দেশের এই ক্রান্তিকালে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাসভবনে এক জরুরি মিটিং ডেকেছেন।
মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যবৃন্দ, পুলিশ আর র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান, রোডস এন্ড হাইওয়েসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সভায় বসে একে অন্যের দিকে বিরস মুখে তাকাচ্ছেন। সভার আলোচ্যসূচি অপ্রীতিকর, এ ধরণের সভার সিদ্ধান্ত আগেভাগে বলা যায় না। কখন কার উপর প্রধানমন্ত্রীর খড়গ নেমে আসে, বলা মুশকিল।
যোগাযোগমন্ত্রী নিজের টাইয়ের নট ঠিক করে নিলেন, বার দুয়েক কপাল থেকে ঘাম মোছার ভঙ্গি করলেন, যদিও রুমের তাপমাত্রা এসি যন্ত্রের কল্যাণে অনেকটাই শীতল। শুধুমাত্র বাণিজ্যমন্ত্রীকে দেখা গেলো খানিকটা হাসিখুশি, এক ফাঁকে পাশে বসা অর্থমন্ত্রীর সাথে খানিকটা কৌতুক করে নিলেন, একপেশে কৌতুক তেমন জমলো না।
প্রধানমন্ত্রী সভায় ঢুকার সাথে সাথে সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনুচ্চস্বরে কিছু সালামের আওয়াজ ভেসে আসলো। বিরক্ত ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ইশারা দিয়ে বসতে বললেন।
-ভাঁড়টা কই?
প্রধানমন্ত্রীর কথায় সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। ভাঁড় বলতে তিনি কাকে বুঝাচ্ছেন, এটা যখন সবার কাছে খানিকটা পরিস্কার হচ্ছে, সেই মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী আবার কথা বলে উঠলেন,
-বাইরে বসে থাকুক, ভেতরে আসার দরকার নেই। ওর এখনো এইসব সভায় বসার মত যোগ্যতা হয়নি, সারাজীবনে হবেও না। সরাসরি পয়েন্টে আসি, কী করা উচিত এই মুহূর্তে? কারো কোনো সাজেশন থাকলে বলেন।
সবাই চুপ করে আছে। আগ বাড়িয়ে কথা বলে কেউ প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হতে নারাজ।
তিনি এতে অভ্যস্ত, তাঁর ভুরু কুঁচকে গেলো বিরক্তিতে। একটাও যদি ভরসা করার মত লোক থাকতো।
-অ্যাক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?
সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রীর দিকে সবাই তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। তিনি ইতস্তত করে জবাব দিলেন
-ড্রাইভারের সমস্যা। নিজেরা কম্পিটিশন করে ছাত্র মেরে ফেলেছে। এদের লাইসেন্সও ঠিক নেই। তাছাড়া গাড়ির ফিটনেস লাইসেন্সেও সমস্যা ছিলো।
প্রধানমন্ত্রী ভাবলেশহীন চোখে বিআরটিএ'র পরিচালকের দিকে তাকালেন।
-আমার লোকজন যে করাপ্টেড এটা অস্বীকার করবো না। আমি কড়াকড়ি করার চেষ্টা করছি। তবে এসবের পেছনে পুলিশেরও হাত আছে। তারা কিভাবে লাইসেন্স ছাড়া লোকজনকে রাস্তায় গাড়ি চালাতে এ্যালাউ করে? গাড়ির ফিটনেস না থাকলে গাড়ি কিভাবে রাস্তায় চলে? আমার লোকজনতো ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় গিয়ে আটকাতে পারবে না। এসব ঘুষ বাণিজ্য আগে রাস্তায় বন্ধ করতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খানিকটা ধমক দিয়ে বললেন-
-কিছু হলেই আপনারা পুলিশের দোষ খুঁজেন। এখন, এতোকিছুর পরে কে পরিস্তিতি সামাল দিচ্ছে বলবেন? জানের মায়া না করে পুলিশরা ছাত্রদের আটকাতে ব্যস্ত। আপনারা তো অফিসে এসিতে বসে অফিস করছেন, ওইদিকে ফেসবুকে শুধু পুলিশের বদনাম আর ছবি, যেনো সবকিছুর জন্য পুলিশ দায়ী। অ্যাক্সিডেন্ট যেখানে হলো, সেখানে একটা স্পীড ব্রেকার পর্যন্ত ছিলো না, এইটাও কি পুলিশের দোষ?
-স্পিড ব্রেকারসহ বাকি রাস্তার সংস্কারের যে ফাইল, তা ছয় মাস ধরে অর্থমন্ত্রীর টেবিলে পরা আছে। এটা নাকি জনগুরুত্বপূর্ণ না, এই কারণে টাকা স্যাংশন হচ্ছে না।
যোগাযোগমন্ত্রী খানিকটা অভিযোগ নিয়েই বললেন।
-কী সব রাবিশ, একটা দিন আপনি আমাকে এটা নিয়ে বলেছেন? এখন এটা খুব ইম্পরট্যান্ট মনে হচ্ছে তাই না? টাকা কী আমি আসমান থেকে এনে দিবো? আমি টাকা দিবো আর আপনারা সবাই মিলে মিসইউজ করবেন। এনাফ ইজ এনাফ।
প্রধানমন্ত্রীর মনে হলো তিনি এক চক্রের মধ্যে আটকা পরে আছেন, এই চক্র থেকে বের হবার রাস্তা তাঁর জানা নেই।
যুদ্ধক্ষেত্রে একা যুদ্ধ করতে করতে তিনি এখন ক্লান্ত, তিনি বৃথাই আশেপাশে তাকালেন খানিকটা সাহায্যের আশায়।
এতদিনের ভাল কাজ মাঠে মারা যাচ্ছে, এখনই কিছু করে দেখাতে না পারলে দ্রুতই জনসমর্থন হারাতে হবে।
কাউকে কিছু না বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সভায় উপস্থিত বাকিরা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলো। আপাতত বিপদ সামলানো গেলো।
পুলিশের আইজি তাড়াহুড়ো করে উঠে চলে গেলেন, তাঁর গল্প করার সময় নেই, হাতে এখন অনেক কাজ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সভায় নতুন এক ইস্যুতে তর্ক জমে উঠলো। দেশের বাইরে সব মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে, এই ড্রেইন আউট কিভাবে ঠেকানো গেলে দেশের ভবিষ্যত ভাল হবে- এই নিয়ে সবাই মতামত প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
দরজায় দাঁড়ানো সিকিউরিটি অফিসারের দীর্ঘশ্বাস এসব তর্কের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন