আনু মালিক যে ইসরায়েলের জাতীয় সঙ্গীত কপি করেছেন, সেটা নাকি ২৫ বছর পর আজ অলিম্পিকে ইসরায়েলের জাতীয় সঙ্গীত বাজার পর আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউনসহ দেশের অনলাইন মিডিয়াগুলো এমনটাই লিখেছে।
প্রকৃতপক্ষে এই তথ্য অনেক আগেই আবিষ্কৃত। অলিম্পিকের সৌজন্যে আবারও এটা সামনে এলো আর কি। আবিষ্কার হওয়া আর নতুন করে সামনে আসা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সাংবাদিক এই তথ্যটি জানেন না, সেটা তার অজ্ঞতা। অজ্ঞতাকে ‘আবিষ্কার’ বা ‘২৫ বছর পর ধরা পড়া’ বলা অনুচিত। একজন সাংবাদিক পৃথিবীর সব তথ্য জানবেন, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু লেখার আগে তিনি একটু খুঁজেটুজে দেখতেই পারেন। ইউটিউব বা গুগল করে বিষয়টা জানা এত কঠিন কিছু না। ভারতের বেশিরভাগ মিডিয়া এই সংবাদটি জানাতে গিয়ে ‘আবিষ্কার’ বা ‘জানা গেল’ লেখেনি। তারা ফোকাস করেছে ‘ট্রল’ শব্দটির ওপর। ‘ইসরায়েলের জাতীয় সঙ্গীত চুরি করে ট্রলের শিকার হলেন আনু মালিক’—ভারতীয় মিডিয়াগুলোর শিরোনাম মূলত এমনই। কেউ কেউ চুরি বা নকল করাতেও ফোকাস করেছে, তবে আবিষ্কারের কথা সম্ভবত লেখেনি।
আমি নিজেও এই তথ্যটা জেনেছি মাত্র এক বছর আগে। লকডাউনে যখন বাইরে যাওয়া হতো না, মানুষ এক কেজি চাল বা ডালে থাকা দানার সংখ্যা গুনত বসে বসে, তখন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের গান খুঁজে খুঁজে শুনতাম। শুনতে গিয়েই হঠাৎ হঠাৎ অচেনা গানে চেনা সুর দেখে থেমে যেতাম। একটু ঘাটতেই বুঝতে পারতাম আনু মালিকসহ বলিউডের কালজয়ী সঙ্গীত পরিচালকদের অনেকেই কপিক্যাট! বলিউডের গানের ভিত্তিটাই যেন তৈরি হয়েছে নকলের ওপর। বলিউড-ঢালিউডের কপি করা অনেক গানের কথা আগে থেকেই জানতাম, লকডাউনের সেই সময়টায় সংখ্যাটা আরও বাড়ল। ইউটিউবে ভারতীয়দেরই করা অনেক ভিডিও আছে যেখানে তারা গান কপিবাজদের এক্সপোজ করেছেন। গুগল করলেও অনেক আর্টিকেল পাওয়া যায়।
গান কপিবাজদের তালিকায় নামগুলোও বেশ অবাক করা। আর ডি বর্মণ থেকে নাদিম-শ্রাবণ হয়ে প্রীতম—কপি করেছেন প্রায় সবাই-ই! গান মেরে দেওয়া বিষয়ে অভিযোগের তির আছে এ আর রহমানের দিকেও। তবে সবচেয়ে বেশি কপি করেছেন সম্ভবত আনু মালিকই।
কিন্তু আনু মালিক যে একজন প্রতিভাবান কপিবাজ, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। ‘দারুণ সব গান’ কপি করে ‘দারুণ সব গান’ই তৈরি করেছেন তিনি! বিশ্বের এমন কোনো প্রান্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখান থেকে তিনি সুর বা টিউন কপি করেননি! ফলে তার করা মিউজিক শুনলে বিশ্বের অনেক ভালো গানই শোনা হয়ে যায়! আমি তার কোনো ভালো গান শুনলে সন্দেহাতীতভাবে ধরে নেই যে গানটা কোথাও থেকে কপি করা। কপি করা গানটাই এত সুন্দর, না জানি আসল গানটা কত ভালো—এই ভেবে একটু ঘাটাঘাটি করে মূল গানটা বের করি। তারপর মূল গানের শিল্পীর অন্যান্য গানগুলো শুনি। এভাবে আরও নানা রকম গান শোনা হয়ে যায় আমার।
এমন উপকারি আর প্রতিভাবান কপিবাজও তো এখনকার যুগে পাওয়া মুশকিল!
আনু মালিক জীবনে অনেক গান কপি করেছেন, কিন্তু একটা দেশের জাতীয় সংগীতও মেরে দিয়েছেন, ব্যাপারটা প্রথমে হজম করতে একটু কষ্ট হয়েছিল। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছি। ইসরায়েলের জাতীয় সংগীতের সুর খুবই সুন্দর, তবে সেটি মেরে দিয়ে ‘দিলজালে’তে তিনি যে ‘মেরা মুলক, মেরা দেশ’ বানিয়েছেন, খারাপ হয়নি সেটাও। আর কপিবাজতো তো কপিবাজই, কপি করার জন্য তার কাছে সব গানই নিশ্চয় সমান।
যাহোক, এই যে অলিম্পিকে গান বাজার পর কপির বিষয়টা সামনে এলো আবারও, এমন ঘটনা কিন্তু আগেও ঘটেছিল। ২০০৬ সালে ইতালির ফুটবল বিশ্বকাপজয় উপলক্ষে রোমে এক কনসার্টের আয়োজন করা হয়। সেই কনসার্টে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তোতো কুতুনিয়ো পরিবেশন করেন তার বিখ্যাত গান ‘লা ইতালিয়ানো’। স্টেডিয়ামে থাকা ভারতীয় দর্শকেরা অবাক হয়ে খেয়াল করে, এই গান তো তাদের চেনা! আমির খানের ‘মান’ চলচ্চিত্রের সুমধুর গান ‘নাশা ইয়ে পেয়ার কা নাশা’র সুর এটি!
তারপর অবশ্য বুঝতে বেশি দেরি হলো না কারো, ভারতীয় সংগীতপরিচালক সঞ্জীব-দর্শন নাশা ইয়ে পেয়ারের সুরটি কপি করেছিলেন তোতো কুতুনিয়োর লা ইতালিয়ানো থেকেই।
মান চলচ্চিত্রে ৫টি খুবই জনপ্রিয় গান আছে। বলাই বাহুল্য, ৫টিই কপি করা!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন