২০০২ সালের দিকে আমার একবার জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করানোর দরকার হয়ে পড়ল। আমি তখন যে খবরের কাগজে কাজ করি, সেখানে একটা আমন্ত্রণপত্র এসেছে। কলকাতায় কী একটা অনুষ্ঠান হবে, সেটা কাভার করতে যেতে হবে।
আমার ইমিডিয়েট বস আমন্ত্রণপত্রটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘যান, ঘুরে আসেন। আপনার অ্যাসাইনমেন্ট।’
আমি সেটা ভালোমতো পড়ে বললাম, ‘অনুষ্ঠানটা তো দেখছি ঢাকায় না, কলকাতায়।’
ইমিডিয়েট বস বললেন, ‘হ্যাঁ। ..যাবেন। কত টাকা খরচ হতে পারে, একটা বাজেট দেন, সাইন করে দেই। অ্যাকাউন্টস থেকে তুইলা নেন।’
আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘এটাতে যেতে হলে তো মনে হয় ভিসা লাগবে।’
ইমিডিয়েট বস বললেন, ‘তা তো লাগবেই। অ্যাপ্লাই করার সময় এই ইনভাইটেশন লেটার দেখাবেন। তাড়াতাড়ি দিয়া দিবে।’
আমি বিব্রত হয়ে বললাম, ‘কিন্তু আমার তো পাসপোর্ট নাই।’
ইমিডিয়েট বস খেপে গিয়ে বললেন, ‘পাসপোর্ট নাই মানে! এত বয়স হইলো, পাসপোর্ট করান নাই ক্যান?’
আমি বললাম, ‘মনে হয় সমস্যা হবে না। ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট করাইতে দিলে দুইদিনে দিয়া দিবে।’
ইমিডিয়েট বস বললেন, ‘দেখেন, পান কিনা। যেইটা ভালো হয়, সেইটা করেন। হাতে কিন্তু সময় নাই। তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট করায়া ভিসার জন্য দাঁড়ায় যান। আর এখন আমার সামনে থেকে দূর হন। একেবারে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়া তারপর আমার সামনে আসবেন।’
আমি তৎক্ষণাৎ তার সামনে থেকে দূর হয়ে নিজের টেবিলে এসে চারিদিকে ফোন দিতে শুরু করলাম। আমার চেনা-পরিচিত, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কেউ বাদ থাকল না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাসপোর্ট করানোর নিয়মকানুন, খরচাপাতি, ভোগান্তির নানা দিক, শর্টকাট উপায় (পাসপোর্ট অফিসের প্রবল প্রতাপশালী কয়েকজন কর্মকর্তা ও এক ডজন দালালের ফোন নম্বরসহ) ইত্যাদি তথ্য আমার হাতে চলে এলো।
প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দ্রুত একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেললাম। আমার হাতে সব মিলিয়ে আছে তিন কার্যদিবস। প্রথম কার্যদিবস বৃহস্পতিবার, ওই দিন বরাদ্দ রাখলাম পাসপোর্ট বাবদ (জরুরি ভিত্তিতে করাচ্ছি যেহেতু, একদিনেই পেয়ে যাব!), দ্বিতীয় কার্যদিবস শনিবার ভিসার জন্যে আবেদন ও প্রয়োজনীয় দেন-দরবার এবং তৃতীয় কার্যদিবস রোববারে ভিসা প্রাপ্তি ও যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ। সব শেষে চতুর্থ দিন সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার ফ্লাইটে যাত্রা শুরু। আমার প্রবল আত্মবিশ্বাসের বেলুন প্রথম দিনেই ছিদ্রি হয়ে গেল পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার পর। পাশেই সোনালী ব্যাংক, সেখানে আর্জেন্ট পাসপোর্টের ফি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। ব্যাংকে দীর্ঘ লাইন। যেহেতু অনেক তাড়াহুড়া, আমার যাওয়া উচিত ছিল সকাল ৯টায়। আমি সাড়ে ৯টায় ঘুম থেকে উঠে ব্যাংকে পৌঁছেছি সাড়ে ১১টায়। দীর্ঘ লাইন পাড়ি দিয়ে বেলা দেড়টার দিকে টাকা জমা দিয়ে পাসপোর্ট অফিসে এসে শুনি লাঞ্চ ব্রেক শুরু হয়ে গিয়েছে। কর্মকর্তারা দল বেঁধে লাঞ্চ খেতে রওনা হয়েছেন। বেলা ৩টার আগে তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা অল্প।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে, যে কাউন্টারে পাসপোর্টের ফরম গ্রহণ করা হয়, বেলা পৌনে ৩টার দিকে সেখানকার লোকজন উপস্থিত হলো। বুজুর্গ চেহারার দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি আমার পাসপোর্ট ফরম উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ‘আপনার তো দেখি আর্জেন্ট। কবে লাগবে?’
‘আজকেই লাগবে।’
‘আজকে তো হবে না। আগামী সপ্তাহের আগে পাবেন না।’
‘কিন্তু আমি তো আজকে নিব বলে আর্জেন্টের টাকা জমা দিয়েছি।’
‘পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য সময় লাগবে। আজ তো অফিস আওয়ার শেষ হইতে চলল। আগামী রবিবারে আপনার ফরম আমরা এসবি অফিসে পাঠাব। তারপর পুলিশ আপনার বাসায় ঘুইরা আইসা রিপোর্ট দিবে। সেই রিপোর্ট আমাদের হাতে আসবে। তখন পাসপোর্ট পাবেন।’
আমার মাথায় আকাশ-বাতাস-মহাকাশ এমনকি গ্রহ-নক্ষত্র-উল্কাপিণ্ড ইত্যাদি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো। আমি করুণ মুখে বললাম, ‘বলেন কী! আমার সোমবার দেশের বাইরে যাওয়ার কথা। আজকে পাসপোর্ট পেতেই হবে। কোনো উপায় নাই।’
বুজুর্গ দাড়িওয়ালা লোকটা সহানুভূতি মাখানো গলায় বললেন, ‘পাসপোর্ট তো আর মুখের কথা না। আপনার এত আর্জেন্ট হইলে আরও আগে আসতেন।’
‘এখন কী করা যায় বলেন তো?’
‘আপনি এক কাজ করেন, তিনতলায় ৩১০ নাম্বার রুমে চলে যান। দেখেন তারা কী বলে।’
আমি তাড়াহুড়া করে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে দেখি, বিরাট এক কলাপসিবল গেট। সেই গেটে বিরাট একটা তালা। গেটের ওইপাশে সিকিউরিটি গার্ড, আমি তাকে বললাম, ‘ভাই, ৩১০ নাম্বার রুমে যাব।’
গার্ড উদাস গলায় বলল, ‘এই গেট দিয়া ঢুকা যাবে না। উল্টা দিকে আরেকটা সিঁড়ি আছে, ওইটা দিয়া উঠেন।’
‘এই গেট দিয়ে ঢোকা যাবে না কেন?’
গার্ড নিরাসক্ত গলায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করল, ‘উল্টাদিকে আরেকটা সিঁড়ি আছে...।’
আমি দৌড়াতে দৌড়াতে আবার নিচে নেমে উল্টা দিকের সিঁড়ি খুঁজে বের করে আবার দৌড়াতে দৌড়াতে তিনতলায় উঠে এলাম। একটা কলাপসিবল গেটের কারণে ছয়তলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার ব্যায়াম হয়ে গেল। ৩১০ নাম্বার রুমের সামনে গিয়ে দেখি, বড় করে লেখা : প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। এখানেও একজন সিকিউরিটি গার্ড। সে দুইহাতে ভিড় সামলাচ্ছে। শয়ে শয়ে মানুষ ৩১০ নাম্বার রুমে যাওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি করছে। আমি অনেক কষ্টে গার্ডের কাছাকাছি গিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি একটু ভেতরে যাব।’
‘পরে আসেন।’
‘ভাই, আমি অমুক পত্রিকার সাংবাদিক।’
‘বললাম না, পরে আসেন।’
‘আরে ভাই, আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।’
গার্ড একটু থামল, ‘কার কাছে যাবেন?’
এইবার আমি একটু বিপদে পড়ে গেলাম। ‘ইয়ে মানে..., আকমল সাহেবের কাছে যাব।’
‘এই রুমে আকমল সাহেব বসে না।’
‘কত নাম্বার রুমে বসে?’
‘উনি বসে ৮০২ নাম্বার রুমে।’
এইবার আমাকে থামতে হলো। মুখে যে নামটা এসেছিল, সেইটাই বলে দিয়েছি। দেখা যাচ্ছে, আকমল সাহেব বলে সত্যি সত্যি একজন আছেন। ৮০২ নাম্বার রুম যেহেতু, তার মানে ৮ তলায়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ওঠার পর যদি দেখা যায়, এই সিঁড়ি না অন্য সিঁড়ি! তার চেয়ে বড় কথা, এই আকমল সাহেব কি আমার কোনো কাজে আসবেন?
আমি আবার ঠেলাঠেলি করে গার্ডকে গিয়ে ধরলাম, ‘এই রুমে কে বসে?’
গার্ড মহাবিরক্ত। ‘তা দিয়া আপনের কী দরকার?’
আমি আমার একটা ভিজিটিং কার্ড গার্ডকে দিয়ে বললাম, ‘আপনি ভেতরে গিয়ে এইটা উনারে দেন। উনি আমাকে ডাকবে।’
গার্ড বুঝতে পারছে না, কাজটা ঠিক হবে কিনা। আমি সত্যি সত্যি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নাকি আজাইরা টাইপের মানুষ, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। কী মনে করে সে সত্যি সত্যি আমার কার্ড নিয়ে ভেতরে গেল এবং একটু পরে ফিরে এসে বলল, ‘স্যার ব্যস্ত। একটু ওয়েট করেন।’আমি আবার অনির্দিষ্টকালের প্রতীক্ষার চক্করে পড়ে গেলাম। অপেক্ষা করতে করতে যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি, সেই মুহূর্তে ডাক এলো। ভেতরে ঢুকে দেখি, সাদা রঙের সিল্কের শার্ট পরা একজন শান্ত-সৌম্য ভদ্রলোক।
তিনি আমাকে দেখে শীতল গলায় বললেন, ‘কী চান?’
আমি বললাম, ‘আমার আর্জেন্ট পাসপোর্ট করাতে হবে। আজকেই লাগবে।’
‘আমার কাছে কেন এসেছেন?’
‘আমি নিচে ফরম জমা দিতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বলল, ৩১০ নাম্বার রুমে আসতে।’
ভদ্রলোকের শান্ত-সৌম্য মুখোশ সরে গেল, তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ওরা বললেই হবে নাকি! যত্তসব আলতু ফালতু লোকের কারবার। আমি কি আর্জেন্ট পাসপোর্টের দোকান খুলে বসেছি?’
আমার কী বলা উচিত বুঝতে পারছি না। তারপরও চোখেমুখে করুণভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম, ‘জি, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো একটু বিপদেই পড়ে গিয়েছি। আপনার হেলপ পেলে একটু উপকার হয়।’
ভদ্রলোক আমার ভিজিটিং কার্ডটা আবার হাতে নিলেন। ‘আপনি তো অমুক পত্রিকায় আছেন?’
মনে হচ্ছে একটু একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে, ‘জি জি।’
‘হুম। আপনাদের এডিটর তো আমার বন্ধু মানুষ। আমরা ছাত্র অবস্থায় একসাথে পলিটিকস করতাম। অনেক মিছিল-মিটিং করতাম।’
আমি চোখে-মুখে আগ্রহের ভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম, ‘ও আচ্ছা আচ্ছা।’
ভদ্রলোকও বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠছেন মনে হয়, ‘এখন অবশ্য যোগাযোগ নাই। তবে নাম বললে মনে হয় চিনতে পারবে। আপনি আমার কার্ড নিয়া যান। তাকে দিবেন। একদিন দেখা করতে যাব। কোন সময় ফ্রি থাকেন উনি?’
‘উনার তো ফ্রি থাকার নির্দিষ্ট কোনো সময় নাই। রাতে পত্রিকা প্রেসে ছাপতে চলে যাওয়ার পর মনে হয় একটু ফ্রি থাকেন।’
‘ওহ হো, রাতে হলে তো পারব না। আমার তো রাত ১০টার মধ্যে ঘুমায় পড়তে হয়। ডাক্তারের নির্দেশ।’
‘ঠিক আছে। অবশ্যই বলব আপনার কথা।’
‘ভাবী কি অফিসে আসেন-টাসেন? মানে উনার ওয়াইফের কথা বলতেসি।’
‘না মানে, ...আসেন। মানে, কম আসেন।’
‘এক সময় উনাদের বাসায় গিয়া কত খেয়েছি। আগে থেকে না জানিয়ে একসাথে দশ-পনের জন চলে যেতাম। গিয়া বলতাম, ভাবী ভাত দেন, খিদা লাগসে। ভাবীর মুখে সারাক্ষণ হাসি। হাসি ছাড়া কথাই নাই। কত যে বিরক্ত করেছি! ভাই তো মহা ব্যস্ত মানুষ। ভাইটা কে চিনসেন তো? আপনাদের এডিটর। উনি তো সারাক্ষণ লোকজন নিয়া আছেন। লোকজন মানে আমরা আমরাই। ...তারপর উনি পলিটিকস থেকে সরে গেলেন। আমরাও ছাপোষা কেরানি হয়ে গেলাম।’
ভদ্রলোক ক্রমশ নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছেন। এখনই থামানো দরকার, আমার হাতে সময় কম। আমি আমার পাসপোর্টের ফরম আর কাগজপত্রের ফাইল তার দিকে এগিয়ে দিলা, ‘এই যে আমার পাসপোর্টের ফরম। আর্জেন্ট।’
‘আর্জেন্ট? কবের মধ্যে লাগবে?’
‘আজকেই লাগবে।’
ভদ্রলোক চট করে ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, ‘আজকেই লাগবে! আপনি তো দেরি করে ফেলসেন। টাকা জমা দিসেন?’
‘জি দিয়েছি।’
‘কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনে তো সময় লাগবে। কমসে কম একদিন যাবে পুলিশ ভেরিফিকেশনে। তাও হাতে হাতে করায় আনতে হবে।’
‘পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া হয় না?’
ভদ্রলোক আহত চোখে আমার দিকে তাকালেন, ‘এইটা কী বললেন? পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট দিলে, পরে তো আপনারাই লিখবেন, পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি। পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট দিয়ে দিতেসে। তখন আমার চাকরি থাকবে?’
আমি বললাম, ‘কী করা যায় বলেন তো?’
‘অলরেডি সাড়ে ৪টা বাজে। ৫টার সময় তো ছুটি হয়ে যাবে। আজ আর হবে না। কাল খুব সকাল সকাল আসেন। ওহ না, কাল তো শুক্রবার, জুম্মার দিন। শনিবারও বন্ধ। আপনি একেবারে রবিবার দিন আসেন। সোজা আমার রুমে চলে আসবেন। আমি দুপুরের মধ্যে এখানকার ফর্মালিটিজ শেষ করে দিব। এরপর টান দিয়া চলে যাবেন এসবি অফিসে। আপনি তো সাংবাদিক, মোটরসাইকেল আছে না?’
আমি মাথা নাড়লাম, যার অর্থ--নাই।
ভদ্রলোক হতাশ হয়েছেন। তার হতাশার ভাষাও পড়ে ফেলা যাচ্ছে : মোটরসাইকেল নাই, তাহলে কীসের সাংবাদিক! তবে মুখে বললেন, ‘আচ্ছা, তাহলে স্কুটারে করে যাইয়েন। এসবি অফিসে গিয়ে হাতে হাতে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট নিয়ে আসবেন। যদি রোববারের মধ্যেই রিপোর্ট আইনা দিতে পারেন, তাহলে আশা রাখি, সোমবার বিকালের ভিতর পাসপোর্ট তৈয়ার হয়ে যাবে।’
‘সোমবার! সে তো অনেক দেরি! ওইদিন তো আমার সকাল সাড়ে ১০টায় ফ্লাইট! তার আগে তো ভিসাই পেতে হবে।’
‘সোমবার যাইতে পারবেন না। ফ্লাইট পিছায়া দেন। পাসপোর্ট না পাইলে ফ্লাইটে উঠবেন কেমনে?’
বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমার সব আশা-ভরসা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যেতে শুরু করেছে। বললাম, ‘তাও ঠিক। কিন্তু আমি যে প্রোগ্রামে যাব, সেইটা তো মঙ্গলবার। এর আগে পাসপোর্ট না পেলে তো আমি সময়মতো পৌঁছাতে পারব না।’
ভদ্রলোক দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘একটা প্রোগ্রাম মিস করলে কী আসে যায়? পাসপোর্ট করা থাকল। এর পরের চান্সে যাবেন।’
আমি মাথা দুলিয়ে দ্রুত একমত হয়ে গেলাম। ‘জি আজ তাহলে উঠি? একেবারে রোববার সকালে আসব।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো আসবেনই। সব ঠিক থাকলে সোমবার বিকালে পেয়ে যাবেন। ভালো কথা, আপনি তো আমার কার্ডটাই নিলেন না! আপনাদের এডিটর সাহেবকে দিবেন।’
আমি সাগ্রহ ভঙ্গিতে তার কার্ড নিলাম।
ভদ্রলোক বললেন, ‘আরেকটা নিয়া যান। একটা এডিটর সাহেবকে দিবেন, একটা ভাবীকে দিবেন। আরও একটা নেন। এইটা আপনার জন্যে।’
‘জি, থ্যাংক ইউ।’
ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, পেছন থেকে ভদ্রলোক হাঁক দিলেন, ‘ইশ্, আপনাকে তো চা-ই খাওয়ানো হইল না। এই কাদের, তোরে না দুই কাপ চা দিতে বললাম।’
আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ‘থাক, আরেকদিন। রোববার সকালে এসে খেয়ে যাব।’
বাইরে এসে ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফুটপাতের চায়ের দোকানের চা খেতে খেতে চিন্তা করলাম, আমার আসলে এইবার কলকাতায় যাওয়া হবে না। সব যদি খুব তাড়াতাড়িও হয়, তারপরও সোমবারের আগে পাসপোর্ট পাওয়ার চান্স নাই। ভিসা পেতেও কয়দিন লাগবে কে জানে। তার মানে বেহুদা এই গরমের মধ্যে ছোটাছুটি করে লাভ নাই। পরে ধীরে-সুস্থে আরেক সময় এসে পাসপোর্ট করিয়ে ফেলা যাবে।
আমি এই গভীর তিতীক্ষামূলক সিদ্ধান্তটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে নানা ব্যস্ততা ও বহুমুখী জটিলতার আবর্তে পড়ে, আমার পাসপোর্ট সংক্রান্ত উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়ল।
আমি যে জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করানোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলাম, এই তথ্যটি আমার আকস্মিকভাবে মনে পড়ল এই ঘটনার প্রায় ছয় মাস পরে। তৎক্ষণাৎ আমি ব্যস্ত হয়ে সেই টাকা জমার রসিদটি খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম এবং ঘরের প্রতিটি কোণ এবং অফিসের প্রতিটি সম্ভাবনাময় স্পটে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, আমি আসলে গোলাপি রঙের কাগজে ছাপা সোনালী ব্যাংকের মনোগ্রামওয়ালা ওই রসিদটি হারিয়ে ফেলেছি। অর্থাৎ পাসপোর্ট করাতে চাইলে আমাকে নতুন করে টাকা জমা দিতে হবে।
আমার এই বিপদের কথা শুনে ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এলো আমার বন্ধু জিয়া ইসলাম। কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে খুশিতে তার হাসি একান-ওকান হয়ে যায়। খুশির কারণটা হলো, সে মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে ভালোবাসে। বিপদগ্রস্ত মানুষ দেখলে তার খুশি হওয়া স্বাভাবিক।
জিয়া আমাকে ভরসা দিয়ে বলল, ‘কোনো চিন্তা নেওয়ার দরকার নাই। থানায় গিয়া একটা জিডি করাতে হবে। তারপর সেই জিডির কপি নিয়ে সোনালী ব্যাংকে গেলে ওরা ওই রসিদের একটা কপি দিয়ে দিবে।’
অতএব জিয়া ইসলামের কথামতো আমি থানায় জিডি করিয়ে, সেই জিডির কপি দেখিয়ে আগারগাঁওস্থ সোনালী ব্যাংক থেকে আমার পাঁচ হাজার টাকা জমা দেওয়ার রসিদের অনুলিপি সংগ্রহ করে ফেললাম। ছয় মাসের পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে সেখানকার লোকজনকে বিস্তর খাটাখাটুনি করতে হলো, এ কারণে তাদেরকে চা-সিগারেট খাওয়ার পয়সা দিতে হলো (পয়সার পরিমাণটা কত ছিল ভুলে গিয়েছি, তবে যদ্দূর মনে পড়ে, তা দিয়ে শেরাটন কিংবা সোনারগাঁও হোটেলে টানা তিন সপ্তাহ রোজ একবার করে চা-কফি খাওয়া সম্ভব)।
রসিদের অনুলিপি হাতে আসার পর আমি ফোন দিলাম পাসপোর্টের এক দালালকে। তার সঙ্গে আমার নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো :
‘শোনেন, আমি পাসপোর্ট অফিসে যেতে পারব না। যা করার আপনি করবেন। কত টাকা লাগবে, বলেন।’
‘পাসপোর্টের তো সরকারি খরচ আড়াই হাজার টাকা। আর আমারে দিবেন দেড় হাজার। সব মিলায়ে চার হাজার টাকা।’
‘আমি তো অলরেডি আর্জেন্টের জন্য পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়ে ফেলেছি। তারপরও এত টাকা লাগবে?’
‘তাহলে এক হাজার কম লাগবে। বুঝেন না, পয়েন্টে পয়েন্টে পয়সা দিতে হয়। এইসব কারণেই এত বেশি লাগে।’
‘বুঝলাম না। আপনার তো শুধু আপনার নিজের চার্জটা নিলেই হয়। ঘাটে ঘাটে পয়সা দিতে হবে কেন?’
‘ভিতরে অনেক ব্যাপার আছে। আপনারা সাংবাদিক মানুষ। সব তো ভাইঙ্গা বলা যাবে না। আচ্ছা, আপনি আরও পাঁচশ কম দিয়েন।’
‘হুমম। কতদিন লাগবে পাসপোর্ট পেতে?’
‘এক মাস লাগে। আমি চেষ্টা করব, আপনারটা আরও আগে করায় দিতে।’
‘থাক। তাড়াহুড়ার দরকার নাই। ধীরে-সুস্থে করেন।’
‘ঠিক আছে। আমি কালকে আইসা আপনারে পাসপোর্টের ফরম দিয়া যাব। আপনি দুই কপি ছবি রেডি রাইখেন।’
পরদিনই আমি দালালের হাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে পূরণ করা পাসপোর্ট ফরম, নগদ আড়াই হাজার টাকা, দুই কপি সত্যায়িত ছবি-সহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র বুঝিয়ে দিলাম।
দালাল সাহেব আমাকে পাকা ৩৫ দিন পর সেই আরাধ্য পাসপোর্টখানি আমার হাতে পৌঁছে দিলেন। আমি গভীর মমতায় সেই পাসপোর্ট নেড়েচেড়ে দেখলাম। বাংলাদেশে এ রকম সর্বোচ্চ অর্থব্যয়, সর্বোচ্চ সময়, সর্বোচ্চ শ্রম বিনিয়োগ করে আর কাউকে পাসপোর্ট পেতে হয়েছে কিনা, কে জানে!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন