জুলাইতে এমন ভয়ংকর একটা গণহত্যা হলো, মনটা খারাপ। সেই জুলাই থেকেই। ফেসবুকে ছিলাম না। গতরাতে হুট করে মনে হলো, শেখ হাসিনার পক্ষে কি আসলেই এতটা নির্মম, অমানবিক হওয়া সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গত ১৫ বছরের বেশ কিছু ঘটনাকে এক করার চেষ্টা করলাম। উত্তরও পেলাম।
শেখ হাসিনা আসলে কে? বঙ্গবন্ধুর কন্যা। দেশরত্ন। মানবতার মা। কওমি জননী। এমন শত শত উপাধি যে মহিয়সীর নামের পাশে, তার পক্ষে কি সম্ভব এতগুলা মানুষ মারার হুকুম দেওয়ার? আপনারা হয়ত জাজ করবেন। কিন্তু আমার ক্যালকুলেশন বলছে, শেখ হাসিনার পক্ষে এতটা নির্মম হওয়া সম্ভব না।
স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি জুলাই গণহত্যা মিথ্যা? না, জুলাই গণহত্যা মিথ্যা না। জুলাই গণহত্যা বাস্তব। এই জুলাইয়ের দগদগে ঘা বাংলাদেশের মানুষের মনের ভেতর থেকে যাবে বছরের পর বছর। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই গণহত্যার পেছনে মানবতার মা, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দায় কতটুকু? এই প্রশ্নের জবাব একটু পরে দিচ্ছি।
তার আগে শেখ হাসিনার সাথে কাজ করার সময়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। শাপলা চত্ত্বরে হেফাজত কর্মীরা একত্র হতে থাকে। দেশে সবার সভা-সমাবেশ করার অধিকার আছে, শেখ হাসিনা সেটা বিশ্বাস করতেন। তিনি হেফাজতের সভা করার পক্ষেও ছিলেন। ঐদিন যাত্রাবাড়ি দিয়ে যখন হেফাজত কর্মীরা ঢাকায় প্রবেশ করছে, তখন হেফাজত কর্মীদের লেবুর শরবত ও ঠান্ডা পানি খাওয়ানো হয়েছিল জাতীয় পার্টির ব্যানারে। এই ঘটনাটি নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন, আপনাদের মনে আছে। এই ঘটনার পেছনের গল্পটা আমি বলছি—
সেদিন আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটা কাজে গিয়েছি। দেখলাম, শেখ হাসিনা কাকে যেন ফোনে বলছেন, দেশের আলেম-আওলিয়ারা ঢাকায় আসতেছে। তাদেরকে আপ্যায়ন করা দরকার। তোমরা দ্রুত লেবুর শরবত আর পানির ব্যবস্থা করো। আমি বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এরপর আমাকে টাকা দিয়ে পাঠালেন বিকাশ করতে।
সেই থেকে মানবতার মা শেখ হাসিনার সাথে আমার কাজ করা শুরু।
শেখ হাসিনার পরিকল্পনা ছিল, শফি সাহেবের সাথে সকালে নাস্তা করতে করতে ওনার কথা শুনবেন। ততক্ষণ হেফাজতের কর্মীরা যেন শাপলা চত্ত্বরে থাকে। পুলিশের প্রতি নির্দেশনা ছিল, হেফাজত কর্মীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
রাতে হেফাজত কর্মীদের জন্য গরুর খিচুড়ির ব্যবস্থাও করতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু এমন করলে দেশের আইন অমান্য হবে দেখে উনি আর করলেন না। তবে থেমেও থাকলেন না। আনঅফিশিয়ালি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন হেফাজত কর্মীদের জন্য গরুর খিচুড়ি ব্যবস্থা করেন।
সেদিন রাতে প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে তা শেখ হাসিনা জানতেনই না। বেঈমান বেনজীর সেদিন রাতে শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করার জন্য দেশবিরোধী অপশক্তির সাথে হাত মিলিয়ে রাতে এই ক্র্যাকডাউন চালায়। আপা রাতে ঘুম থেকে উঠে টিভি খুলেছেন আলেমদের একটু দেখবেন বলে। কিন্তু পুরা ঘটনা দেখে উনি একদম থ হয়ে গেলেন। একবার হার্টঅ্যাটাকও করলেন। কিন্তু শেখের বেটিকে তো আর হার্ট অ্যাটাক দমাতে পারে না, উনি উঠে দাঁড়ালেন। একজন প্রকৃত শাসকের মতো রাতের আঁধারেই বের হলেন শাপলা চত্বরের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে নিজে হেফাজত কর্মীদের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছেন। ওনার সেই রক্তমাখা চাদর এখনও আমার কাছে আছে। কিন্তু শেখের বেটি এইসব প্রচার করতে চায় না, এইসব সিম্প্যাথি উনি নিতে চায় না।
সেদিন শাপলা চত্ত্বর থেকে আমরা গেলাম ডিএমসিতে। সেখানে আমি অন্য আরেক আপাকে দেখলাম। মৃত দুই হেফাজত কর্মীর লাশ ধরে আপা তিনঘণ্টা কাঁদলেন। আমরা কোনোভাবেই ওনাকে বুঝাতে পারছিলাম না। তুলতে পারছিলাম না। বাসায় এসে উনি আরও ২ ঘণ্টা কাঁদলেন।
আমি হিসেব মেলানোর চেষ্টা করলাম। এই শেখ হাসিনার পক্ষে কি এতটা নির্মম হওয়া সম্ভব?
আসেন আর একটা গল্প বলি। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী যখন গুম, শেখ হাসিনা জানতেন না। উনি জানছেন সংবাদ সম্মেলন করার পর। আপনারা যেমন ইলিয়াস আলীকে খুঁজেছেন, আপাও খুঁজেছে। আমাকে নিয়ে আপা প্রায় রাতের বেলা বের হতেন। এরপর ঢাকার থানা, জেলখানায় ঘুরে বেড়াতেন। ইলিয়াস আলীকে খুঁজতেন। মাঝেমধ্যে বাসায় এসে কাঁদতেন।
যেদিন ইলিয়াস আলীর পরিবারের সাথে দেখা করলেন আপা, সেদিন ওরা চলে যাওয়ার পর, আপা অনেক কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললেন, আমি আর পারছি না, তুই একটু ইলিয়াসকে খোঁজ। দেশের একটা ছেলে কেন এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাবে?
সেদিন আপা নিজ হাতে ইলিয়াস আলীর মেয়ের জন্য ইলিশ পোলাও রান্না করে ইলিয়াস আলীদের বাসায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা অনেক পরে জানতে পেরেছি, আপার সেই ইলিশ-পোলাও ইলিয়াসের বাসায় যায়নি। গার্ড নিজে বাসায় নিয়ে খেয়ে ফেলেছে। আপা এত কষ্ট পেয়েছেন! সেদিন উনি আরও ৬ ঘণ্টা কাঁদলেন। এই দেশের মানুষের জন্য কাঁদতে কাঁদতেই আপার এক জীবন শেষ হয়েছে।
আমি ভাবলাম, এই আপার পক্ষে কি এতটা নির্মম, অমানবিক হওয়া সম্ভব?
অতীতের গল্প তো অনেক হলো। এবার বর্তমানের গল্প শুনুন।
জুন মাসের ৫ তারিখের ঘটনা। হাইকোর্ট সেদিন কোটা পুনর্বহাল রেখে রায় দিয়েছে। আপা আমাকে ডেকে বললেন, এই হাইকোর্ট তো কাজটা ঠিক করল না রে। মেধাবী ছেলেপেলেদেরকে আমাদের দরকার। কোটা তো অনেক হলো। আমি তো আর নিজে হাইকোর্টের বিরোধীতা করতে পারি না। তুই একটা কাজ কর, ওদেরকে বল আন্দোলন করতে। আন্দোলন করে হাইকোর্টের রায় চেঞ্জ করতে হবে।
এরপর শুনেছি উনি সাদ্দামকে দায়িত্ব দিয়ে এই কাজটি করিয়েছেন। পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছে, যেন কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের গায়ে হাত না দেওয়া হয়। উনি চীন থেকে এসে নিজেই আন্দোলনে যোগ দিতে যাবেন। আমাকে বললেন, ছাত্র জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে বুঝলি! সেই ছাত্রজীবনের মতো গলা ফাঁটিয়ে স্লোগান দেব কোটা না মেধা, মেধা মেধা। আপা অনেক এক্সাইটেড ছিলেন।
এরপর তো আসলে কী থেকে কী হয়ে গেল! শেখ হাসিনা চীন থেকে আসলেন। তার বলা বক্তব্যকে টুইস্ট করে বলা হলো, তিনি নাকি ছাত্রদের রাজাকার বলেছেন। শেখ হাসিনা সেদিনও খুব কষ্ট পেয়েছেন। অভিমানে কেঁদেছেন ২টা ঘণ্টা। এরপর আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, তোমরা ওদের সাথে কথা বলো। ওরা যদি চায় আমি পদত্যাগ করব।
১৯ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় যে ম্যাসাকার হয়েছে সেটার টুকটাক জানতেন আপা। ১৭ তারিখ বা ১৮ তারিখ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার পর শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বার হার্ট অ্যাটাক করে। যেটা নিউজে আসেনি। তিনদিন লাইফ সাপোর্টে থেকে ১৯ তারিখে স্বাভাবিক হন আপা। এরপর তো ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। আপা দিশেহারার মতো হয়ে গেলেন। পলক আইকে ডেকে বললেন, পলক তুমি দ্রুত ইন্টারনেটের ব্যবস্তা করো। দেশের মানুষ কেমন আছে, কী করছে সেটা জানতে না পারলে কিন্তু আবার হার্ট অ্যাটাক করব।
আপাকে সত্যটা জানাব নাকি জানাব না— এই প্রশ্নে আমাদেরকে সেদিন আপাকে কিছু না জানানোকেই বেছে নিতে হলো। কারণ ডাক্তার বলেছে, আপার যেকোনো মুহূর্তে তৃতীয় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
৫ তারিখ পর্যন্ত কিছুই জানতেন না আপা। ৫ তারিখে ওনাকে জানানো হয়েছে, হার্টের চিকিৎসার জন্য তাকে ভারত নিয়ে যাওয়া হবে। উনি এখনও কিছুই জানেন না। উনি জানেন, চিকিৎসা শেষ হলে ৩ মাস পরই উনি দেশে ফিরে আসবেন। আর আমরা এদিকে টেনশনে আছি, কখন আপা দেশের কথা জেনে যান, কখন তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকটা করে ফেলেন।
এই আপার পক্ষে কি জুলাই গণহত্যার মতো এমন অমানবিক হওয়া সম্ভব?
বিচারের ভার আপনাদের কেছে ছেড়ে দিলাম। আপনারাই বলেন।
আপার একান্ত সহচর
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশিষ্ট সহ-সভাপতি
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন