শিবব্রত ও শরিয়তের বিদ্বেষের যৌবনজ্বালা প্রত্যাখ্যান করুন

৯৩ পঠিত ... ১৭:২৯, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

17

আমার বেড়ে ওঠার রেলশহর ঈশ্বরদী, শিক্ষানগরী রাজশাহী কিংবা বড়াল নদীর ধারের নানা বাড়ির গ্রাম আড়ানীতে কখনও পাছে লোকে কিছু বলে নিয়ে ভাবতে হয়নি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কখনও চিন্তা করতে হয়নি; এখানে মাটিসঞ্জাত সংস্কৃতি, পশ্চিমা সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতি নাকি হিন্দু সংস্কৃতির উপাদান ব্যবহার করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে থিয়েটার নির্দেশনা দিতে গিয়ে একজন নারী অধ্যাপক প্রথম আমাকে অভিযুক্ত করলেন, আমি ভারতীয় সংস্কৃতি বেশি ব্যবহার করি। ভারতপন্থীর তকমা দেন আমাকে। কর্মজীবনে ধর্ম পরিচয় নয় কেবল গায়কীর যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে সংগীতের অডিশন পরিচালনার পর বাংলাদেশ বেতারের উপ মহাপরিচালক বললেন, জার্মানি যাচ্ছ যাও; ওটাই আদর্শ জায়গা তোমার জন্য; যে ইসলামোফোবিয়া এখানে দেখিয়ে গেলে।

জার্মানি পর্ব সেরে মাঝে ঢাকায় বছর দুয়েক কাটিয়ে পাকিস্তানে গেলে; ঢাকায় সহমত ভাই-শিবব্রত দাদা ও ললিতা আপাদের কেউ কেউ পাকিস্তান পন্থীর তকমা দেয়।

ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে এই পাছে লোকে কিছু বলে-র ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, লেখালেখির ক্ষেত্রে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতাও নেই তাদের সঙ্গে। তারা আমাকে ঈশ্বরদী-রাজশাহী-আড়ানীর কমফোর্ট জোন দিয়েছেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে তারা আমার মধ্যে কেবল বাংলাদেশ দেখেন; সপ্রশংস ভঙ্গিতে বাংলাদেশ সমাজ ও সংস্কৃতির কথা জানতে চান।

একটি রাজধানী শহরকে অত্যন্ত উদার ও ননইনটেফিয়ারিং হতে হয়। কসমোপলিটান শহর হতে গেলে সংস্কৃতির বৈচিত্র্য লালন করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাওয়ালি গাইতে দেখে অত্যন্ত শিক্ষিত ও সংস্কৃতিপ্রবণ কিছু মানুষ ছাত্রদের ইসলামপন্থীর তকমা দিলেন। ফেসবুকের কালো মানিক গ্যাং আরেকধাপ এগিয়ে তাদের হিজবুত তাহরীর বললেন। আর এর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হিন্দু তকমা দিতে ও মঙ্গলশোভাযাত্রাকে হিন্দুয়ানী কালচার তকমা দিতে দেখেছি ধূসর মানিক গ্যাং-কে।

এই যে বৃটিশ আমলের হিন্দু জমিদার ও হিন্দু প্রশাসকদের এঁকে দেওয়া কালচারের লক্ষ্মণরেখার মাঝে আটকে থাকা ব্ল্যাক পার্ল গ্যাং; আর পাকিস্তান আমলে মুসলমান জমিদারদের এঁকে দেওয়া কালচারের লক্ষ্মণরেখার মাঝে আটকে থাকা গ্রে পার্ল গ্যাং; এদের চিন্তার সংকীর্ণতার আর বিদ্বেষের অনলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকার সমন্বয়ী সমাজ।

একই পুরান ঢাকার র‍্যাংকিন স্ট্রিটে কবি আমির খসরু রচিত কাওয়ালি চর্চা আর ওয়ারিতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত চর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই আমরা বনাম ওরার আমদানি হয়েছে নতুন ঢাকার ধানমণ্ডি-গুলশানে।

৪৭-এর পর হিন্দু বাড়ি দখল করে নতুন জমিদার হওয়া লোকটি আমির খসরুর কাওয়ালিকে নিজের আর রবীন্দ্রনাথের অপর করেছে। ৭১-এর পর অবাঙ্গালির বাড়ি দখল করে নতুন জমিদার হওয়া লোকটি রবীন্দ্রনাথকে নিজের আর আমির খসরুর কাওয়ালিকে অপরের করেছে।

দখল করা হিন্দু বাড়ির বুকশেলফে জিন্নাহর জীবনী; দখল করা অবাঙ্গালি বাড়ির বুকশেলফে নেহেরুর জীবনী। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৃটিশ কোলাবরেটর কালচার কিংবা ১৯৪৭ সালের অল্পস্থায়ী বন্দোবস্তীর পাকিস্তানি কোলাবরেটর কালচার; এগুলো সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল রাষ্ট্র ক্ষমতার বেনিফিশিয়ারি হবার ফজিলতের ওপর।

কিন্তু বাংলাদেশে এস এম সুলতানের পেশীবহুল কৃষক-কারিগরের যে বৃটিশ পূর্ববর্তী সংস্কৃতি; তা ছিল সমন্বয়ী। সেখানে মহাভারত এবং কারবালার পুঁথি দুটোই হৃদয়গ্রাহী ছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় জনগোষ্ঠীর কাছে। বৃটিশ আমলে বংকিম চন্দ্র ‘বন্দে মাতরম’ বলে মুসলমানের বাঙালিত্ব খারিজ করে দিলেন। পাকিস্তান আমলে ফররুখ আহমদ ‘নারা-এ তাকবির’ বলে হিন্দুকে অপর বা আদার করে দিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কাঁধে চড়ে বংকিম ফিরে এল জয় শ্রীরাম স্লোগান নিয়ে। আর জামায়াতের কাঁধে চড়ে ইঞ্চি ইঞ্চি গান লেখা হালের বিরিঞ্চির হাত ধরে ফিরে এল নারা-এ তাকবির।

দুটি প্রায় প্রিমিটিভ গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যর্থ আকাঙক্ষায় তাই ভারী হয়ে ওঠে প্রতিদিনের ফেসবুক। এইখানে কেউ কাওয়ালি গাইলে শিবব্রত দাদা আর তার সারিন্দা সহমত ভাই এসে কুঁচ কুঁচ করে বলে, পাকিরে পাকি। আর কেউ রবীন্দ্র সংগীত গাইলে শরিয়ত ভাই আর তার সারিন্দা নেয়ামত ভাই এসে কুঁচ কুঁচ করে বলে, রেন্ডিয়ারে রেন্ডিয়া। লুক এট দ্য কালচারাল লেভেল অফ দিজ হিলারিয়াস ক্লাউন্স।

এদের ডিএনএ-তে বিদ্বেষের থকথকে কাঁদা। জাতে ওঠার জন্য একদল গুম্ফ কেটে শুধু দাড়ি নিয়ে মাজার ভেঙে বেড়াচ্ছে; আরেকদল ব্ল্যাক পার্লের মতো ক্লিন শেভ করে মোদি স্বামীকে এস এস বলে করুণ মিনতিতে ডাকছে।

আপনি কবি আমির খসরু জুড়ে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে কেবল ভালোবাসার আমন্ত্রণ পাবেন। পবিত্র কোরআনে আর গীতায় পাবেন সততা আর নৈতিকতার আহবান। আর এই বিদ্বেষের দোকানী লিলিপুটগুলোর দোকানে পাবেন কেবল ঘৃণার সেক্স টয়; কালচারাল বিডিএসএম-এর বিকৃত ভোক্তা এই দুই দল ক্যানিবাল।

এই দুটি অসুস্থ ধারা থেকে আমাদের ফিরে যেতে হবে আবহমান বাংলা সংস্কৃতির সোনালী অতীতের উঠোনে।

যারা ৪৭-এর পরাজয় মেনে নিতে না পেরে আজও অখণ্ড ভারতের হিন্দুত্ববাদের স্বপ্ন দেখে; ফেসবুকে ফুরিয়ে যাওয়া ললিতা হিজাব পরা তরুণীকে দেখে পোশাক পুলিশি করে। আর যারা ৭১-এর পরাজয় মেনে নিতে না পেরে অখণ্ড পাকিস্তান থেকে আরেকধাপ এগিয়ে খেলাফত ও শরিয়া আইনের নেশায় বুঁদ। রাস্তাঘাটে ফুরিয়ে যাওয়া রাবেয়া ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরা তরুণীর সঙ্গে পোশাক পুলিশি করে। এই দুটি বিপরীত অশুভ শক্তি আসলে ঘৃণার কাঁচামালে ক্ষমতার খিঁচুড়ি রান্না করতে চায়। এরা অত্যন্ত আউটডেটেড ও নীচ। এদের প্রত্যাখ্যান করুন।

৯৩ পঠিত ... ১৭:২৯, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top