ছায়াঢাকা গ্রামের মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আনন্দে বসবাস করে সেখানে। এই গ্রামেরই জগন্নাথ ও জগলুল প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করে ফিরে আসে গ্রামে আলো জ্বালাতে। গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে; তবু কীসের আলো জ্বালবে তারা; এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে গ্রামবাসী।
কৃষক, তাঁতী, কামার, কুমোর, জেলে, ক্ষুদ্র দোকানী, হাটুরে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। আর জগলুল ও জগন্নাথ হাতে মোটা মোটা বই নিয়ে ঘুরে। লোকজনের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করে।
জগন্নাথ একদিন ঘোষণা করে, রবীন্দ্রনাথ ইজ আ কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। সে উঠতে, বসতে, খেতে, ঘুমাতে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দেয়। গ্রামের হাটে বসে সবাইকে আমন্ত্রণ জানায়, আজ সাঁঝে আমার গৃহে এস; আজ আমরা রবীন্দ্রনাথ লইয়া আলোচনা করিব।
এইভাবে শীঘ্রই একদিন জগন্নাথ দাবি করে, যারা তার বাটিতে নিয়মিত রবীন্দ্র-চর্চা করেছে; তারা এ গ্রামের সংস্কৃতি সমাজ। বাকি মানুষ এ আলোর সন্ধান পায়নি, সুতরাং তাদের আলোকিত করতে হবে।
রবীন্দ্র আলোয় আলোকিত লোকেরা সাঁঝ হলেই জমিদারের বেশে জগন্নাথের বাড়িতে আসে। নানারঙ্গে হাসে; অন্যরা যারা পিছাইয়া পড়িল, তাদের নিয়ে টিটকারি করে। এইভাবে একটা আমরা ও ওরার দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলো ছায়াঢাকা গ্রামে।
জগলুলও বসে থাকার পাত্র নয়। সে ঘোষণা করল, ভাসানী ইজ আ কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। সে উঠতে বসতে খেতে ঘুমাতে ভাসানীর উদ্ধৃতি দিয়ে একদল অনুসারী তৈরি করল। জগলুলের গৃহে শুরু হলো ভাসানী পাঠ চক্র।
এইভাবে ভাসানীর আলোয় আলোকিত হয়ে সাঁঝ হলেই সুফিসাধকের বেশে লোকজন জগলুলের বাড়িতে আসে। হাসে, গায়, যারা সাম্যবাদ বুঝল না তারা যে পিছিয়ে পড়ল তা নিয়ে আক্ষেপ করে। আমরা ও ওরার দ্বন্দ্বে গ্রামময় একটি বিভাজন উপস্থিত হলো।
গ্রামে রবীন্দ্রনাথ ও ভাসানী এই দুই ধরনের দাড়ির প্রচলন হলো। রবীন্দ্র টুপি ও ভাসানী টুপি বিক্রি হতে শুরু করল গ্রামের বাজারে। রবীন্দ্রনাথের লালনবাদ ও ভাসানীর পালনবাদ নিয়ে ঠোকাঠুকি চলল হাটে-মাঠে-ঘাটে-নদীর তটে।
গ্রামের পুরুষদের নাহয় দাড়ি ও টুপি বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রবাদী ও ভাসানীবাদী হিসেবে আলাদা কর গেল; কিন্তু নারীদের মাঝে কোনো পার্থক্য করা যাচ্ছে না; এই চিন্তায় জগলুল পথনির্দেশনা দিল, কুঁচি দিয়া শাড়ি পরিয়া; উদয় কিংবা অস্তগামী সূর্যের মতো বিশাল একখানি টিপ পরিতে হইবে কপালে। বাজারে টিপের পাতা বিক্রি বেড়ে গেল; আবার কমেও গেল। কারণ ভাসানী ভক্ত নারীরা রবীন্দ্র ভক্ত নারীদের টিপ পরিবার ঢং দেখিয়া উহা বর্জন করিল। আর শাড়ি পরার স্টাইলে পরিবর্তন আনলো ভাসানি ভক্তরা। তারা রাণী ভবানীর মতো এক প্যাঁচে শাড়ি পরার স্টাইল অনুসরণ করল। খানিকটা মাথায় কাপড় দেওয়ার ভঙ্গি করল।
জগন্নাথ নারী সমাবেশে গর্ব প্রকাশ করল, রবীন্দ্র নারীরা আধুনিক আর ভাসানী নারীরা অনাধুনিক। অমনি পাতকূয়াতলায়, পুকুর ও নদীর ঘাটে দুইদল নারীর বিবাদ উপস্থিত হলো।
গ্রামের মওলানা ও পুরোহিত মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করল, এই জগন্নাথ ও জগলুল শিক্ষিত হয়ে গ্রামে ফেরার আগে পর্যন্ত সবাই একই রকম ছিল। কোনো বিভাজন ছিল না। রবীন্দ্রনাথের লালনবাদ ও ভাসানীর পালনবাদ একইরকম শক্তিমান সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী ধারণ করে মানবকল্যাণে ব্রতী হবার আহবান; তবে কেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব!
গ্রামে জগন্নাথের নেতৃত্ব রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে মিছিল ও রবীন্দ্রিজম চালু হলো। জগলুলের নেতৃত্বে শুরু হলো ভাসানীর ছবি নিয়ে মিছিল। ভাসানিজম নিয়ে জগলু অনুসারীরা সম্মেলন করল।
জগলু ও জগাইয়ের আলোর ডাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়লো গ্রামময়। গ্রামের প্রবীণেরা সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করল, এইসব ইজম কী খায়; নাকি পরে! ইজম আসার আগে তো খেয়ে-পরে সুখে ছিল এ গ্রামের মানুষ।
ইজমের ঠেলায় কর্মক্ষম মানুষ কায়িক পরিশ্রম বাদ দিয়ে অনুসারীদের চাঁদার টাকায় নেতা সেজে ঘুরতে শুরু করল। এইভাবে চাঁদাবাজিটা একরকম জোর জবরদস্তিতে পরিণত হলো।
গ্রামবাসী অতিষ্ট হয়ে একদিন জগলু ও জগাইয়ের অনুসারীদের দৌড়ানি দিল। জগলু ও জগাই দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিল। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে লোকজন হুমকি দিল, এইগ্রামে আর তোদের মুখ দেখতে চাই না। আমরা দিনমান কাজ করে শেষ করতে পারি না; আর তুমরা আইছো ঘোড়ার ডিমের ইজম মারাইতে!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন