ঘর থেকে ঘরজামাই তাড়াতে হবে। ঘরজামাইয়ের নাম এষ। তিনি আবার হাতুড়ে কবিরাজ। তাড়ানোর সেই দায়িত্ব পড়লো পঞ্চমশ্রেণি পড়ুয়া বালকের ওপর। সেই বালক লিখলো জীবনের প্রথম ছড়া-
কচি পাঁঠা বৃদ্ধ মেষ / ভগল কবিরাজ ডাক্তার এষ
সেই বালক আজকে পঁচাত্তরে পা দেয়া কবি নির্মলেন্দু গুণ। জন্মদিনে কবির আরও কিছু মজার ঘটনা শুনে নেয়া যাক---
১.
১৯৮০–এর দশকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা। পুকুরপাড়ে একটা স্টল ছিল, ‘পাণ্ডুলিপি’। তাতে লেখা ছিল: এখানে কবি নির্মলেন্দু গুণ পাওয়া যায়। এক পাঠক রসিকতা করে বললেন, ‘কত করে সের?’
আনিসুল হক
২.
স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুষ্ঠানে নেলসন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন, ইয়াসির আরাফাত এসেছিলেন। অনেক মানুষ এসেছে তাঁদের দেখতে, পারলে অটোগ্রাফ নিতে। ভিআইপিদের কাছে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নির্মলেন্দু গুণ অনুষ্ঠান শেষে ফিরছেন। লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরেছে, ‘দ্যান, একটা।’ নির্মলেন্দু গুণ অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। একজন তাঁর অটোগ্রাফ নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি যে আপনার অটোগ্রাফ নিলাম, কিন্তু আপনি করেনটা কী?’
‘মানে?’ গুণদা জানতে চাইলেন। অটোগ্রাফশিকারি বলল, ‘আপনে ক্রিকেট খেলেন? না ব্যান্ডের গান করেন?’
আনিসুল হক
৩.
কবি নির্মলেন্দু গুণ মহারসিক। আপনারা জানেন। তিনি যখন বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, তখন আমাকে একবার বলেছিলেন, 'এই, মিঠুন (তিনি আমাকে আমার কৈশোর থেকে চেনেন, এই নামে ডাকেন), লেখা দিয়ো, আমরা কিন্তু ভালো লেখাও ছাপি।' ব'লে কী তাঁর হাসি!
আনিসুল হক
৪.
কবি নির্মলেন্দু গুণ। ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে একজন জাদুকর এসে জাদু দেখাল। আস্ত আস্ত ব্লেড পানি দিয়ে খেয়ে ফেলা। পরে তিনিই জাদুর শো আয়োজন করলেন। বাড়িতে চকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ বানানো হলো। সবাইকে ডেকে হ্যারিকেনের আলোয় তিনি জাদু দেখালেন। কতগুলো সত্যিকারের ব্লেড জোগাড় করে তিনি পানি দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন।
সবাই হই হই করে উঠল। সত্যিকারের ব্লেড খাইছস?
হ।
ব্যাক্কল।
বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ল। কবিরাজ ডাকা হলো। কবিরাজ চিকিৎসা দিলেন।
গোমূত্র পান করা।
বালক নির্মলেন্দু গুণ দুইবেলা গোরুর মুত গেলাস ভরে পান করতে লাগলেন।
আনিসুল হক
৫.
একবার গুণদা যেন একটা কিসের ছবি/লেখা আপলোড দিলেন। সেখানে তাঁর এক ভক্ত লিখলো, দাদা আপনার কাছে এইটা আশা করিনাই।
গুণদা ঐ ভক্তকে জবাব দিল, আমার কাছে তোমারে আশা করতে কে কইছে?
আপেল মাহমুদ
৬.
অক্টোবর মাস।
পনেরো তারিখ।
এনএসএফের কিছু পান্ডা তুমুল আলোচনায় বসেছে। চপ-কাটলেট এসেছে। কফি এসেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় কেবিন অন্ধকার।স্থান 'লিবার্টি কাফে'। কাফের কোণার দিকে শুকনো মুখে নির্মলেন্দু গুণ একা বসে আছেন। তিনি খানিকটা বিষন্ন। তার পকেট ধুপখোলার মাঠ। এক কাপ চা কিনবেন সেই উপায় নাই। নির্মলেন্দু গুণ কবিতা লেখা শুরু করেছেন, তবে কবি স্বীকৃতি তখনো পাননি। কবিতা নিয়ে তাকে শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে আড্ডা দিতে দেখা যায়। সেই আড্ডায় কবিতা-বিষয়ক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাথা থেকে উকুন বাছেন এবং সশব্দে উকুন ফোটান। তার পাশের লোকজনদের বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, উকুন ফোটাবেন? নেন আমার কাছ থেকে। কোনো সমস্যা নাই। সাপ্লাই আছে। তখন তার বিষয়ে প্রচলিত ছড়াটা হলো,
নির্মলেন্দু গুণ
মাথায় উকুন।
লিবার্টি কাফেতে নির্মলেন্দু গুণ উকুন বাছা শুরু করেছেন। তার সামনে এক কাপ কফি। এবং একটা চিকেন কাটলেট। খাবারের দাম কিভাবে দেবেন- এই নিয়ে তার মধ্যে সামান্য শঙ্কা কাজ করছে। তবে তিনি প্রায় নিশ্চিত দুপুরের মধ্যে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কপাল ভালো থাকলে তার উপর দিয়ে দুপুরের খাবারটা হয়ে যাবে। লিবার্টি কাফের মোরগ-পোলাও অসাধারণ।
নির্মলেন্দু গুণের মাথায় একটা কবিতার কয়েকটা লাইন চলে এসেছে। লাইনগুলি তাকে যথেষ্ট যন্ত্রনা দিচ্ছে। লিখে ফেললে যন্ত্রনা কমত। সঙ্গে কাগজ-কলম না থাকায় যন্ত্রনা কমাতে পারছেন না।
কী মনে করে মাথার একটা উকুন তিনি কফির কাপে ফেলে দিলেন। কফি খেতে খেতে একটা উকুন কিভাবে মারা যায়, সম্ভবত এই দৃশ্য তার দেখতে ইচ্ছে করল। মাথার ভিতরে কবিতা এবং চুলে উকুন এই দুইয়ের যন্ত্রনায় তিনি অস্থির। কবিতার প্রতিটি শব্দ আলাদা করা যাচ্ছে। উকুনগুলি আলাদা করা যাচ্ছেনা। নির্মলেন্দু গুণ মনে মনে একের পর এক লাইন সাজাতে লাগলেন।
আমি যখন বাড়িতে পৌছলুম তখন দুপুর,
চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ্দুর-;
আমার শরীরে ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাড়িয়েছে।
অতি বিখ্যাত কবিতাটির নাম 'হুলিয়া'। এই একটি কবিতাই তার নামের আগে কবি শব্দটি চিরস্থায়ীভাবে বসিয়ে দিল।
হুমায়ূন আহমেদ
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন