আমারে কাশবনে নিবা না মাঝি!

১৯৪ পঠিত ... ১৭:০৭, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪

WhatsApp Image 2024-09-20 at 18.35.14_1608dbab

কবির মাঝি হঠাত এক ঝড়ের রাতে বজ্রপাতের মাঝে বৈঠা ফেলে নৌকার গলুই-এ সেজদা দিয়ে পড়ে থাকে; দূর থেকে আশুলিয়া গ্রামের কুবের, জালাল, মিলন আর্তনাদ করে, অ কবির ঝাঁপ দে; সাঁতরাইয়া কূলে আয়। কিন্তু সেজদার ঘোরে কবির তা শুনতে পায় না। স্থিরচিত্রের মতো অসাড় হয়ে সেজদায় থাকে। হঠাত ঝড় থেমে যায়; বজ্রপাত মিলিয়ে যায়; নৌকাটা স্থির হয়। কুবের সাঁতরে এসে বৈঠা চালিয়ে নৌকাটা কূলে নিয়ে যায়।

সেই থেকে বদলে যায় কবির মাঝির জীবন। সাত এলাকায় রটে যায়, কবির মোল্লা জ্বিন নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। এইজন্য বিপদ তার কাছে ভিড়তে পারে না। নামাজ পড়ার সময় সে ঘরের দরজা আটকে দেয়। খাবার সময় স্ত্রী রাবেয়াকে বলে, আর দুইখান প্লেট দিয়া যাও; অরাও খাইবো আমার লগে।

পাড়া প্রতিবেশীর মাঝে ঔতসুক্য বাড়ে। তারা কবির মোল্লার কাছে আসে পানি পড়া নিতে। কবির মোল্লা ধমক দেয়, আমারে এইসব বেদাতি কথা কইবা না; আমি হেদাতি লোক।

এলাকায় কবির মোল্লার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। মহল্লার মসজিদে তার আশেপাশে ভীড় বাড়তে থাকে। মোনাজাতের পর সবাই অনুরোধ করে, কবির মোল্লা আন্নে কিছু কন! আন্নের কথা শুনতে চাই। কী কইরা ঝড়-বজ্রপাতরে আপনি তাগো বাড়ি ফেরত পাঠাইলেন। কবির মোল্লা কথা বলে কম; ইশারায় সবাইকে থামতে বলে।

ঢাকায় জাসদের এক নেতা জামায়াতের শীর্ষ পদে গেছেন। তিনি ইনুর মতো সুমিষ্ট ভাষায় কথা বলেন; আর ট্যালেন্ট হান্টিং করে বেড়ান। তার কানে কবির মোল্লার বুজরুকির গল্পটা পৌঁছালে তিনি গাড়ি নিয়ে আশুলিয়া আসেন। বড় রাস্তায় গাড়ি রেখে সরু এবড়ো থেবড়ো পথ হেঁটে পৌঁছান কবির মোল্লার বাসায়। এলাকাবাসী এতে পুলকিত হলেও কবির মোল্লার বিশেষ বিচলন দেখা যায় না। সে শুধু নেতাকে বলে, এই বেপর্দা বেলাজ বেশরম বেদাতি সমাজে হেদায়েতি শাসন চাই। পারলে সেইটা করেন; আমারে বিরক্ত করবেন না।

বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় পরিস্থিতি দেখে, জামায়াত নেতা বলেন, দোয়া করো ভাই; তোমার মতো পরহেজগারের দোয়া নিশ্চয়ই আল্লাহ কবুল করবেন।

আশুলিয়াতে কবির মোল্লার প্রভাবের কথা শুনে পুলিশ মনির একদিন গাড়ি চালিয়ে তার বাড়ি আসে। তল্লাশি চালিয়ে কোন জিহাদি বইপুস্তক না পেয়ে; বেহেশতি জেওর সামনে রেখে ছবি তুলে তাকে জঙ্গী হিসেবে গ্রেফতার দেখায়। সাড়ে চুয়াত্তর টিভি জার্নালে রুমাল দত্ত থিওরি দেয়, কবির মোল্লার কোন সিরিয়া কানেকশন নিশ্চয়ই আছে।

পরে ৫ অগাস্টের পর কবির মোল্লা মুক্তি পেয়ে এলাকায় এলে বিরাট নেতা হয়ে যায়। মহল্লার মুসল্লীরা জিজ্ঞেস করে, অহন আমগো করণীয় কিগো মোল্লা!

মোল্লা কথা কম বলে। তার একটাই দাবি, হেদায়েতি শাসন চাই।

দুপুরে খেতে বসে রাবেয়া বলে, অ মাঝি তুমি এমুন হইলা ক্যান! কতদিন আমারে কাশবনে বেড়াইতে নিয়া যাওনা! আইসক্রিম কিইনা খাওয়াও না।

কবির মোল্লা কোন কথা বলে না। মুখটা কঠোর করে রাখে। শয়তানের বাক্স বলে ১৪ ইঞ্চি টিভিটা তুলে আছাড় মারে। টিভিটা ভেঙ্গে মারা যাওয়ার আগে শেষ খবর দিয়ে যায়, রুমাল দত্ত ক্লিন শেভ করে ভারতে পালানোর সময় গ্রেফতার।

রাবেয়া মনমরা হয়ে থাকে। ঝড়ের আগের জীবনের ছোট ছোট হাসিকান্নার স্মৃতি নিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকে। মানুষটা কত নরম শরম ছিলো। প্রত্যেকদিন বাড়ি ফেরার সময় একটু গুড়ের জিলাপি কিংবা চানাচুর কিনে আনতো। বউয়ের সঙ্গে বসে কুটুর কুটুর করে গল্প করতো। আর টিভিতে মোশাররফ করিমের হাসির নাটক দেখে হাসিতে হুটোপুটি খেতো। প্রত্যেক শুক্রবার বিকেলে নৌকায় করে দেড় মাইলের কাশবনে নিয়ে যেতো। আমড়ার মধ্যে একটু বেশি করে বিট লবণ ছিটিয়ে এনে বলতো, আমার বউয়ের লবণডা বেশি লাগে। ও বউ একটু মিঠা হইতে পারো না। রাবেয়া মুখ ঝামটা দিয়ে বলতো, ঢং কইরো না মাঝি।

রাবেয়া এবার চেপে ধরে কবিরকে, আজ বিকালে আমারে কাশবন দেখাইতে নিয়া যাবা মাঝি; নাইলে আমি তোমার ভাত খামু না। বাপের বাড়ি চইলা যামু।

আচম্বিতে কি যে হয়; কবির পাগলের মতো দৌড়াতে শুরু করে কাশবনের দিকে; কামারের দোকান থেকে তুলে নেয় কিরিচ ও চাপাতি। রাবেয়াও দৌড়াতে থাকে পেছনে পেছনে।

কবির মোল্লা কাশবন কাটতে কাটতে বলে, এইখানে যত বেদাতি কাম কাইজ চলে; সেইখানে আসার এতো কেন খায়েশ!

রাবেয়া কবির মোল্লার হাত চেপে ধরে, এত সুন্দর কাশফুল দেইখা কি কোনো মায়া-দয়া হয় না মাঝি। আল্লাহ কাশবনরে এতো সুন্দর কইরা সৃষ্টি করছে; আল্লার দোহাই লাগে; সুন্দর জিনিস নষ্ট কইর না!

কবির ধাক্কা দিলে মাটিতে পড়ে যায় রাবেয়া। উঠেই উলটো দিকে হাঁটা ধরে। কাশ বন উজাড় শেষে কবির মোল্লা বাসায় ফিরে দেখে সুনশান; কোথাও রাবেয়ার কোনো চিহ্ন নেই। টেবিলের ওপর চিরকুটে লেখা, আমারে নিতে আইসো না; নিষ্ঠুর মাঝিরে আমি ভালো বাসি নাই। আমি যে মানুষটারে ভালোবাসতাম; সে এই রকম পাষাণ আছিলো না।

কবির মোল্লা ধপ করে মেঝেতে বিছানো পাটির ওপর পড়ে যায়; সংজ্ঞা হারায়। শরীর অবশ হয়ে আসে। কয়েকটা কবুতর এসে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। একটা চড়ুই ঘরময় উড়ে বেড়ায়। এইভাবে কত ঘন্টা কত দিন কবির অবশ অনড় অজ্ঞান সময় কাটিয়েছে তার হিসাব নেই। রাবেয়াকে হারানোর শোকে তার চোখের নীচে অশ্রু শুকিয়ে সাদা দাগ পড়ে যায়। ঘরের মধ্যে পাখপাখালীরা বসতি গড়ে। একটা জালালি কবুতর সেজদা দিয়ে কবিরের জীবনের জন্য প্রার্থনা করে। বাক বাকুম ঘুরুর ঘুরুর শব্দে অনেকগুলো কবুতর জাগাতে চেষ্টা করে তাকে। চড়ুইটা তার বুকে বসে নিঃশ্বাসের ওঠানামা বুঝতে চেষ্টা করে।

কী একটা বুঝে সবগুলো কবুতর আর চড়ুইটা তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে উড়াল দেয়।

১৯৪ পঠিত ... ১৭:০৭, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top