ভারতের ন্যারেটিভ নির্মাণের কুশলতা

৯৫ পঠিত ... ১৭:৫১, অক্টোবর ১৪, ২০২৪

37 (5)

কোন লেখায় আমি যখন ভারত লিখি; এর অর্থ ভারতের ক্ষমতাকাঠামো ও এর দোসর। ভারতের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতোই ভাগ্যহত। স্বাধীনতার এতোগুলো দশক চলে গেলেও তারা কল্যাণরাষ্ট্র ও মৌলিক মানবাধিকার পূরণের নিশ্চয়তা পায়নি।

ভারতের ক্ষমতা কাঠামো ও এর দোসর মিডিয়ায় ১৫ জুলাই থেকে আজ অব্দি বাংলাদেশ বিষয়ে একটি ক্লিশে ন্যারেটিভ তৈরির ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। তাদের ন্যারেটিভটি হচ্ছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকা মানে দেশটি ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাবে।

এই আলাপের আইরনি হচ্ছে, ২০১৪ সাল থেকে হিন্দুত্ববাদী সরকার ভারত শাসন করছে। সেই সরকারের অনুসারী সাংবাদিক, একাডেমিশিয়ান, সাবেক কূটনীতিক বাংলাদেশ ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছে কিনা সেই দুঃশ্চিন্তায় নির্ঘুম। অথচ বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা সাকুল্যে ২-৩ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি কোন নির্বাচনে।

ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধের ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের এই ফোবিয়ার ইতিহাস বেশ পুরনো। সুলতানী , মুঘল  ও নবাবী আমলে দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু মুসলমান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর থেকে  এই উপনিবেশ স্থাপনের যৌক্তিকতা দিতে মুঘলদের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ তৈরি করতে থাকে। কলকাতা বৃটিশ উপনিবেশের রাজধানী হওয়ায়; বৃটিশ স্তাবকের বাম্পার ফলন হয়েছিলো কলকাতায়। বৃটিশ তার কালচারাল হেজিমনির অংশ হিসেবে মাতৃভাষার বাইরে আরবি-ফার্সি শিক্ষিতদের ‘মূর্খ’ তকমা দিয়ে ইংরেজি শিক্ষা চালু করে। কলকাতার ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্টের মাঝ দিয়ে ‘অন্ধকার জনপদে রেনেসাঁর আলো জ্বালার’ সাইকোলজিক্যাল কলোনিয়ালিজম চালু করে।

বৃটিশের সহমত ভাই হিসেবে লর্ড কর্নওয়ালিশের পূর্ব বঙ্গের জমিদারি লাভ করে বেশিরভাগই হিন্দু কোলাবরেটর। অল্প সংখ্যক মুসলিমও এই কোলাবরেটরহুডের পুরস্কার হিসেবে জমিদারি লাভ করে। হিন্দু জমিদারেরা পূর্ববঙ্গের কৃষক-কারিগরের রক্ত শোষণ করে কলকাতায় সেকেন্ড হোম নির্মাণ করতে থাকে। ১৭৭০ সালে বৃটিশ ও তার দেশীয় সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষের প্রাণ হানি ঘটে পূর্ববঙ্গে। সম্পন্ন কৃষক-কারিগর শ্রেণীকে ভূমির অধিকার বঞ্চিত করে ও তাদের পণ্য বিক্রির আড়ং ভেঙ্গে দিয়ে; দরিদ্র শ্রেণীতে রুপান্তর করা হয়।

পূর্ববঙ্গের কৃষক-কারিগরের রক্ত শুষে হৃষ্টপুষ্ট জমিদারের ছেলেরা পূর্ববঙ্গের মানুষকে নিম্নবর্গের মানুষ তকমা দেয়। অথচ তারা খেয়াল করেনি, লন্ডনে বসে বৃটিশ শাসকেরা এই জমিদারদের ইঁদুর ও হীনমানুষের তকমা দিয়েছিলো।

বেঙ্গল রেনেসাঁর মাধ্যমে যে শিল্প-সাহিত্য ও ইতিহাসের বয়ান তৈরি হয়; সেখানে মুঘলদের ওপর ক্ষোভ প্রসূত সব বিদ্বেষ উগরে দেয়া হয় মুসলমানদের ওপর। কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ ছিলো শিল্পের রেশমী চাদরে জড়ানো ইসলামোফোবিয়া। যে কারণে ইয়াং বেঙ্গল সদস্যের বেশিরভাগই একসময় কট্টর হিন্দুত্ববাদীতে পরিণত হয়েছিলেন।

পূর্ব বঙ্গের কৃষক ও কারিগরেরা এই শোষণমূলক জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি চেয়েছিলো। সেকারণে শেরে বাংলা, সুহরোয়ার্দী, ভাসানী, আবুল হাশিম ও যোগেন মণ্ডলের মতো নেতারা যারা কৃষক প্রজার শোষণ্মুক্তির পক্ষে রাজনীতি করেছেন; তাদেরকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে দিয়ে "বায়ান্ন থেকে একাত্তর" পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণনা ভারতীয় বয়ানবিদেরা নির্ধারণ করে দেন।

১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলা তৃতীয় স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ ছিলো। সুহরোয়ার্দী ও শরত বোস এ নিয়ে চেষ্টা তদবিরও করেন। জিন্নাহ'র এ ব্যাপারে আপত্তি ছিলো না। কিন্তু সরদার প্যাটেল নেহেরুকে বোঝান, কলকাতাটা আমাদের চাই। আমার ধারণা কংগ্রেসের মাঝের হিন্দুত্ববাদী অংশ না চাইলে নেহেরুরও অখণ্ড বাংলা স্বাধীন হলে কোন আপত্তি থাকতো না। আর কলকাতার শ্যামাচরণের মতো নেতারা হিন্দুস্তানের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। তখন বাধ্য হয়ে পূর্ব বঙ্গকে দূরবর্তী ভূগোল ও সংস্কৃতির পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীনতা ভাগাভাগি করতে হয়। এই সত্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এবং যশওয়ান্ত সিং-এর গ্রন্থে পাওয়া যায়।

কিন্তু কলকাতার ন্যারেটিভ নির্মাতারা, দেশ বিভাগের জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিয়ে এর জন্য জিন্নাহকে দায়ী করেন। অবশ্য  ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় এসে নাগরিক আইন সংস্কার করে মুসলমানদের রাষ্ট্রবিহীন করার যে খেলায় মেতেছে; উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্য যোগী যেভাবে মুসলমানদের গৃহ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করেছে; তাতে জিন্নাহকে বেশ বাস্তববাদী বলে মনে হয়।

জিন্নাহ'র ভ্রান্ত চিন্তা ছিলো, নিজে ইংরেজিভাষী গুজরাটি, উর্দু না জেনেও; বাঙ্গালি-সিন্ধি-পাঞ্জাবি-বালুচ-পাশতু জাতির ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার কল্পনা। তিনি ১৯৪৮ সালে মারা যান। কিন্তু কলকাতার ন্যারেটিভ নির্মাতারা গত পনেরো বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুত্ববাদীদের লিপসার্ভিসে জিন্নাহকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যার জন্য দায়ী করে ফেলে প্রায়।

পূর্ববঙ্গে জমিদারী হারানোর বেদনা একদিনের জন্য ভুলে যেতে পারেনি কলকাতার সেকেন্ড হোমের বাসিন্দারা। ফলে পাকিস্তান উপনিবেশের বৈষম্য ও কালচারাল হেজিমনিতে পূর্ব পাকিস্তানিরা দ্রোহী হলে; ভারতের ক্ষমতা-কাঠামো বন্ধুর হাত বাড়ায়। প্রণব মুখার্জির কোয়ালিশন ইয়ারসে তার বঙ্গবিজয়ের ইতিহাস পাঠের আগে পর্যন্ত;  ইন্দিরা গান্ধীর একাত্তরের বন্ধুত্বকে আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে এসেছি। উচ্চ শিক্ষিত নারী বলে তিনি সফিস্টিকেটেড বাংলাদেশ নীতি ধরে রেখেছেন। রাজীব গান্ধী হয়ে ড মনমোহন সিং পর্যন্ত; বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসেবে সমমর্যাদার বন্ধুত্ব ধরে রেখেছিলেন। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়; তার সঙ্গে এনগেজমেন্টে কংগ্রেসের কোন অসুবিধা হয়নি। আমরাও ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান কাঁটা তুলেছি; কিন্তু ভারতকে নতুন কাঁটা হিসেবে কখনো প্রত্যাশা করিনি। বরং ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি-সংগীত-চলচ্চিত্র-ক্রীড়াকে উদযাপন করেছি বন্ধুর সাফল্য হিসেবে।

কিন্তু প্রণব মুখার্জির গ্রামের মোড়ল ধরণের বাংলাদেশ নীতি; নরেন্দ্র মোদির আনসফিস্টিকেটেড ফরেন পলিসি; বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্কে মালিন্য এনেছে। বাংলাদেশে কল্পিত উপনিবেশে রেসের ঘোড়া হিসেবে তারা আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ নীতিতে ফরেন পলিসির প্রত্যেকটি ডিম তারা হাসিনার বাস্কেটে রেখেছে। এর চেয়ে ত্রুটিপূর্ণ ফরেন পলিসি আর কি হতে পারে।

কলকাতার সেকেন্ড হোমে ময়ূখরঞ্জন ঘোষের মতো টিভি উপস্থাপক, তরুণ ঘোষের মতো ইউটিউবার রয়েছে; তারা পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে বৃটিশ উপনিবেশের শিখিয়ে দেয়া ন্যারেটিভ চালু রেখেছে। আঙ্গিকে অবয়বে ভাঁড় প্রকৃতির লোকের চোখে মুখে আর্য অহংকার দেখে শুধু বিস্মিতই হইনা; গুন্টার গ্রাসের মতো বলে উঠি জিভ কাটো লজ্জায়।

যেহেতু ১৭৯৩ সাল থেকে বঙ্গভঙ্গ হয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ তারপর ২০০৮ থেকে ৫ অগাস্ট ২০২৪; মনগড়া সব বয়ান দিয়ে যাত্রাপালার বিবেকের মতো বর্ণে বর্ণে মিথ্যা আর ইসলামোফোবিয়ার রাখঢাকহীন আস্ফালন চালু রেখেছে; বাংলাদেশে ক্ষমতার মোহে অন্ধ আওয়ামী লীগের মিডিওকার সংস্কৃতি মামাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ পেয়েছে; ফলে এই ন্যারেটিভ নির্মাতারা অতি আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। সব শেষ তারা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত হাসিনার হত্যাযজ্ঞে প্রাণহারানো ছাত্রজনতার মৃত্যু লঘু একটি বিষয়, গুরু বিষয় হলো, হাসিনা খুনে হানাদার পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের মৃত্যু। মৃত্যু মৃত্যুই। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো স্বৈরাচার পতনের পর; স্বৈরাচারের দোসরের ওপর হামলা নিয়ে এমন মায়াকান্না দেখিনি।

ভারতের অভ্যন্তরেই নৈর্ব্যক্তিক চিন্তার ইতিহাসবিদেরা মুঘল, সুলতানি ও নবাবী আমল বিশ্লেষণ করে, উন্নত প্রবৃদ্ধি ও কৃষক-কারিগরের অধিকারের পক্ষে সক্রিয় শাসন কাঠামোর দেখা পেয়েছেন। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সমাজ খুঁজে পেয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় প্রশাসনের সিকিমসুলভ দিবাস্বপ্নের সমালোচনা ভারতের সচেতন সমাজে রয়েছে। বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের গুলি চলার প্রতিবাদে কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ করেছে, কারাবরণ করেছে। স্টেপ ডাউন হাসিনা শ্লোগান উচ্চারিত হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জেন জি'র মাঝে হিন্দু-মুসলমান কুঁচকুঁচানি নেই; দেশ বিভাগে হিন্দু-মুসলমান বন্ধু-আত্মীয়ের হৃদপিন্ডের অলিন্দ্য-নিলয় আলাদা হয়ে যাবার বিষাদসিন্ধুতে দাঁড়িয়ে ইন্টারনেটের ইরেজার দিয়ে তারা মুছে দিয়েছে রেডক্লিফের লোহিত পেন্সিলের দাগ। এই বন্ধুত্বই সত্য; শত্রুতার ছায়ানৃত্যগুলো পিছিয়ে পড়া মনোজগত; জাঢ্যজরদগব বাতিল চিন্তা।

৯৫ পঠিত ... ১৭:৫১, অক্টোবর ১৪, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top