এ এক রহস্যময় নগরী; এইখানে প্রতি দেড় বর্গ কিলোমিটারে একজন মিস্টিক পুরুষের বসবাস। সে পাগড়িময় হতে পারে, জটাধারী হতে পারে, ঝাঁকড়া চুলের হতে পারে, আবার নেহাত ক্লিন সেভড ছোট চুল সুঠাম দেহী হতে পারে। এরা হাতের ইশারায় কার্ল মার্কসকে হাজির করে জালালুদ্দিন রুমীর সঙ্গে দাবা খেলায় বসিয়ে দিতে পারে। অথবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে জর্জ অরওয়েলের মুখোমুখি করতে পারে। এরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে এক নিঃশ্বাসে নাকচ করে দিয়ে বলতে পারে, ওদেরকে চিনি না।
এই নগরী নগর হয়ে ওঠার আগে এখানে সারি সারি তালগাছ ছিল; ওইখানেতে বাস করতো কানাবগির ছা। ফলে মিস্টিক নাগরিক মাজার, আশ্রম কিংবা গুরুগৃহে একটি করে তালগাছ রয়েছে। সেই তালগাছ সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে।
ধরুন একথা সহজ করে বলা যায় যে, প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু পাগড়িধারী বলেন, ইনসানের রুহের জন্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে আপনাকে সমাজের স্তরে স্তরে প্রস্তরীভূত অহমের সিলসিলা খতম করতে হবে; সেখানে মানুষের এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই যে উনার কথার অর্ধেকটা বোঝা গেলো; অর্ধেকটা ঝাপসা হয়ে রইলো; ঐখানে তিনি মাস্টারমাইন্ড হয়ে গেলেন।
জটাধারী বলেন, টডের স্বপ্নের যে রাজপুতের দেখা মেলে; সেই রাজপুত একমাত্র সেই রাজপুত্রই পারে রামের অযোধ্যা ফিরিয়ে দিতে; আসমুদ্র হিমাচলকে মোহাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি দিতে। এইখানে বহিরাগতের আধিপত্য শেষ করা না গেলে শিবাজীর শৌর্যবীর্যের অতীত ফিরিয়ে আনা যাবে না। এই যে উনার কথার কিছু অংশ বোঝা যায়; কিছু অংশ বোঝা যায়না; এইখানেই তিনি মাস্টারমাইন্ড।
মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ঝাঁকড়া চুল আপনাকে বলে, গণের যে আকাংক্ষা তা হচ্ছে জনকে ধারণ করা। কিন্তু তা যখন জনের অধিকারকে নাকচ করে জনগণমনরণের ফ্যাসিস্ট অধিনায়ক জয় হে হয়ে যায়; তখন গণবিদ্রোহ হয়; কারণ গণের একটি নিজস্ব চাওয়া আছে; সেই চাওয়াকে অস্বীকার করা মানেই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি। এই যে অনেক বড় বড় ইঙ্গিত কিন্তু তা বোঝার উপায় নাই; সেইখানেই মাস্টারমাইন্ডের কৃতিত্ব।
ক্লিন শেভড ছোট চুল সুঠাম দেহীর এতো জটিল ভাষা জানা নাই। কিন্তু তার আছে শিষ্যেরা; যারা এসে দাবী করে, উনিই জুলাই বিপ্লবের মাস্টার মাইন্ড। কেন ও কিভাবে তা ব্যাখ্যা করার মতো ভাষা নেই শিষ্যের মুখে।
আবহমানকাল ধরে আধ্যাত্মিক তন্ত্রমন্ত্র সাধনা, বুজরুকি প্রদর্শন, কালা জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের বাঙ্গালি বাবার মনোপলি ভিত্তিক সমাজ থাকায়; আধুনিক নাগরিক সমাজে সেই রহস্য পুরুষের আকাংক্ষা রয়ে গেছে সাধারণের মনে। কিংবা আরব থেকে কুমিরের পিঠে চড়ে বাংলায় আগমন; অথবা মধ্য এশিয়া থেকে অলৌকিক বাহনে চেপে বাংলায় আগমন; এইরকম দুটি আর্য কল্পনার ধারা দুটি ধর্মের মানুষের মাঝে আর্য হবার প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাস্টারমাইন্ড হয়ে ওঠার প্রবল স্বপ্ন মাথাচাড়া দেয়।
এ কারণেই ১৮৫৭-র বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সালের প্রতিবিপ্লব, ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থান অথবা ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব; ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ যুগক্ষণে মাস্টারমাইন্ডের বিগ্রহ তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। একজন স্যাভিয়ার গোটা জাতিকে মুক্তি দিলো; নিশ্চয়ই সে মহামানব এরকম কল্পনার রুপকথার গল্প ‘ছোট ছোট আশা ছোট ছোট পদ’-এর জনপদের ঘরে ঘরে নানা কল্পকাহিনীর জন্ম দেয়।
ফলে সাহসী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ যারা প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামে জীবন দেয়; বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়; তারা রয়ে যায় নেহাত পরিসংখ্যান হিসেবে। তাদের জন্ম মৃত্যু বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া সবই সংখ্যা এই জনপদে। মিডিয়ার সৈনিকেরা মাস্টারমাইন্ডের মিথ তৈরি করে ক্লিক বেইটের খেলা খেলে। মানুষ পড়িমরি করে দৌড়ায় সেই অতিকল্পনার পেছনে। প্রতি কিলোমিটারে একটি করে দেড় ইটের মাজার অথবা আশ্রম; সেইখানে একজন করে মাস্টারমাইন্ড আঙ্গুল উঁচিয়ে তত্ত্ব দেন; সেইখান থেকে কোন বানেগা প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড!
সরল পথচারী মাথা চুলকে ইতস্তত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, মাস্টারমাইন্ড কী! আরেকজন উত্তর দেয়, সরকার ফালাইয়া দেয়ার কারিগর।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন