মা মেরি ক্রুশবিদ্ধ যীশুর দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলো

৩৬৮ পঠিত ... ১৮:০১, নভেম্বর ১৩, ২০২৩

20

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে মা মেরি ক্রুশবিদ্ধ যীশুর দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলো। এ এমন এক জনপদ যেখানে নজরুলের গানে এ আর রহমান সুরের বিভ্রাট ঘটালে আক্রোশে ফেটে পড়ে মধ্যবিত্ত, কোক স্টুডিওর কনসার্টে অব্যবস্থাপনা হলে তা নিয়ে প্রবল অসন্তোষ দানা বাঁধে, হিজাবওয়ালী বনাম কপালের চেয়ে বড় সাইজের টিপওয়ালির সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ তৈরি করে; তাদের সমর্থনে হিজাব ও টিপ পরে প্রতিবাদ জানায় এফিমিনেট পুরুষেরা।

কিন্তু ঐ যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে জালালউদ্দিনের লাশ পড়ে রইলো; তার নয় বছরের মেয়ে মরিয়ম অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো তার আব্বার নিথর দেহের দিকে; এতে সংস্কৃতি মামা-খালা ও ট্রেন্ডি ব্রো-আপ্পিদের কিচ্ছুটি এসে যায় না। তারা হচ্ছে একটিভিস্টস অফ স্মল থিংস, সংস্কৃতি ও লাইফ স্টাইলের কুল ডুড।

শোকের ক্যালেন্ডারটা বানিয়ে দেয়া আছে; সেইখানে কবে কার বাবা-মা-ভাই-আত্মীয়ার মৃত্যুতে কাঁদতে হবে; কবে তাদের জন্মদিন সব ঠিক করা আছে। চাঁদের বুড়ি অন্যের চরকা কাটতে কাটতে হঠাত ডুকরে কেঁদে ওঠে; অমনি সে শোকের বটমলেস অয়েলে "কাঁদো বাঙালি কাঁদো" বলে লেগে পড়ে পাতকূয়া সমাজ। ঐ কান্নার উতসবে, যেমন খুশি তেমনি কাঁদোতে পারফরমেন্স অনুযায়ী জুটে যায় পদ-পদক-প্লট।

গারমেন্ট শ্রমিক জালালউদ্দিনের জন্য কাঁদলে কোন পদ-পদক-প্লট নেই। কাজেই প্রফেশনাল রুদালি গ্যাং রেডিও মিরচিতে গান ও কৌতুক শুনে হাহা করে হাসতে থাকে। কেউ তাদের সামনে জালালউদ্দিন কিংবা আঞ্জুয়ারার লাশ দেখালে প্রফেশনাল রুদালিদের কোয়ালিটি টাইমে বিঘ্ন ঘটে। কারণ তাদেরকে বায়োপিক দেখে কেন্দে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেখানে সেখানে তারা কাঁদে না।

বেড়াল ৭০০ টি ইঁদুর খেয়ে হজ্জ্ব করতে গিয়ে কেঁদে আকুলি বিকুলি হয়; প্রার্থনা করে যেন, ইঁদুরের সাপ্লাই যেন একই রকম থাকে। বেড়াল দীপাবলির বাতি জ্বেলে  "অন্ধকার দূর হোক" বলে নান্দনিক আবহ তৈরি করে। কিন্তু জালালউদ্দিন কেন মারা গেলো; নিরস্ত্র জালালউদ্দিন কারখানা থেকে ফিরে যাবার সময়; পুলিশের গুলিতে কেন আহত হলো; পুলিশের একপেশে গুলি; পত্রিকা তাহলে "সংঘর্ষে" নিহত কেন বলছে! নাহ কোথাও কোন প্রশ্ন নাই।

পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে গারমেন্ট শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। অথচ রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে মধ্যবিত্তের সমর্থন থাকে, এক্টিভিজম থাকে। আত্মকেন্দ্রিক ফাঁপা মধ্যবিত্তের কোলাহল কম থাকে। সারাবছর কোয়ালিটি টাইম কাটানোর মতো স্বার্থপর লোকের সংখ্যা অন্যান্য সমাজে কম। শুধু ‘আমি আমি আমি আর আমার সন্তান যেন থাকে পিতযা-পাস্তাতে’; আর জালাল-আঞ্জুয়ারার সন্তানেরা অনাথ-অনাহারে ম্লান থেকে ম্লানতর হোক; তাতে ফিলিটাইন্স কিংবা নিও এফলুয়েন্টের কী এসে যায়!

সমাজে দুই রকম জালাল থাকে; সরল জালাল আর ধূর্ত জালাল। ধূর্ত জালাল ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তিনটি কারখানা করে; ঋণখেলাপি হয়ে ছাকানাকা খেলতে খেলতে সহমত ভাই হলে; বণিকের মানদণ্ড দেখা দেয় রাজদণ্ড রুপে। ধূর্ত জালাল টাকা পাচার করে, সেকেন্ড হোম করে; তার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে অথবা কিছু একটা পাশ দিয়ে না দিয়ে এসে, বাপের নতুন জমিদারিতে গদিনশীন হয়। আর সরল জালাল দিনমান কাপড় সেলাই করে। এক একটা ডিজাইনার পোশাক অনেক দামে বিক্রি করে চালাক জালাল। কিন্তু তবুও বোকা জালালকে লভ্যাংশের সামান্য ভাগ দিতে আপত্তি তার। স্লামডগ বিলিয়নেরা এইরকম নরভোজি হয়। মজুরি বাড়াতে বললে, খেয়ে ফেলে জালাল ও আঞ্জুয়ারাদের।

এই ম্যানিম্যাল ফার্মে বণিকের হাতে রাজদণ্ড; ফলে তার পক্ষেই রাষ্ট্রের পলিসি। এই যে উন্নয়নের ঠুমরি, আইকনিক স্থাপনা নির্মাণের আলকাপ নৃত্য, চালাক জালাল-বাচ্চু-কাচ্চুদের নতুন জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত; এই সব কিছুতে মিশে থাকে ‘হাউ মাউ খাউ শ্রমিকের রক্ত খাউ’। স্লামডগ বিলিওনিয়াররা সরকারের কোলাবরেটর হয়ে দ্রুততম ধনী হওয়ায়; ঠিক কত টাকা লুট করলে চলে; সে হিসাব করার জীনগত সামর্থ্য নেই তাদের। তাই তো শোষণ ও লুন্ঠনের পাহাড় ক্রমে ক্রমে পর্বত হয়ে ওঠে।

হে হে হে হে করে এই নরভোজি প্রক্রিয়াটিকে সমর্থন জানালেই এখানে দেশপ্রেম করা হয়; হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির গর্বে গাল ফুলানো যায়। এরকম হীন মানুষের সদর্প পদচারণা; সংগীত-ধর্ম-সংস্কৃতি ও দেশচেতনা নিয়ে সগর্ব আলোচনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

সেই যে এরা দীন হীন শৈশবে ‘চৌধুরী বাড়ির রাস উৎসব’ দেখে নৌকার মাঝির কাছে আক্ষেপ করেছিলো, নাদের আলী আমি আর কত বড় হবো!  সেই নৌকার মাঝি তাদের দ্রুততম সময়ে অনেক বড় করে দিয়েছে। জীর্ণ পোশাক খুলে ডিজাইনার ড্রেস পরিয়েছে, কুঁড়ে ঘর সরিয়ে প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছে, গরুর গাড়িটাকে পোর্শে-প্রাডো দিয়ে রিপ্লেস করেছে, বউটাকে বিউটি এপস দিয়ে "হেলেন অফ ট্রয়" বানিয়ে দিয়েছে।

এইসব ক্ষমতার সুফল সম্ভোগে মাতোয়ারা ম্যানিম্যাল ফার্মে তাই বাচ্চাদের ভিডিও গেমসের মতো করে মানুষ মারা হয়। ক্যানিবালদের কোয়ালিটি টাইমে সামান্য বিঘ্ন ঘটালেই; কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই; ক্ষমতা ভালুকটি ঘাড় মটকে দেয় সাধারণ মানুষের।

ক্রুশবিদ্ধ যীশুর লাশ নিয়ে মা মরিয়ম ঢাকা থেকে নেত্রকোণার দিকে যাত্রা করে; ঢাকা টাকার শহর; হেথাক তোমায় মানাইছে না গো। নেত্রকোণাতেই না হয় আধপেটা খেয়ে থাকতে জালাল; তবু তো এমন ক্ষমতার নৃশংস গুলি খেতে হতো না তোমায়!

৩৬৮ পঠিত ... ১৮:০১, নভেম্বর ১৩, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top