অনেকের নামই শুনবেন কাশেম। কিন্তু কাশেদ শুনবেন না খুব একটা। জি, আমাদের গাড়ির চালকের নাম কাশেদ। আজকে কাশেদের গল্প বলি।
কাশেদ খুবই যত্ন করে গাড়ি চালায়। তার যত্নের প্রকাশ হলো গাড়ির গতিতে। দেখা যায় তার পাশ দিয়ে সিএনজি, রিকশা বের হয়ে চলে যাচ্ছে আর সে শামুকের গতিতে যাওয়া লোকাল বাসের পেছনে আটকে আছে। আমি কম বুঝে চোখ বন্ধ করে থাকলেও গাড়িতে বসা পরিবারের বাকিরা গজ গজ করতে থাকে। অতিরিক্ত সাবধানতার কারণে সামনের গাড়ি আর আমাদের গাড়ির মাঝখানে বড় একটা ফাঁকা জায়গা রেখে গাড়ি চালায় সে। ফলাফল, ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে আমাদের গাড়িটাই থামায়। পরের সিগন্যালে যাওয়ার জন্য আমরা প্রায় নিয়মিতই ফার্স্ট হই। গাড়িতে বসা বাকিরা হইহই করতে থাকে, ‘ধুরো কাশেদ! আরেকটু জোরে চালাবা না! টেনে বের হয়ে যেতে পারতাম! আরেকটা সিগন্যাল খাইয়াইলা!’
কাশেদের গাড়ি চালানো আমাকে মুগ্ধ না করলেও গাড়ি ছাড়া অন্য বিষয়ের অবজার্ভেশন আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করে। গাড়িতে থাকাকালীন আমাদের আলোচনায় তার অংশগ্রহণ থেকে যা বুঝি তার কয়েকটা উদাহরণ দেই।
নমুনা ১
ঢাকার কঠিন জ্যামে বসে থেকে হঠাৎ হঠাৎই বাসের জানালার পাশে বসে মোবাইল গেম খেলতে থাকা বোকা মানুষের মোবাইল ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে দেখি। রিকশায় বসা মহিলার গয়না টেনে নিয়ে যেতে দেখি। গাড়ির ভেতরে বসে দেখা আর আ আ করা ছাড়া যেখানে আর কিছুই করার থাকে না আমাদের।
একদিন গয়না টেনে নিয়ে যাওয়ার পরে কাশেদ বলল
কাশেদ: বুঝছেন স্যার! ছিনতাইকারীরা এখন আর মুসলমান মহিলাগো গয়না ধইরা টান দেয় না।
আমি: তাহলে কারটা দেয়?
কাশেদ: হিন্দু মহিলাগো।
আমি: কেন?
কাশেদ: একমাত্র হিন্দু মাহিলারাই স্বর্ণের গয়না পইরা রাস্তায় বাইর হয়।
আমি: মুসলমান মহিলারা বাইর হয় না?
কাশেদ: ওরা অধিকাংশই ইমিটেশনের গয়না পইরা রাস্তায় ঘুরে! চিন্তা করেন! এত রিস্ক নিয়া টাইনা নিয়া যদি দ্যাখে ইমিটেশন, তাইলে কেমুন লাগব!
আমি: অ! ছিনতাইকারীরা চিনে কিভাবে মহিলা হিন্দু না মুসলমান?
কাশেদ: চিনব না ক্যান? শাখা-সিন্দুর দেখলেই তো চিনন যায়!
আমি: অ!
নমুনা ২
আমার শ্বশুরবাড়ি, মানে পুরান ঢাকার আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গেলে দেখি তাদের উঁচু উঁচু বাড়িগুলো মূল সড়ক থেকে অনেকটা ভেতরে গলি গলি তস্য গলিতে। একটা বিল্ডিং এর সাথে আরেকটা প্রায় লাগানো। বাইরে থেকে সূর্যের আলো ঢোকার উপায় নেই বলে দিনের বেলায়ও বাড়ি অন্ধকার। এটা নিয়ে বাসিন্দাদের কারোরই কোনো মাথা ব্যথা নেই। দিব্যি জীবন পার করে যাচ্ছে। একদিন এরকমই এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ফেরার পথে গাড়িতে আলোচনা হচ্ছে
আমি: রুহাম (আমার ছেলে), একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?
রুহাম: কী জিনিস বাবা?
আমি: এই যে তোর নানু বাড়ির সব বাসায়ই যে ভৌতিক! কারো বাসায়ই দিনের বেলা আলো ঢোকে না!
রুহাম: হু বাবা!
(এর মধ্যেই আলোচনায় কাশেদ ঢুকল)
কাশেদ: স্যার, পুরান ঢাকাইয়াদের সূর্যের আলো নিয়া সমেস্যা নাই ক্যান জানেন?
আমি: কেন?
কাশেদ: এরা দিনের বেলা পড়া পইড়া ঘুমায় আর সারারাত জাইগ্যা জাইগ্যা খাইতে খাইতে আড্ডা দেয়।! এগো সূর্যের আলোর দরকার কী! এগো দিনের বেলা সূর্য থাকলেই কী আর না থাকলেই কী!
আমি: হুম, কথা সত্য।
নমুনা ৩
আমার এক নিকটাত্মীয় ঢাকা শহরে নিজে থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনবে বলে মনস্থির করেছে। আমাদেরকেও বলেছে সম্ভব হলে খুঁজে দিতে। কোথায় ফ্ল্যাট কিনলে ভালো হয়- সেটা নিয়ে চলন্ত গাড়িতে আলাপ চলছে আমাদের। এর মধ্যেই কাশেদ বলল
কাশেদ: স্যার, ফ্ল্যাট কিনন ভালো গোরস্থানের পাশে।
আমি: কেন? মরলে তাড়াতাড়ি দাফন করা যাবে এই জন্য?
কাশেদ: না স্যার।
আমি: তাহলে?
কাশেদ: লোকজন গোরস্থানের কাছে থাকতে ভয় পায়, এইজন্য গোরস্থানের পাশের বিল্ডিঙয়ে কম দামে ফ্ল্যাট পাওয়া যায়। আর…
আমি: আর কী?
কাশেদ: গোরস্থানে কখনও বিল্ডিং উঠব না। এইজন্য সারাজীবন পচ্চুর আলো-বাতাস পাওন যায়।
আমি: তাই তো! আরও কারণ আছে?
কাশেদ: আছে স্যার। আশেপাশের লোকজনেরা কহনও উঁচা গলায় কথা কয় না। পারলে ফিসফিস কইরা কথা কয়। এইরকম শান্তির পরিবেশ আর কোত্থাও পাইবেন না। ঝগড়াইট্যা জামাই-বউরাও এই এলাকায় ঝগড়াঝাটি করে না।
আমি: কেন? ঝগড়াঝাটি করে না কেন?
কাশেদ: মনে হয় পরকালের ডরে। সামনে গোরস্থান থাকলে মাইনষের মন নরম থাকে সক্কল সময়।
(আপনারা যারা মাত্র কিছুদিন আগেই ফ্ল্যাট কিনেছেন তারা নিশ্চয়ই আমাকে গালমন্দ করছেন, কেন এই লেখাটা কয়দিন আগে দিলাম না! হাহাহা)
জি। কাশেদের কাছ থেকে প্রায় নিয়মিত এই ধরনের জ্ঞান লাভ হয় বলেই আমি তার গাড়ি চালানোর ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছি। হিসাব বরাবর।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন