কেশব ভট্টাচার্য প্রতিদিনই ছিদ্রান্বেষণমূলক পোস্ট দিচ্ছেন ফেসবুকে। সাড়ে পনেরো বছর ঝাঁঝর লীগের শত ছিদ্র ওভারলুক করে বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে কথা বলতেন। ঠিক কী কী করলে অত্যন্ত খাঁটি বাঙালি হওয়া যাবে তার উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি রচনা করতেন তিনি। কিন্তু এখন বিপ্লবী তরুণদের সূচের একটি ছিদ্র খুঁজতে পেরেশান হন কেশব।
১৪ জুলাই রাত থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের ছিদ্রান্বেষণ শুরু করেন। কোন লাশটি শিবির ছিল, কোনটি হিজবুত তাহরীর, কার মুখে এক গাছা দাড়ি ছিল; কে তার ফেসবুকে ইসলামি চেতনার কথা লিখেছিল; এইসব কুঁচ কুঁচানি করতে করতে লাইকের দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে যান তিনি।
৫ আগস্ট থেকে কেশব ভট্টাচার্যি মশয়ের যৌবনে দোলা দেয়; দেড় দশক পরে বিরোধী দলের স্বাদ পাচ্ছেন তিনি। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন তিনি। যে কোনো ঘটনাকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে যতটা বড় করে তোলা যায় আর কী। প্রথম ধাক্কায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুদের ওপর হামলাকে তিনি ‘সংখ্যালঘুর’ ওপর হামলা বলে চিহ্নিত করেন। অথচ বিএনপির নিপুণ রায়ের ওপর হামলা হলে তিনি আকর্ণ হাসিতে চটুল রস করতেন। গয়েশ্বর রায়কে পিটিয়ে তারপর হারুনের ভাতের হোটেলে নিয়ে গেলে তিনি মুচকি হেসে ভিডিও শেয়ার করেছিলেন। সেই যে নাসির নগরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীকে ফাঁসাতে ঐ দলের একজন এমপি বহিরাগত মাস্তান দিয়ে হিন্দুপল্লীতে হামলা করলে; ভট্টাচার্যি মশয় শতমুখে বিএনপি-জামায়াতকে ঐ হামলার জন্য দায়ী করেছিলেন।
ভারতের নরেন্দ্র মোদীর রামমন্দির ফেস্টিভ্যালের সময়; তিনি জয় শ্রীরামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন। আসমুদ্র হিমাচল গেরুয়া পতাকা ওড়ানোর সম্ভাবনার কথা বলে খলবল করে উঠেছিলেন।
তুরস্কে কুচক্রী এরদোয়ান কীভাবে একটি চার্চ থেকে জাদুঘরে পরিণত করা হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তর করেছে; সেটা বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। ভারতের হাসপাতালে নারী ডাক্তার নির্যাতিত হলে ভট্টাচার্য খুঁজে বের করেন; পাকিস্তানের হাসপাতালে নারী ডাক্তার নির্যাতিত হবার ঘটনা।
চেহারা অবয়বে কেশব আর্য নন; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে তার ঠাকুর দাদা কোনো জমিদারি পাননি; কিন্তু সারাদিন বংকিম বংকিম করতে করতে তিনি সাক্ষাত জমিদারের নাতি হয়ে উঠেছেন। ফেসবুকে যখন ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিশেষজ্ঞ অভিমত রাখেন, তখন সবাইকে তার নিম্নবর্গের মানুষ মনে হয়। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইতিহাস মুছে দিয়ে তিনি নতুন থিওরি বের করেন, ঐ যে যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি; তাদের উত্তর পুরুষ সবাই ‘রাজাকার’ হয়েছে। অতএব তাদের দমন ও নির্মূল করা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির দায়িত্ব। তাই তো ১৪ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট তিনি বৈষম্য বিরোধীদের নির্মূলের চিয়ার লিডার হয়েছেন।
কেশব যে কালচারাল ক্লাসের লোক; সেখানে তার কখনও কয়েক প্রজন্মের লিবেরেল মুসলমানদের সঙ্গে দেখা হয়নি; যারা রবীন্দ্রনাথ ও রুমীকে ভালোবাসে। কোরআন, বাইবেল, গীতা সবই পড়েছে। বিশ্ববীক্ষা তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। তাদের বুক শেলফে একই সঙ্গে গান্ধী-নেহেরু-জিন্নাহ-সুভাষ বোস-শেরে বাংলা-সুহরোয়ার্দী-ভাসানী-মুজিব থাকে। যেহেতু অস্পৃশ্য করে দেবার সাবকালচারটা লিবেরেলদের অভিধানে নেই; তাই কেশব তার বিভাজন আর বিদ্বেষের বিষে ভরা মাথায় তা বুঝে উঠতে পারে না। নিজের ঐ দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতায় গোটা পৃথিবীটাকে স্পৃশ্য ও অস্পৃশ্য দুইভাগে ভাগ করে রাখে।
কেশব তার এই কুঁচকুঁচানির কারণে লিবেরেল হিন্দু বন্ধুদের প্রায় সবাইকে হারিয়েছে। অবশেষে সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, ললিতাদিকে নিয়ে সাজিয়েছে বৈঠকখানা।
হাসিনা ও তার দোসররা লক্ষ কোটি টাকা লুণ্ঠন করে পাচার করে দিল; তা নিয়ে কেশব স্পিকটি নট ছিল; কিন্তু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা কত টাকা খরচ করল; কত টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখেছে; তা নিয়ে পেরেশান হয়ে যায়।
ললিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কী যে শুরু হয়েছে!
কক্সবাজারে কয়েকটি ডোয়ার্ফ মোল্লা নারীর সঙ্গে পোশাক পুলিশি করলে, কেশব আলতো করে বলে, শরিয়া আইন এসে গেল।
সহমত ভাই বলে, কী যে শুরু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা কাওয়ালি গাইলে কেশব ছ্যা ছ্যা করে বলে, এসব কোনো কালচার হলো! ক্যাম্পাস এখন শিবিরের দখলে।
ললিতা চুক চুক করে বলে, কী যে শুরু হয়েছে।
কেশব নিজেই জগন্নাথ হলে পুজো প্যান্ডেলে পুজো-আর্চা করে রমনা কালী মন্দিরে গিয়ে ঢোলের বাড়িতে নেচে ফেসবুক লাইভ করেছে গত বছরেও। কিন্তু যেখানেই একটু কোরআন তেলাওয়াতের কিংবা হামদ নাত গাইবার কথা শোনে; কেশব বলে, দেশটা সৌদি আরব হয়ে গেল।
সহমত ভাই বলে, কী যে শুরু হয়েছে।
কেশব ১৫ বছর ধরে জামাত জুজু দেখালেও জামাতের ভোট ২-৩ শতাংশের বেশি বাড়েনি। শরিয়ত ভাই জোশের ঠেলায় মাজার ভেঙে, সামাজিক ও পোশাক পুলিশি করে, বাংলা কলেজে মেয়েরা কাওয়ালি শুনতে এলে তাদের পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়ে যখন ভাবছে; এইবার এইবার বিপ্লব হাইজ্যাক করা গেল; হঠাৎ জামায়াতের নেতা বলে বসেন, ভারত অখুশি হয় এমন কোনো কাজ আমরা করব না! আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সময় নিয়ে পরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে কোনো অসুবিধা নাই।
শরিয়ত ভাইয়ের এই নির্বাচন পরে হলে হোকনাতে রেগে কাঁই হয়ে রহমত ভাই চাঁদাবাজিতে মন দেয়।
কেশব তখন বলে, কী যে শুরু হলো!
ললিতা বলে, সহমত ভাই চাঁদা নিলে আরাম; রহমত ভাই নিলে হারাম।
শরিয়ত ভাই এসে যোগ দেয়, আমরা অত্যন্ত অনেস্ট; চাঁদাবাজি করি না।
ধীরে ধীরে শিবব্রত দাদা ও শরিয়ত ভাই ঘন হয়ে আসে। মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের কারণে সহমত ভাই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে; প্রয়োজনে ভোটগুলো শরিয়তের বাক্সে দেবে। তবু ঠেকাতে হবে রহমত ভাইকে।
কেশব ভট্টাচার্য তখন চাণক্যের ছবি শেয়ার করে বলেন, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন