আমারে চিনোস!

৯১ পঠিত ... ১৭:৪৩, অক্টোবর ০৬, ২০২৪

36

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যারা রক্ত-ত্যাগ-ঘামে দুর্মর লড়াই করে পূর্ববঙ্গকে বৃটিশ মুক্ত করল; তারা স্বাধীনতা অর্জনের পর নিজ নিজ কাজে ফিরে গেল। এই আন্দোলনে কে জিতবে কে হারবে কে জানে এসব চিন্তা করে যারা চুপটি করে বসে ছিল; তারা ১৪ আগস্ট মাথায় পাকিস্তানের পতাকা বেঁধে বিজয় মিছিলে যোগ দিল। আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল; কোন হিন্দু ভারত চলে গেল; তার বাড়িটিতে চক দিয়ে দাগ দিয়ে রাখল দখল করার জন্য। কোন হিন্দু ভারত চলে যাওয়ায় কোথায় কোন পদ শূন্য হলো; সেইখানে গিয়ে ‘আমারে চিনোস!’ বলে চেয়ারে বসে পড়ল ফোরটিনথ ডিভিশনের স্বদেশী সংগ্রামী। রেডিও পাকিস্তানে গিয়ে বৃটিশ সমর্থক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর কালো তালিকা করল ঐ ডিভিশনের কালা মিয়া। প্রতিভাবান শিল্পীদের বের করে দিয়ে তারস্বরে গান গাইতে চেষ্টা করল, আমারে চিনোস; আমি কেডা; আমি হইলাম লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের হ্যাডা!

পাকিস্তান বিরোধী সংগ্রামে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে রক্ত-শ্রম-ঘাম-ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন সংগ্রামে ফিরে গেল। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষ; পোড়ো বাড়ি রিক্ত মাঠের গ্রাউন্ড জিরোতে দাঁড়িয়ে দেশ পুনর্গঠন শুরু করল। আর ঐ যে ১৬ ডিসেম্বর মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে; লুট হওয়া ভাঙ্গা রাইফেল হাতে নিয়ে বিজয় মিছিলে এগিয়ে গেল সিক্সটিন্থ ডিভিশন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল কোন অবাঙ্গালি কোন বাড়িটা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছে; কে ছেড়েছে কোন পদ। ‘আমারে চিনোস’ বলে সাজানো বাংলোয় নতুন বুর্জোয়া সেজে পাইপ টানতে শুরু করল শুক্কুর আলী। তখন শাকের ভাই নামে সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর হয়ে পড়ল। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ঢুকে ‘পাকিস্তান সমর্থক’ শিল্পীদের কালো তালিকা করলেন কালাবুজি, তারস্বরে চেঁচিয়ে গাইলেন, আমারে চিনোস; আমি কেডা; আমি হইলাম জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধুর হ্যাডম। মুক্তিযুদ্ধে সোমত্ত শরীরে মামার বাড়িতে নিরাপদে বসে থাকা আমারে চিনোস তাসির লিখতে শুরু করল মুক্তিযুদ্ধের ফ্যান্টাসি। এঁকে দিল দ্য গ্রেটেস্ট থিওরি অন আর্থ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর; বাকশালের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল সমাজতন্ত্রীরা ফাঁসিতে ঝুলল, দেশছাড়া হলো; আর মাথায় টুপি পরে ওয়াজ মাহফিল করে মখলেছ মিয়া বলল, আমারে চিনোস আমি কেডা; অনেক হইছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; এইবার চলো ইসলামি চেতনা নিয়ে খেলি। সিপাহী-জনতার বিপ্লব শেষে জনতা ঘরে ফিরে গেল। আর বিপ্লবের সময় জিকিরে ফিকিরে যে জিতব তার লগে আছি মালেরা খুঁজতে শুরু করল, মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে কে কোথায় নতুন দালান তুলেছে; তা দখল করতে হবে। বাংলাদেশ বেতার টেলিভিশনে ঢুকে কালাউল্লাহ হুংকার দিল, আমারে চিনোস আমি ক্যাডা; আমি হইলাম জিন্দাবাদের হ্যাডা। চলো কালো তালিকা করি, কারা শেখ মুজিবের সাপুটার ছিল।

১৯৯০ সালে রহমান অ্যান্ড রহমান ডাইন্যাস্টি কোম্পানির দুই কিচেন মেইডের গদিনশীন হবার কল্পনাকে পরিকল্পনায় রুপান্তর করতে জয় বাংলার বাচ্চু-কাচ্চু ও জিন্দাবাদের লালু-কালু ঢাকা কেন্দ্রিক অভ্যুত্থান ঘটাল। দুই চারদিন শহীদ ডাক্তার মিলন ও শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে শুরু হলো, চলো ফইন্নি এলিট হই আন্দোলন। এসে পড়ল পলিটিক্যাল থিওরি, লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে; টেকাটুকা করে যে দেশ চালাতে পারে সে। রাজনীতিতে দলে দলে লেন্দুপ দর্জি ও মিয়া খলিফা যোগ দিল। বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ড করে তুললেন দুই গ্রোরিয়াস কিচেন মেইড। কাচ্চু-বাচ্চু গিয়ে কান কথা বলে আওয়ামী লীগের শিক্ষিত সৎ নেতাদের দলচ্যুত করতে শুরু করল; লালু-কালু গিয়ে বিএনপির সৎ ও শিক্ষিত নেতাদের দলচ্যুত করতে শুরু করল। এই আমারে চিনোস, আমি কেডা আমি গণ-অভ্যুত্থানের হ্যাডা এই ডায়ালগ দিয়ে ছেঁড়া শার্ট পরা লোকেরা শো রুম থেকে শার্ট তুলে নিয়ে কাফলিং দিয়ে পরল; গাড়ি তুলে নিয়ে কারখানার গেট দিয়ে ঢুকে শিল্পপতি হলো। পদ-পদবী-পদক দখলে তখন শুধু আমারে চিনোস বললেই চলে! আর বেচারা বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; কলিমুল্লাদের কালো তালিকাদের চাপে পড়ে বাঁশি সংগীত হারা।   

২০০৯ সালের পর নৌকায় চড়ে  বিরানব্বুই সালে ছাত্রদল করা ছেলেরা আমারে চিনোস বলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিক্ষক হিসেবে আবির্ভুত হলো;  ছাত্রশিবির প্রকৃত ছাত্রলীগ হয়ে পড়ল; আর ছাত্রলীগ পাপিয়ার আসরে প্রমোদে ঢালিয়া দিল মন। এইবার আমারে চিনোস বলে, চেতনার কথা বলে, ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খেতে শুরু করল গলির ধারের ছেলেরা। আমারে চিনোস বলে তখন বিসিএস অফিসারও হওয়া যায়। আর কালাচন্দ্রের প্রগতিশীলতার চাপে তখন জয় শ্রীরাম স্লোগান বাঙ্গালির হাজার বছরের সংস্কৃতি পরিচয় হলো। সে বলে উঠল, আমারে চিনোস আমি ক্যাডা, আমি জয় শ্রীরাম ভারতের হ্যাডা! ওদিকে মদিনা সনদের লিপ সার্ভিসে আলুথালু হয়ে আল-কালা শোকরানা মেহেফিলে মরুভূমি ও খেজুর গাছ ছাড়াই গেয়েই উঠ, এ কোন মধুর শরাব দিলে আল-আরাবি সাকি!

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আমারে চিনোস চোখ রাঙ্গানিতে শিক্ষিত সমাজ চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ বলে দিকে দিকে উপদেশ ছড়াতে লাগল, ও মানুষ তোমার দুইটা চোখ দেখবা দুইটা কান শুনবা আর একটা মুখ তো; কথা কম কবা।

আমারে চিনোস বলে গুম-ক্রস ফায়ার-আয়নাঘরের মানবতাবিরোধী অপরাধ করে; আর বাংলাদেশ ডাকাতি করে; দেশটাকে সেকেন্ড হোমে স্থানান্তর করে মাদার অফ কিচেন মেইডের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করল উন্নয়নের পালোয়ানেরা। যদি তুমি পূজা করো তবে তুমি সেকু, যদি তুমি নামাজ পড়ো তবে তুমি ফান্ডু; এই স্লোগানের চাপে শোকরানার মেহেফিলের আল কালার জিদ বাড়ল; সে বাকশালের খাসজমিতে বসে খেলাফতের স্বপ্নে কুঁ কুঁ করতে থাকল।

মাদার অফ কিচেন মেইডের ফ্যাসিজমের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকা জনপদে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আবু সাঈদ, মুগ্ধ, রুদ্র এসে প্রাণ দিয়ে দেশটাকে রাক্ষসমুক্ত করল। হাজারও প্রাণ গেল, হাজার হাজার মানুষ আহত ও অন্ধ হলো। ফ্যাসিস্ট কিচেন মেইড অর্ধেক রান্না করা পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি ফেলে পালিয়ে গেল।

জুলাই বিপ্লব শেষে সাধারণ মানুষ কাজে ফিরে গেল। কিন্তু ঐ যে, সাড়ে পনেরো বছর ধরে জি হুজুর করে, জুলাইয়ের ১৫ থেকে শ্যাম রাখি না না কূল রাখি করে যারা ৫ আগস্ট বিকেলে মাথায় পতাকা বেঁধে বিজয় মিছিল করল; তারা এবার আমারে চিনোস বলে ভিক্ষুকের কুটির থেকে রাজপ্রাসাদে উঠবে। ফইন্নি থেকে এলিট হতে শুরু করেছে তারা। আর ঐ যে রেডিও ও টেলিভিশন; আশি বছর ধরে কালো তালিকা করতে করতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে আছে কতগুলো ওস্তাদ আমারে চিনোস নিয়ে। আমারে চিনোস যায় আমারে চিনোস আসে; বাংলাদেশ পড়ে থাকে নিতান্ত অবহেলায়।

বীর শহীদেরা কবরে শুয়ে থাকে; আর অনন্তকাল ধরে ক্ষমতার আমারে চিনোস ধমক দিয়ে রাজত্ব করে দুধের মাছি ও বসন্তের কোকিলেরা।

৯১ পঠিত ... ১৭:৪৩, অক্টোবর ০৬, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top