রিক্সার সবুজ হুড, লাল জামদানি, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় দেখা যাওয়া রাজা-রানী, বাঘ-পেঁচার মুখোশ আর বাংলা বর্ণমালা। এই সবকিছু একসাথে বাংলাদেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মিস ইউনিভার্সের মতো বিশ্ব প্রতিযোগিতায় এসব নিয়েই প্রথমবারের মতো উপস্থিত হয়েছিল বাংলাদেশ। মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ শিরিন আক্তার শীলার পোশাকে করে আমাদের যাপন ও ঐতিহ্যের এই দিকগুলোই নিজেদের মেলে ধরেছিল আটলান্টায়। আর বিশ্ব প্রতিযগিতায় বাংলাদেশের এমন ব্যতিক্রমী উপস্থাপনের পেছনে ছিলেন পোশাকটির ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি। গত ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া প্রদেশে আটলান্টা শহরের টেইলর পেরি স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। ৬৮তম আসরে মিস ইউনিভার্সের মুকুট উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকার জোজিবিনি তুনজির মাথায়।
মূল অনুষ্ঠানের আগে হয়েছিল প্রিলিমিনারি ও ন্যাশনাল কস্টিউম শো। মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার অন্যতম আকর্ষণ হলো এই ন্যাশনাল কস্টিউম শো। কারণ এখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা স্বদেশকে উপস্থাপন করে, এমন পোশাক পরে আসেন। এই পোশাক নির্বাচনে থাকে না নির্দিষ্ট কোন গণ্ডি। অতীতে দেখা গেছে কোন প্রতিযোগী জাতীয় পশুর আদলে পরে এসেছেন বিশাল হাতির মুকুট, কেউ পিঠে করে নিয়ে এসেছেন দেশের সিংহাসন আবার কেউ পিঠে লাগিয়েছেন হকি স্টিক আর মাথায় স্কোরবোর্ড। ন্যাশনাল কস্টিউম শো মূল অনুষ্ঠান থেকে আলাদা একটি অংশ যার পয়েন্ট প্রতিযোগীর মূল নাম্বারের সাথে যুক্ত হয় না। এটি প্রতিযোগীদের জন্য দেশকে উপস্থাপন ও দেশাত্মবোধ উদযাপন করার একটি সুযোগ।
এবারের ন্যাশনাল কস্টিউম শো হয় গত ৬ ডিসেম্বর। এ বছর প্রথমবারের মতো মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। দেশের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছেন মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ শিরিন আক্তার শীলা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ন্যাশনাল কস্টিউম শোতে তিনিও সুযোগ পেয়েছিলেন পোশাকের মাধ্যমে দেশকে উপস্থাপন করার। শিরিন আক্তার শীলা বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি জামদানি, রঙটা ছিল লাল। আর সাথে আমাদের যাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা যানবাহন রিকশার হুড। রিকশার হুডে বাংলাদেশের সংস্কৃতির একাধিক দিক উপস্থাপন করা হয়েছে।
স্বভাবতই রিকশা আর্টের উপস্থিতি ছিল। সেখানে স্পন্দনশীল রঙের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়ে পপ কালচার। এছাড়া হুডে সংযুক্ত ছিল চারটি মুখোশ। মুখোশ নববর্ষ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা ক্যালেন্ডারের সূচনা হয় সম্রাট আকবরের হাত ধরে। তাই পহেলা বৈশাখে রাজা-রানীর মুখোশ বানানো হয় সম্রাট আকবর ও তার রানীর আদলে। এই দুই মুখোশ স্থান পেয়েছিল হুডের দুই পাশে। আর পিছনে ছিল বাঘ ও পেঁচার মুখোশ। বাঘ জাতীয় পশু আর পেঁচা ঐশ্বর্য, মঙ্গল ও বিজ্ঞতার প্রতীক।
বর্ণিল পোশাকের সাথে ছিল বাংলা বর্ণমালার বর্ণের আদলে গড়া অলংকার। যা ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। সবুজ হুড আর লাল জামদানিতে বাংলাদেশের পতাকার প্রতিফলন তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই পোশাকে।
পোশাকটির ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত অর্নি বলেন, 'আমি প্ল্যানই করেছিলাম শীলা যখন হেঁটে আসবে, পুরো সবুজের মাঝে লাল জামদানিতে আমাদের দেশের পতাকাটাকে বহন করে আনবে। স্টেজে কাউকে বোঝাতে হবে না যে ও কোন দেশ থেকে এসেছে। আমি শীলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশি বানাতে চেয়েছি। আর ওই কালচারগুলো উপস্থাপন করতে চেয়েছি যেগুলা বাইরের দেশের মানুষের কাছে আমাদের গর্ব করার মতো বিষয়। যেটা কোন জাতির নেই সেটা আমাদের আছে।'
অন্যান্য দেশগুলো প্রতিযোগীরাও বিভিন্নভাবে তাদের দেশকে উপস্থাপন করেছেন এবার। যেমন মিস মালয়েশিয়া ইউনিভার্স স্বেতা সেখনের পোশাকে ছিল তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার কুই-মুইসহ ট্রে। এই ট্রেতে ছিল মিষ্টি, ডিম ও তাদের বিভিন্ন ধরনের খাবার। তিনিই জিতেছেন বেস্ট ন্যাশনাল কস্টিউম পুরষ্কার।
ব্রাজিলিয়ান হুলিয়া হোর্তা নিজ দেশের কিংবদন্তি নারী ফুটবলার মার্তার প্রতি সম্মান দেখান দেশের ফুটবল জার্সি পরে। তার হাতে একটি ব্যানার ছিল যাতে লেখা 'Stop violence against women' অর্থাৎ নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করুন।
ভারতের ভার্টিকা সিং ছিলেন নববধূর সাজে।
লাওসের ভিচিত্রা ফনেভিলায় স্টেজে এনেছিলেন কাপড়ের তৈরি বিশাল হাতি যার মধ্যে ছিলেন তিনি। আর এতে লেখা ছিল পৃথিবীর ফুসফুসকে বাঁচানোর আহ্বান, 'Stop fire, save Amazon.'
মিস পুয়ের্তো রিকো ম্যাডিসন আন্দ্রেজ পরেছিলেন দেশটি জাতীয় ফুল জবার আদলে তৈরি পোশাক। পোশাকটি দেখে মনে হচ্ছিল একটি ব্যাঙ জবা ফুলের মাঝে বসে আছে।
আমেরিকার চেসলি ক্রিস্ট পরেছিলেন জাতীয় পাখি ঈগল ও স্ট্যাচু অফ লিবার্টির আদলে বানানো একটি পোশাক।
এল সালভাদরের জুলেইখা সোলারের পোশাকে ফুটে উঠেছে তার দেশের প্রধান ফসল কফি, চিনি, ভুট্টা। তাদের জাতীয় পাখি তোরোগজও স্থান পেয়েছে এখানে।
কম্বোডিয়ান আলাইনা সোমনাংয়ের পোশাকটি ইন্দিরা দেবীর অনুপ্রেরণায় তৈরি। ইন্দিরা দেবী ছিলেন হাজার বছর আগে খেমার সম্রাজ্যের সম্রাট সপ্তম জয়বর্মণের স্ত্রী। তবে তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন বিছক্ষণ একজন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক, একইসাথে একজন কবি ও অধ্যাপক । সৌন্দর্য, জ্ঞান, প্রতিভা, দায়িত্ব ও আত্মবিশ্বাসের সমন্বয়ে কম্বোডিয়ান নারীদের এগিয়ে যাওয়ায় অনুপ্রেরণা দিতে এই পোশাক পরেছিলেন তিনি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন