সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা
তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা
সখি গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি
তোমার কাছে পয়সা নেবো না…
ঈশ্বরদী প্লাজা সিনেমার রুপালী পর্দায় যখন ফারুক এই গান গেয়ে উঠলেন; দর্শক আনন্দে দুলে উঠলো; সখী তখন রোমান্টিক লাস্যে নাকছাবিতে আমন্ত্রণ ও প্রত্যাখ্যানের সরল দোলক দুলিয়ে দিলেন যেন।
এক একটা ছবি মুক্তি পেলেই প্লাজা সিনেমার ম্যানেজার শংকর মেহতা জানতেন; হাউজ ফুল হলেও টিকেট কিনতে আসবে স্কুল পড়ুয়া এক বালক।
সেই সোনালী যুগে বাবা-মা-ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বসে দেখার মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। পাড়ার রাস্তায় পোস্টারওয়ালা রিক্সায় মাইকিং করতে করতে গেলে; আছেন চিত্রনায়ক ফারুকককক.. বললেই ভেসে উঠতো সেই নির্মল হাসির কোঁকড়া চুলের যুবক; যে ফ্রিউইল এজেন্ট,যে পরোপকারী, প্রেমিক, দ্রোহী এবং একজন ভালো মানুষ। সমাজের চলমান শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বে ফারুক ছিলেন শুভ'র প্রতীক; যে লড়াই করে ন্যায়বিচার এনে দেয় সমাজকে।
কবরী, শাবানা-ববিতা-সুচরিতা; সোনালী যুগের এই স্বপ্ন কন্যাদের বাঁশিওয়ালা ছিলেন ফারুক। একটু লাজুক-একটু বেহিসেবী-একটু একরোখা অথচ সরল এক নদী মানুষ।
আবহমান বাংলাদেশের সুরের মানুষেরা ঠিক যেমন স্নিগ্ধ স্বপ্নবান হন; তেমনি ছিলেন ফারুক। সেই সোনালী যুগ ছিলো প্রেমের কঠিন পরীক্ষার যুগ। কবরী-শাবানা-ববিতা-সুচরিতা-অঞ্জনা-নূতন; অহংকারে মাটিতে পা পড়তো না এই রাজকুমারীদের। আর ছিলেন এদের কড়া বাবা; কিংবা কুটিল খালা; যারা প্রেমের শত্রু। যারা রাজকুমারীর জন্য প্রতিষ্ঠিত রাজকুমার খুঁজতেন।
ফারুক ছিলেন বেহিসেবী; জীবনকে খোলামকুচির মতো খরচ করে গাইতেন,
নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে,
চোখের তারায় রং জমেছে,
এখন কোনো দুঃখ নেই,
নেই কোনো ভাবনা,
এমন করেই দিন যদি যায় যাক না।
কিন্তু দিন তো সহজ নয় চোখে রঙ লাগা মানুষের জন্য। তাকে নিজের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয় হিসেবের খাতা নিয়ে বসে থাকা সমাজের হিসাব রক্ষকদের কাছে।
তবু সে যুগের মেয়েদের মাঝে সমানুভূতি ছিলো; অল্পে তুষ্ট হবার মন ছিলো। গ্রামের মেলায় নাগরদোলায় দুলিয়ে দিতে পারলেই; সেই দোলা পৌঁছে যেতো তাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে।
ফলে ফারুককে তেমন বেগ পেতে হয়নি। সবার হৃদয় জয় করেছেন মোহন হাসির ছোয়ায়।
ক্যারিয়ারে প্রথম থেকে ফারুক নজর কেড়েছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমানের। যার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়েছিলেন তিনি। এরপর আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, প্রমোদ করের মত পরিচালকরা তাদের সিনেমায় বেছে নেন ফারুককে।
সারেং বউ, লাঠিয়াল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে, জনতা এক্সপ্রেস, সাহেব, মিয়াভাই, নাগরদোলা, সুজনসখী’, ঘরজামাই, ভাইভাই, বিরাজবৌ এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান খ্যাতিমান এই অভিনেতা।
ফারুক বাংলাদেশ মুক্তির মন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত এক যুবক; মুক্তিযুদ্ধ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধের পর চলচ্চিত্র জগতকে ভালোবাসার রং-এ রাঙ্গিয়েছেন এই মিয়া ভাই।
কিন্তু যা হয়, মুক্তির মন্ত্র যখন শাসন-শোসনের যন্ত্র হয়; তখন চলচ্চিত্র নায়ক হিসেবে অমরতার আয়োজন করা কিংবদন্তীর নায়কের ইচ্ছা জাগে সংসদের শেয়ার বাজারে যোগ দিতে।
চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে ফারুকের মা তাকে খাবারে বিষ দিয়েছিলেন; বিষে নীল ফারুক গলা চেপে ধরে আর্তনাদ করেছিলেন, আমায় কী খাওয়াইলিরে মা!
মায়ের সেই বিষ যেন ছিলো ক্ষমতার রাজনীতি; সাড়ে পাঁচহাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের হিরক বিষ। ফারুক তো রাজনীতির পীর-আউলিয়া-ঋষি-দরবেশ নন। তিনি তো এই জুয়া খেলার লোক নন। এখানে তিনি মিসফিট।
মায়ের সেই বিষ যেন ছিলো ক্ষমতার রাজনীতি; ব্যাংক ঋণের হিরক বিষময় অভিযোগ।
ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে দে ছাড়িয়া।
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া
কাছের মানুষ দুরে থুইয়া,
মরি আমি ধড়-ফড়াইয়ারে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন