আমাদের সমাজে কোনো ছেলে প্রতিবেশীদের ঠিকমতো সালাম টালাম না দিলে; প্রতিবেশীরা পরামর্শ দেয়, ছেলের বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ শুরু করার পর থেকে প্রতিবেশী ভারত ঠিক মতো সালাম টালাম না পাওয়ায় নির্বাচন দিলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে এমন পরামর্শ দিতে শুরু করেছে।
অবশ্য অনন্তকাল ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলতে পারে না। নির্বাচন তো একটা দিতেই হবে। আর প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ১৯ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। আওয়ামী ফ্যাসিজমকালে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলেছে। সুতরাং দ্রুত নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাবার জন্য তাদের অস্থির হওয়া খুব স্বাভাবিক।
এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রছাত্রীরা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ক্ষমতার দাবীদার মনে করে। বাংলাদেশে যেভাবে ১৯৪৭-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর মুসলিম লীগ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ, নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ চেয়েছিলো।
পতিত আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসা সুদূর পরাহত। তবে আওয়ামী লীগের রয়েছে অভিভাবক ভারত আর সংস্কৃতি জোট; যাদের কাজ প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অপরাধের সাগরকে ছোট্ট নালায় পরিণত করা; অন্যদিকে বিএনপির অপরাধের পুকুরটিকে সাগর করে তোলা। তবে ৫ অগাস্টের পর তাদের জাতক্রোধ বিএনপি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্রদের ওপর গিয়ে পড়েছে।
জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলোর অল্প জনসমর্থন থাকলেও; ভারতে যেহেতু হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়; সেটাকে যৌক্তিকতা দিতে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিকে অনেক বড় করে দেখানো তাদের প্রচারণা কৌশলের অংশ। ভারতীয় মিডিয়ায় "বাংলাদেশ ইসলামপন্থার খপ্পরে" এই প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য; পশ্চিমা বিশ্বকে আবার একটু টেনে ওয়ার অন টেররে আনা যায় কিনা; আর জামায়াতকে ফুলিয়ে বিরাট গ্যাস বেলুন হিসেবে দেখানো যায় কিনা। প্রথম উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তবে ভারতীয় মিডিয়ার দেয়া গ্যাসে ফুলে তৌহিদি জনতা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে; আওয়ামী ফ্যাসিজমকালে যুবলীগ ও ওলামা লীগ যেরকম পেশী প্রদর্শন করেছে; ঠিক সেরকম পেশী প্রদর্শন করা যায় কিনা।
বিএনপির ১৯ বছর ধরে শুকিয়ে যাওয়া ক্যাডারেরা ৫ অগাস্টের পর দ্রুত চর্বি জমাতে চাঁদাবাজি ও পেশী প্রদর্শন করেছে। তারা মনে করছে যুবলীগের চাঁদার সাম্রাজ্য এখন তাদের। বিএনপি নেতা তারেক রহমান অভিযোগ পাওয়া মাত্র উছৃংখল যুবদল কর্মীদের বহিষ্কার করলেও; পুরোনো ধাঁচের বিএনপি নেতারা অনেকেই চাঁদাবাজি ব্যাপারটাকে ক্ষমতার উপজাত অধিকার বলে মনে করেন। তাছাড়া ফ্যাসিজমকালে জেল-জুলুম থেকে বাঁচতে বিএনপির যে নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন; তাদের মনোভাব খুনে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নরম। আর ভারত ফ্যাক্টর যেহেতু বিএনপিকে অপছন্দ করে; তাই ভারত তোষণ বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার ও থাকার পূর্বশর্ত; এমন ধারণা রয়েছে বিএনপির অনেক নেতার।
তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে বিএনপি জনপ্রিয়। এরকারণ আওয়ামী লীগের মতো চোরের মায়ের বড় গলা নেই তাদের। তারা যেহেতু সংস্কৃতি মামা পুষেনি; তাই ফেসবুকে বিএনপির কেউ জাতীয়তাবাদ শিক্ষা দিয়ে বেড়ায় না।
আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের এই যে ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামি চেতনা শিক্ষা দেবার বড় গলা; এইটাকে সবচেয়ে অপছন্দ করে সাধারণ মানুষ। দলীয় অনুদানে বেঁচে থাকা অনৈতিক পরগাছার কাছ থেকে নীতি শিক্ষা নেবার জন্য দেশের নাগরিকদের জন্ম হয়নি।
এই দিকটাতে খেয়াল রাখতে হবে রাজনীতিতে নতুন আসা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র ও নাগরিক কমিটিকে। দেশবাসীকে দেশপ্রেম শেখাতে গেলে তারা বিরক্ত হয়। কারণ তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে জীবন নির্বাহ করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রত্যাশা, ভিক্ষা চাই না তোর কুত্তা সামলা।
বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নাগরিককে প্রজা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে দাস মনোবৃত্তি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই কারণে রাজনীতিক, আমলাদের দাসজীবন থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রাসাদে এসে জনগণের প্রভু হয়ে ওঠার নেশা তৈরি হয়। যার শৈশব যত কর্কশ, হীন ও অধিকার বঞ্চিত; ক্ষমতা পেলে সে তত নিষ্ঠুর।
বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতিতে সম্ভাবনাময় দুটি দল বিএনপি ও জুলাই-এর তরুণ শক্তির কাছ থেকে তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুনগত পরিবর্তন আনার প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন