আমি একটি টিশার্ট। আমার জন্ম গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটা ফ্যাক্টরিতে। জন্ম এদেশে হলেও আমি কিন্তু পুরোপুরি বাংলাদেশি না। কিছু জটিলতা আছে। আমাকে বলা যেতে পারে ঘটনাসূত্রে বাংলাদেশি।
জাতীয়তা নির্ধারণের জন্য আপনারা যেই ক্রাইটেরিয়াগুলো বিবেচনা করে থাকেন, এই যেমন বাবা মায়ের দেশ, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, জন্মের স্থান, দেশের সীমানা- এগুলোই তো, নাকি?
আমার জন্ম বাংলাদেশে হলেও সেই অর্থে আমার বাবা মা নেই। টিশার্টদের আসলে বাবা মা থাকে না। আমাদের বলতে পারেন টেস্টটিউব বেবি৷
আমি যদি আমার বাবা কে, মা কে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, তাহলে জানতে পারব আমার সূতা যেই কারিগর মেশিনে দিয়েছিল, যেই কাটিং মাস্টার আমাকে কেটেছিল, যেই অপারেটর সুইচ টিপে আমার সেলাই করেছিল আর যেই কর্মী মেয়েটা পরম যত্নে আমার কলারে বোতাম লাগিয়েছিল- এরা সবাই আমার বাবা মা।
আর অরিজিন মানে উৎপত্তিস্থল যদি যাচাই করতে যান, দেখা যাবে তুলা এসেছে সুদূর আফ্রিকান দেশ জায়ার থেকে, প্লাস্টিকের দানা এসেছে ওমান থেকে, রঙের কেমিক্যাল এসেছে তাইওয়ান, ইন্ডিয়া আর লেবেল এসেছে চায়না থেকে৷
আমার জাতভাই অন্যান্য টিশার্টেরাও আমার মতই মিক্সড অরিজিনের। কাঁচামাল বিভিন্ন দেশ থেকে হলেও ফাইন্যালি একটা টিশার্ট হিসেবে প্রসব বাংলাদেশে হওয়ায় আমাকে আপনারা উৎপত্তিসূত্রে বাংলাদেশি বলতে পারেন।
জন্মের পরপরই সুদৃশ্য পলিথিনে মুড়ে আমার যাওয়ার কথা ছিল জার্মানিতে। সেখানের বিখ্যাত ব্র্যান্ড 'হুগো বস' এর হেডকোয়ার্টার মেটজিংগেনের গোডাউনে।
যদিও আমার গায়ে লেখা আই লাভ নিউইয়র্ক। লাভের জায়গায় লাল রঙের একটা হৃদয় সাইন।
আমার কপালটা খারাপ জানেন। আমার ইউরোপ যাওয়া হয়নি। কত শখ ছিল ইউরোপের পথে প্রান্তরে ঘুরব। গ্রিসের সান্টোরিনি দ্বীপে ঈজিয়ান সাগরে ভিজব কিংবা রোমানিয়ার ট্র্যানসিলভানিয়ার ড্রাকুলা ক্যাসলে যাব।
তা না করে আমি এখন পড়ে আছি ঢাকা শহরের কাওরান বাজার এলাকার মাছের আড়তের পাশে। এখানে কিভাবে এলাম সেটা বলছি।
ফ্যাক্টরির কোয়ালিটি কন্ট্রোলে যেই মেয়েটা বসা ছিল তার চোখে আমার একটা খুঁত ধরা পড়ে। সে দেখতে পায়, আমার কলারের দুইনম্বর বোতামের ফাঁকে সূতাটা একটু পেঁচিয়ে গেছে।
খালি চোখে আপনারা কেউ এটা দেখতেই পাবেন না, কারণ এটা খুব সূক্ষ্ম ধরনের একটা সমস্যা। যা শুধুমাত্র অভিজ্ঞ কারিগরেরাই ধরতে পারে। এই মেয়েটা এই সেকশনে কাজ করে আজ প্রায় তিন বছর। তার চোখ গলে আজ পর্যন্ত খুঁতওয়ালা টিশার্ট বের হয়েছে হাতেগোনা।
আর এই মেয়েগুলো ছোটবেলা থেকেই মলা ঢেলা জাতীয় ছোট মাছ খেয়ে অভ্যস্ত। আপনারা জানেন, ছোট মাছে ভিটামিন এ থাকে, খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে। বিটিভিতে আগে সরকারের তরফ থেকে এজাতীয় বিজ্ঞাপন দেখেছেন আপনারা।
যাই হোক, ওই মেয়েটার চোখে ধরা পড়ার পরে আমার স্থান হল স্টকলটের গোডাউনে। আমার সহোদরেরা আমাকে করুণ চোখে বিদায় জানাল। তবে কি বেশি ভাইবোন হলে নিজেদের মধ্যে বন্ধনটা তেমন দৃঢ় থাকে না। দুই একটা মরে গেলেই বা ক্ষতি কি!
আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম টিশার্ট ভাইয়েরা এবং বোনেরা লাল নীল হলুদ রঙের প্যাকেটে করে ট্রাকে লোড হয়ে গেল। এখান থেকে তারা যাবে সুদূর চট্টগ্রাম শহরের উপকন্ঠ কুমিরা এলাকায়।
সেখানে তাদেরকে কন্টেইনারে ভরা হবে। সেই কন্টেইনার জাহাজে ভর্তি হয়ে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যাবে মেডিটারেনিয়ান হয়ে জার্মানির হামবুর্গ বন্দরে। ঈজিয়ান সাগর আর মেডিটারেনিয়ান সাগর হচ্ছে প্রতিবেশী। আর বাংলাদেশ থেকে নৌপথে হামবুর্গ যেতে হলে মেডিটারেনিয়ান দিয়েই যেতে হয় নাকি। ওরা বলাবলি করছিল।
আমি ভেবেছিলাম এই টিশার্টের ক্ষুদ্র জীবনে আমার বোধহয় আর সাগর দেখা হবে না।
তবে ওইযে প্রবাদ আছে না? টিশার্ট ভাবে এক, আর হয় এক।
জীবন আমাকে প্রতি পদে পদে চমৎকৃত করে যায়।
গার্মেন্টস লটের গোডাউন থেকে আমার স্থান হয় ঢাকা কলেজের সামনের ওডিসি মার্কেটে। কি চিনতে পারলেন না তো?
ওডিসি মানে হল অপোজিট টু ঢাকা কলেজ। যারা রেগুলার ওখান থেকে কাপড় চোপড় কেনে, তারা এই নামেই ডাকে আদর করে। তবে এখান থেকে কিছু কিনতে হলে আপনার দরকার একজন জহুরির চোখ।
সেই চোখ যা গার্মেন্টসের সেই মেয়েটার ছিল। নইলে দোকানদার আপনাকে ঠকিয়ে বাতিল মাল গছিয়ে দেবে চোখের নিমেষে।
আচ্ছা, আপনাদের কি জানতে ইচ্ছে করে ওই মেয়েটার কি হয়েছিল? ওকে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল কি-না আমার খুঁত বের করার জন্যে?
সে সুযোগ কিন্তু তার মালিক পায়নি। এর কিছুদিন পরেই করোনা মহামারী শুরু হল। আর ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেল।
মালিকেরা তাদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে পারবে না বলে সে গ্রামে চলে গিয়েছিল। গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরে তার বিয়ে হয়। এখন নাকি গরু ছাগল পালে। ওর হাজব্যান্ড ঢাকায় আসতে দিবে না।
কী লাভ হল আমার ক্ষতি করে বলেন?
যা হোক, যা বলছিলাম। আমি ছিলাম ওডিসি মার্কেটের এক চিপা দোকানে। দোকান চিপা হলেও এই দোকানের কালেকশন বেশ ভালো। লোকজন চিনে, আসে এখানে।
তারা জানে এই দোকানের মালিক নিজে গার্মেন্টসে গিয়ে বাছাই করে টিশার্ট নিয়ে আসে। এবং সবগুলোই এক্সপোর্ট রিজেক্টের মাল, কোনটাই লোকাল না।
তাই এনার কিছু রেগুলার কাস্টমার আছে যারা মাসে দু-মাসে একবার এসে তার কাছ থেকে টিশার্ট নিয়ে যায়।
আমার বর্তমান মালিক একদিন এসে ২৫০ টাকা দিয়ে আমাকে কিনে নিল। আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল। এই আমার দাম হতে পারতো ১৫ ইউরো, মানে প্রায় ২০০০ টাকা। কোনও এক বেখেয়ালি শ্রমিকের হাতে সূতা পেঁচিয়ে যাওয়ার কারণে আজ আমার এই দরপতন। নাকি অধঃপতন?
জানেন, আমার সমুদ্র দেখার ইচ্ছা কিন্তু পূরণ হয়েছে। আমার বর্তমান মালিক আমাকে কিনে নিয়েই গিয়েছিল কক্সবাজার নামের একটা জায়গায়। সেটা নাকি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত।
আমার জাতভাইদের কিন্তু এই সৌভাগ্য হয় নাই। সেদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবান না? স্রষ্টা নাকি কারও ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না। কোনও না কোনওভাবে পূরণ করে দেন।
কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসে আমার জায়গা হয়েছিল মালিকের দৈনন্দিন সান্ধ্যকালীন হন্টন প্রণালিতে। তিনি অফিস থেকে এসে একদিন পর একদিন আমাকে গায়ে চড়িয়ে হাঁটতে বেরোতেন।
এই হাঁটতে গিয়েই আমি আমার এই ছোট্ট টিশার্ট জীবনে দ্বিতীয় বারের মত 'লাইভ ফিশ সেন্টার' দেখেছিলাম শেখের টেক মেইন রোডে। প্রথমবার দেখেছিলাম কক্সবাজারে, ৩০০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে। যদিও দেখার পর যারপরনাই হতাশ হয়েছিলাম।
আমার মালিকের ভাষ্যমতে, এই লাইভ ফিশ সেন্টারে যেই শোল, বোয়াল আর রুই মাছ পাওয়া যায় এগুলো চাষের হলেও কক্সবাজারেরটা থেকে হাজার গুণে ভালো। ওটা নাকি কারও কোন কাজে আসে না।
আমি এখন যেখানে থাকি, মোহাম্মদপুর শেখের টেক ৩ নং রোডের একটা ছয়তলা বাড়ির তিনতলায়। ভবনটায় লিফট নাই। হেঁটে উঠতে কষ্ট হয় সবার।
মালিক প্রতিদিন ঘামে নেয়ে একসা হয়ে বাসায় ফিরতেন। তারপর আমাকে আচ্ছামত ধুয়ে নেড়ে দিতেন বারান্দায়।
তবে এই বাসার বারান্দায় থেকেও আমি কিন্তু আকাশটা দেখতাম। সেই আকাশের সীমানায় ড্রাকুলা ক্যাসলের চূড়া দেখা না গেলেও জাপান গার্ডেন সিটির উঁচু বিল্ডিংগুলোর মাথা ঠিকই দেখা যেত।
এই সুখ বেশিদিন সহ্য হল না। মালিকের ছোট ছেলেটা একদিন বারান্দায় খেলাচ্ছলে এসে আমার গায়ে রঙ লাগিয়ে দিল। স্কুল ছুটি থাকায় এই বাচ্চাগুলোর হয়েছে সমস্যা। তারা সারাদিন ঘরে বসে থেকে বোর হয়ে শুধু দুষ্টুমি করে বেড়ায়।
কবে যে দুনিয়াটা স্বাভাবিক হবে?
এই রঙ লাগার পরে আমি হয়ে গেলাম অচ্ছুৎ। মালিক আর আমাকে গায়ে দেয় না, পরে হাঁটতে বের হয় না।
একদিন কি মনে করে তিনি আমাকে নিয়ে নিচে নামলেন। তার একটা বাইক আছে। ইভ্যালি থেকে সস্তায় কিনেছিলেন।
সেই বাইক মোছার কাজে আমার নতুন কর্মজীবন শুরু হল।
আজ সেই বাইকে করেই আমি এসেছি কাওরান বাজারের পাইকারি মাছের আড়তে। ভাবীর ইচ্ছা হয়েছে ইলিশ মাছ খাবেন। তাই বায়না ধরেছিলেন যেখান থেকে পারো ইলিশ কিনে আনতে৷
মালিক কিনে এনেছেন ইলিশ। আমি এতক্ষণ বাইকের ট্যাংকের পাশে ঝুলে ঢাকার আকাশ দেখছিলাম। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আর বাইকের তেলকালি মুছতে মুছতে আমার চেহারা হয়েছে পাতিলের তলার মতো।
মালিক এসে ইলিশের ব্যাগটা ঝোলালেন আমার পাশেই।
আমি দেখতে পাচ্ছি ঝোলার মধ্যে দুই জোড়া ইলিশ। ওগুলো মরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
দোকানী তাকে বলেছে এগুলো চাঁদপুরের ইলিশ। কিন্তু এগুলো আসলে পতেঙ্গার ইলিশ। একটুও স্বাদ হবে না।
শুধু মনটা খারাপ হচ্ছে এই ভেবে এদের গায়ের আঁশটে গন্ধওয়ালা ময়লা আমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন