোক্কা খেলা থেকে। কিন্তু তাই কী হয়; জীবন এখন বসিয়ে রেখে টকশো শোনায়; ভাট বকে কান ঝালাপালা করে দেয়। বয়স হলেই পালানোর পথগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়। 'দমে জীবন দমে মরণ; শুধুই দমের খেলা; জগতের এই জেল-হাজতে ক্যান যে ফাটক দিলা!'
করোনার অজুহাতে অফিস পালিয়ে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করলেও আজকাল করোনার ভ্যাকসিন দিতে ধরে নিয়ে যায় হাসপাতালে। ভ্যাকসিন দেয়ার কথা শুনে আত্মা শুকিয়ে যায়; যদি মুখ বাঁকা হয়ে যায়; যদি টেঁসে যাই; যদি শিং গজায়! কতো দুঃশ্চিন্তা যে মাথায় মাকড়সার জাল বুনে। কিন্তু ভ্যাকসিনাররা বোঝায়, আপনাকে করোনা ভ্যাকসিনের মডেল হতে হবে; আপনাকে ভ্যাকসিন নিতে দেখে সবাই সাহস পাবে। আপনার একটা দায়িত্ব আছে না! প্লিজ বাচ্চাদের মতো করবেন না। প্রাক-বৃদ্ধ বলে শিশুকালের মতো ভয় পেয়ে ভেউ ভেউ করে একটু কাঁদারও উপায় নাই। বড়ই পরিতাপের বিষয়। বড্ড অভিমান হয় এই ভ্যাকসিন পাপীদের প্রতি। মনের মধ্যে বিড় বিড় করে, ভ্যাকসিনার কোথাকার। ভ্যাকসিনার দ্যান ভ্যাকসিন।
ছোট বেলায় আমরা স্কুল থেকে পালাতাম; ক্লাস বোরিং লাগলে; কোথাও একটা ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে কিংবা সিনেমায় নতুন একটা কুংফু কারাতের ছবি মুক্তি পেলেই স্কুল পালাতে হতো; অথবা টিফিন আওয়ারে কোক চিপস খাওয়ার আসরে বেণী দুলানো কিশোরীর সঙ্গে গল্প জমে গেলে বাছুরের মতো স্কুল থেকে পালাতে হতো।
কিন্তু বড় হয়ে যাবার পর সেই অফিস পালানোর ইচ্ছাটা থাকলেও; আর তো পালানো যায় না। অফিসের ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর মার্কা জোর করে লম্বা করা মিটিংয়ে ঘুম ঠেলে এলেও; অফিসের মুখ ও সুখ রক্ষার্থে সেসব ট্র্যাশ হজম করতে হয় আধঘুমে; আধ জাগরণে। কিংবা ইউনিভার্সিটি থেকে তিনঘন্টার ম্যারাথন ক্লাসের ব্রেকে পালিয়ে কারো কফি পানের আহবানে সাড়া দিতে ইচ্ছা হলেও মনে হয়; ছাত্র হলে বিশ্ববিদ্যালয় পালানোর কাজটা করা মানিয়ে যায়; শিক্ষককে কী এসব মানায়! তাহলে যে ক্লাস পালানো ছাত্রদের হিতোপদেশ দেবার থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যাবে।
শিশুকাল ছিলো ভালো; যৌবন পেরিয়ে প্রাক বৃদ্ধকাল কেন আসিলো! পালাইয়া কোক-চিপস খাইবার বাছুরকাল ছিলো ভালো; বলদকাল কেন আসিলো; যখন কফি খাওয়ার ফজিলত হ্যাশট্যাগ মি টু হওয়ার আশংকায় দুরু দুরু করে। পালানোর ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই; নাই নাই এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নাই।
শিশুকালে একবার বিসিজি টিকা দিতে মেডিক্যাল টিম বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইলে; ক্লাসমেটদিগকে চিঁ চিঁ করা মুরগীর বাচ্চার মতো ধরিয়া; টিকা দিতে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে লইয়া যাইবার দৃশ্য দেখিয়া; এইদিক ঐদিক দুইবার তাকাইয়া ভোঁ দৌড় দিয়া বাটিতে পৌঁছাইয়া শুনি; স্কুল হইতে ফোন আসিয়াছে। মেডিক্যাল টিম স্কুল হইতে ফিরিবার পথে প্রয়োজন হইলে বাটিতে আসিয়া টিকা দিবে; যেহেতু উহা বাধ্যতামূলক। হা-পা ছুড়িয়া কাঁদিয়া কাটিয়া লাভ হইলো না। ধূমপান করিতে করিতে পিতৃদেব বলিলেন, বিসিজি টিকা না দিলে যক্ষা হইবে খোকা। রাজি হইয়া যাও; উহাতেই মঙ্গল।
মায়ের আঁচলের তলায় লুকাইয়াও লাভ হইলো না। বাটিতে বেড়াইতে আসা প্রিয় মামা অকস্মাৎ অপ্রিয় পুলিশের রূপ গ্রহণ করিলেন; তাহার দুলাভাইকে তুষ্ট করিতে। অবশেষে পিতৃদেব ও মামা প্রায় চ্যাং দোলা করিয়া তুলিয়া বিদ্যালয়ের পানে ছুটিলেন। পথিমধ্যে খোকার গগণবিদারী কান্নার শব্দ শুনিয়া পরিচিত লোকেরা এই চ্যাং দোলার কারণ শুনিয়া চুক চুক করিয়া বলিলেন, কী হয় টিকা না দিলে; আমরা তো টিকা দিই নাই কস্মিনকালে; তাহাতে কী হইয়াছে; কচু হইয়াছে! আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে মাতৃদেবীও এই টিকাগামী চ্যাংদোলার সমভিব্যহারী হইলেন। অবশেষে আসিলো সেই ভয়ংকর পল...
চারপাশে টিকা গ্রহণকারী মুরগীর বাচ্চারা তখনো চিঁ চিঁ করিতেছিলো; মেডিকেল টিমের তখন চোখে পড়িলো চ্যাংদোলার মুরগীর বাচ্চাটির দিকে। তাহারা এমনভাবে তাকাইলো, যেন মনে মনে বলিতেছে, পালাইবে কোথায় বাছাধন! বেঞ্চিতে বসাইয়া মামা চাপিয়া ধরিলেন; পিতৃদেব অভয় দিলেন; মাতৃদেবী আঁচল দিয়া চক্ষুজল মুছিয়া দিলেন; প্রধান শিক্ষক মহোদয় মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন; আর মেডিকেল টিমের টিকা দানকারী সেভলন দিয়া পরিষ্কার করিয়া বাহুর ওপরের দিকে টিকাস্থানের নিশানা প্রস্তুত করিলেন।
তাহার পর কী হইতে যে কী হইয়া গেলো; সবাই হাততালি দিয়া কহিলো, এই তো গুড বয় গুড বয়; টিকাদান সম্পন্ন হইয়াছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন