আমার বউ যে কারণে আমাকে আর বাজার করতে পাঠায় না

১৩১৬১ পঠিত ... ১৭:৩৫, আগস্ট ১৯, ২০১৬


বাজার-সদাই করার কাজে আমার অদক্ষতা, অপদার্থতা ও অজ্ঞানতা সীমাহীন পর্যায়ে। আমার যখন অতি অল্প বয়েস, তখনই বাসার লোকজনের কাছে এ বৈশিষ্ট্যটি ধরা পড়ে। ফলে আমাকে অনেক দিন পর্যন্ত বাজারে যেতে হয়নি। কিন্তু কয়েকদিন আগে বাড়িতে কয়েকজন অতিথি আসবে দেখে মহামান্যা স্ত্রী কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে সুদীর্ঘ ফর্দ হাতে বাজারের পথে রওনা হলাম।

অলংকরণ : আবু হাসান


বাড়ির কাছেই বিশাল দুটো বাজার হয়েছে। আধুনিক বাজার, মানে সুপার শপ। ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কূলকূল ঠান্ডা পরিবেশ। কাচ-ঘেরা ঝকঝকে-তকতকে ফ্লোর। অতিকায় শেলফে থরে থরে জিনিসপত্র সাজানো। লুকানো স্পিকারে মৃদু লয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাজারের লোকজন অসম্ভব বিনয়ী, অমায়িক ও সহযোগিতাপ্রবণ। চোখাচোখি হওয়া মাত্র হাত তুলে বিনীত গলায় প্রথমে সালাম দেয়। তারপর মধুর গলায় জানতে চায়, কী খুঁজছি।

আমি তাদের সহায়তায় অতি অল্প সময়ের মাঝে ফর্দ মিলিয়ে-মিলিয়ে জিনিসপত্র খুঁজে বের করে জড়ো করে ফেললাম; উদাহরণ- চামড়া ছাড়ানো মুরগি, কাঁচামরিচ, ক্যাপসিকাম, আলু, পটল, ডিম, শসা, পাউরুটি, হ্যান্ড-স্যানিটাইজার, শ্যাম্পু-কন্ডিশনার ইত্যাদি।

ফর্দে উল্লেখ ছিল না, কিন্তু পরে কাজে লাগতে পারে চিন্তা করে আরও কিছু জিনিসও কেনা হলো; উদাহরণ- মিক্সড জুস (এটা কিনে কুপন পূরণ করে বাক্সে জমা দিতে হয়, পরে লটারি হবে, লটারি জিতলে নাকি মালয়েশিয়া বেড়াতে নিয়ে যাবে), বিশেষ ধরনের সাবান (এটাতেও লটারি হবে, জিতলে পাওয়া যাবে হিরার আংটি), সুগন্ধি নারকেল তেল (এর কাজ মাথা ঠান্ডা রাখা, অতি জরুরি জিনিস), নতুন ধরনের আঠা (চেয়ার-টেবিলের কোনো অংশ খুলে গেলে এটা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে ফেলা যায়), টিস্যুবক্স, ফয়েল পেপার, কিচেন টিস্যু, জিপারঅলা স্টোরেজ ব্যাগ (আমার স্ত্রীর কাছে এটি দারুণ সমাদৃত হওয়ার কথা), মাসালা-টি, মশা ও তেলাপোকা মারার বিশেষ ধরনের স্প্রে (৭০% ডিসকাউন্ট), দুইটা কোন আইসক্রিম (একটা কিনলে খারাপ দেখায়, তাই দুইটা) ইত্যাদি।

তালিকাভুক্ত পণ্যের মধ্যে কাঁচামরিচের অংশটুকু বিস্তারিত বলা দরকার।

আমি সেলসম্যানকে বললাম, 'ভাই, কাঁচামরিচ দেন।'
'কতটুকু দিব স্যার?’
কাঁচামরিচ কতটুকু নিলে ভালো দেখায়, সেটা আমার ধারণা ছিল না। আমি বললাম, 'দশ কেজি দ্যান।'
সেলসম্যান আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বড় বড় চোখ করে একবার তাকাল। তারপর কোথা থেকে অতিকায় সাইজের একটা প্যাকেট নিয়ে এসে কাঁচামরিচ ভরতে শুরু করল।

আমি এর আগে কাউকে প্যাকেটের মধ্যে কাঁচামরিচ ভরতে দেখিনি। পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে দেখাল, কোদাল দিয়ে মাটি কোপানোর কর্মযজ্ঞের দৃশ্যের মতো। আর দশ কেজি কাঁচামরিচ যে এত বিপুল পরিমাণে হয়, সেটাও আমার জানা ছিল না। কাঁচামরিচ খুবই হালকা জিনিস, কিন্তু দশ কেজি কাঁচামরিচ একসঙ্গে করার পর তা দেখতে যে এত বিশাল হয়, সেটা দেখার পর আমি একটু একটু ভড়কে গেলাম। এত বিপুল পরিমাণ কাঁচামরিচ দশ সদস্যের একটা পরিবার পুরো বছর ধরে চেটেপুটে খেয়েও শেষ করতে পারবে না (তাদের প্রত্যেকের যদি নিয়মিত তিনবেলা মুঠি মুঠি কাঁচামরিচ খাওয়ার অভ্যাস থেকে থাকে, তবুও), এমনকি নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করেও শেষ করা কঠিন।

আমি আমার সন্দেহ মনের মধ্যে পুষে রাখলাম না। দ্রুত ফোন দিলাম বিজ্ঞ স্ত্রীকে।
'আচ্ছা, কাঁচামরিচ কয় কেজি কিনব?'
সে টেলিফোনের ওইপাশে থেকে রাগী রাগী গলায় বলল, 'কয় কেজি কিনবা মানে? কেজি না, একশ গ্রাম কিনবা।'
আমি থতমত খেয়ে বললাম, 'মাত্র একশ গ্রাম? এরা কি শুধু একশ গ্রাম বেচতে রাজি হবে? আরেকটু বেশি কিনি?'
'তোমার যা ইচ্ছা কিনো। তোমারে আজকে কাঁচামরিচের ভর্তা আর স্যুপ বানায়ে দিব। খায়ো তুমি। আমি এখন ব্যস্ত, তোমার রঙঢঙ শোনার টাইম নাই।'

আমি ফোন রেখে সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে বিগলিত গলায় বললাম, 'ভাই, দশ কেজি কিনতে মানা আছে। আপনি আড়াইশ গ্রাম দ্যান।'

আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, সেলসম্যান গম্ভীর হয়ে বলবে, 'আড়াইশ গ্রাম বেচি না।' কিংবা এতক্ষণ দশ কেজি কাঁচামরিচ প্যাকেট করতে বলে যে বেকুবি করেছি, সে জন্য অনেক রাগারাগি করবে। কিন্তু বাস্তবে সে রকম হলো না। সেলসম্যান ছোট্ট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুই কেজি কাঁচামরিচ আবার শেলফের যথাস্থানে ঢেলে দিয়ে ছোট আরেকটা প্যাকেট নিয়ে এসে দ্রুততার সঙ্গে আড়াইশ গ্রাম মেপে দিল।

বিল মিটিয়ে ফেরার সময় দেখি, সুপার শপের দারোয়ানটা পর্যন্ত অসম্ভব অমায়িক। আমাকে বাজারের ব্যাগ হাতে নিতেই দিল না, পারলে বাসার গেটে এনে পৌঁছে দেয়। আমি ছোট্ট একটা সিদ্ধান্তে এলাম, এখন থেকে অবশ্যই নিয়মিত বাজার করব।

কিন্তু বাসায় ফেরার পর, সেই ছোট্ট একটু গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমার স্ত্রী সদাইপাতির সম্ভার দেখে কী কারণে কেন জানি মেজাজ ও গলার স্বর সপ্তদশে তুলে ফেলল। সে সময় তার উক্তিগুলো ছিল এ রকম : 'আর যদি কোনোদিন তোমারে বাজারে পাঠাইসি!! ...এইগুলা ঘোড়ার ডিম কী আনসো? ...এইটা কী কিনসো? ...এইটা কে কিনতে বলসে? উফফ....! ঢিসাং... ঢিসুম... ঠাং... ঠং.... ঠুং... ঠাসঠাসঠাস...ধ্রিমাক...!

আমার আবারও বাজারে যাওয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

১৩১৬১ পঠিত ... ১৭:৩৫, আগস্ট ১৯, ২০১৬

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top