যে কারণে কবিকে বিয়ে করেও জীবনের ছন্দ মিললো না

১৪২৫ পঠিত ... ২১:৪৩, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১

chondo

ছোটবেলা থেকে আমার একমাত্র স্বপ্ন ছিলো একজন আর্মি অফিসারকে বিয়ে করা৷ 'এইম ইন লাইফ' রচনায় সবাই যখন লিখতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে চাই, আমি লিখতাম 'আর্মি অফিসারের স্ত্রী' হয়ে চাই।
এমন অদ্ভুত লক্ষ্যের কারণে অনেকবার হেডমাস্টার তাঁর রুমে ডেকে কৈফিয়ত চেয়েছেন, অনেক শিক্ষক নাম্বার কম দিয়েছেন। তবুও আমি থেমে থাকিনি। আসল লক্ষ্যের কথা জানাতে আমি ছিলাম পাহাড়ের মতো অনড়, নদীর মতো স্বচ্ছ।
কিন্তু হায়! কোথাকার জল কোথায় গড়ায়?
চার বছর আগে আমার বিয়ে হয় সামান্য একজন কবির সাথে। আমাকে বিয়ে করতে রাজি— এমন একজন আর্মি অফিসারকেও খুঁজে পাওয়া গেলো না৷
আমি বাসায় বললাম, 'অফিসার না পেলে সৈনিকই সই। তবুও আর্মি চাই...'
আম্মা ফিসফিস করে বললো, 'রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে কালো বন্দুক দেখাইলে বুঝবি!'

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বন্দুক টন্দুক আমার ভালো লাগে না। আমি নিরস্ত্র জীবন চাই। অবশেষে আমি কবিকে বিয়ে করতে সম্মতি দিলাম। তবে কবিরও বন্দুক আছে, অগ্নিবাণের মতো শক্তিধর এই শব্দবন্দুক।

আমিও ছোটবেলা থেকে টুকটাক কবিতা লিখি। কিন্তু আমার অবস্থা কাজী মারুফের মতো।
'সবার ছন্দ মেলে, কিন্তু আমার ছন্দ মেলে না!'
কবিকে যখন বিয়ে করি তখন আমার চোখে স্বপ্নের স্তূপ।
আর্মিকে ভুলে ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে কাজী সাহেবকে অনুকরণ করে টিয়া পাখির মতো বললাম 'কবুল'। আমার স্বতঃস্ফূর্ততায় মুগ্ধ হলো কবি ও তাঁর পরিজনেরা।
বাসর রাতে কবি আমাকে কবিতা শেখালেন। উপহার দিলেন কবিতার সম্মোহনী । আমি ছন্দ মেলানোর স্বপ্নে সারারাত বিভোর হয়ে রইলাম। কবিতার বুননে ইন্দ্রজাল সৃষ্টির অদ্ভুত স্বপ্ন সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখলো৷
কবি বললেন, 'সাধনা করিতে হইবে। নিয়মিত লিখিতে হইবে।'
সুরবালার মত উত্তর দিলাম, 'যথা আজ্ঞা!'
প্রথমদিন খাতা খুলে যখন লিখতে বসলাম, দুটো শব্দ লিখেছি সবে, তখন আমার কবি স্বামী ডেকে বললেন, 'খুব পায়েশ খেতে মন চাইছে। দিতে পারো কি?'
আমি প্রেমভক্তা নির্জলা নারী। সহসা স্বামীর অনাহারত্ব আমাকে ভীষণ কষ্ট দিলো। সাথে সাথে পায়েশ বানাতে গেলাম।
বিকেলে আবার যখন লিখতে বসলাম, কবি বললো, 'প্রিয়তমা, কোমরে চোট লেগেছে। একটু আরাম করে দাও...'
এত আদুরে কন্ঠ উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই। ছুটে গেলাম। এরপর থেকে আমি যখন কবিতার খাতা নিয়ে মনের মাধুরী ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি, ঠিক তখনি আমার ব্যক্তিগত কবি আমাকে ডেকেছে। কখনো স্যান্ডো গেঞ্জি ধুয়ে দিতে, কখনো বা জাঙ্গিয়া, আবার কখনো লুচি ডাল খাওয়ার বাসনায় আমাকে চেয়েছে।
একবার আমি লিখতে বসেছি। ছন্দ মিলে মিলে অবস্থা। আমার অন্তরাত্মা তখন শিহরিত। রক্তস্রোতে বইছে অজানা আনন্দের জোয়ার। কোথা থেকে পতি ছুটে এসে একটু কেশে বললেন, 'আমার নেফারতিতি কই? খানিক গরম জল চাই যে!'
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, 'ছন্দের মিলন শেষদিকে। একটু পরে দেই?'
রবীন্দ্রনাথের গলায় কবি বললেন, 'অন্নপূর্ণার সাথে বৈরাগীর যে মিলন, তাহাই প্রকৃত মিলন। আমি সহজাত বৈরাগী, বাকিটুকু বুঝে নিও। তুমি হাত উজাড় করে আমায় দাও। আমায় গ্রহণ করো...'
আমি মুহূর্তের জন্য নিজেকে অন্নপূর্ণা ভাবতে শুরু করলাম। নিজেকে সঁপে দিলাম বৈরাগীর দুয়ারে। এরপর থেকে আর লিখতে বসিনি। ইছামতীর তীরে খাতাটাকে পুড়িয়ে এসেছি। সাক্ষী ছিলো ডাঙার শিরীষ গাছটি। আমি ভুলতে বসেছি আমার অতীতের কথা। আর্মির কথা। বন্দুকের কথা। কবিতার কথা।
হঠাৎ আজ কি যেনো হলো। শীতের হাওয়ায় কবির শুষ্ক চোখ। আজ চার বছর পর জানতে চাইলো-
'তুমি কবিতা লিখা ছাড়িয়া দিয়াছো? সেই ফুলশয্যার রাত হইতে শিখাইয়া আসিলাম। তবুও তুমি অপারগ, অক্ষম। নয় কি? তবে তো বলিতেই হয় তোমার অন্তর কবিসত্ত্বার অস্তিত্বহীন...'
আমি উত্তাপহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কবিকান্তের দিকে।
উদাস কন্ঠে উত্তর দিলাম, 'হ্যাঁ গো, সবার ছন্দ মিলে, আমার ছন্দ মেলে না...'

১৪২৫ পঠিত ... ২১:৪৩, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top