[নব্বইয়ের দশক। স্বরূপ সোহান, ওমর শরীফ ও সুমন পাটওয়ারী নামের তিন বন্ধু কাজ শুরু করেছেন তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ভোরের কাগজে, প্রদায়ক সাংবাদিক হিসেবে। সঞ্জীব চৌধুরী, আনিসুল হক, জয়া আহসান, তাজিন আহমেদের মতো তারকাদের সঙ্গে প্রথম দেখাতে তাদের কী উত্তেজনা! তারাও তখন কাজ করতেন একই পত্রিকায়। দেখতে দেখতেই তাদের সঙ্গে গড়ে উঠলো বন্ধুত্ব। এরপর কাজের সূত্রে সখ্যতা হলো আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, জুয়েল আইচসহ দেশের নামীদামী তারকাদের সঙ্গে। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে এসে ভোরের কাগজ ভেঙ্গে প্রকাশিত হলো প্রথম আলো। সে যাত্রাতেও সঙ্গী হলেন এই তিন বন্ধু। মাঝের এই বিশাল সময়ে ঘটেছে নানা মজার ঘটনা। সেই সব মজার ঘটনা নিয়ে তারা সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন 'বাদামের খোসা' নামে। বর্ষাদুপুর থেকে প্রকাশিত এই 'বাদামের খোসা' পুস্তকটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন 'লিটনের ফ্ল্যাট' জিনিসটা কোথা থেকে এলো, এরশাদ-বিদিশার বিয়েতে কী ঘটেছিল, অভির পিস্তল যেভাবে মডেল হলো, বাপ্পা মজুমদার তার গিটার টিউনিংয়ের যে রহস্য আজও উদ্ধার করতে পারেন নাই, নবনীতা চৌধুরীর বায়োলজি মুখস্ত করার কাহিনিসহ বাংলার রথী-মহারথীদের প্রায় অর্ধশত অজানা গল্প। সেসব থেকেই কিছু বাছাই ঘটনা প্রকাশিত হলো eআরকি পাঠকদের জন্য।--সম্পাদক]
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাই নাকি, কই দেখি তো।’ বলে উঠতে যাব তখনই তিনি বললেন, ‘এই যে কফি হাতে মেইল চেক করছেন, তাতে কি হলো সাইবার আর কফি মিলে সাইবার ক্যাফে। ঢাকায় এটাই প্রথম সাইবার ক্যাফে। বুঝলেন, নাকি তাও বুঝেননি।’ আসলেই লজ্জা পেলাম এবার। একেবারে হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়া যাকে বলে। ’৯৬ সালে শুরু হওয়া প্রথম সাইবার ক্যাফে এ্যাট ডলসে ভিটা নিয়ে এরপরের দিন লিখলাম ভোরের কাগজে।
তখনো কি জানতাম কিছুদিন পরেই ঢাকা ব্যাঙের ছাতার মতো ছেঁয়ে যাবে সাইবার ক্যাফেতে।
চির কুমারদের পাল্লায়
সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান মুকুল ভাই ডেকেছেন। আব্দুল কাইয়ুম মানে মুকুল ভাই কেন আমাকে ডাকবেন বুঝতে পরলাম না। কিছুটা অবাক হয়েই গেলাম তার কক্ষে। কাঁচ দিয়ে ঘেরা ওই রুমে মুকুল ভাই ছাড়াও সাজ্জাদ ভাই, আনিস ভাই আর মশি ভাই বসতেন। মুকুল ভাই আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘স্বরূপ ফয়েজ ভাইকে চেনো তো? ফয়েজ আহমদ। বয়স হয়ে গেছে তো। লিখতে পারেন না। উনার বাসায় যাও। উনি কি বলেন দেখো। তারপর লিখে দিবা তুমি। অনুলিখন আর কি। পারবা তো।’ আমি দেখলাম এডিটরিয়াল পেজে কাজ করার এই তো সুযোগ। বললাম, ‘অবশ্যই মুকুল ভাই। ঠিকানা দেন।’
ফয়েজ আহমদ থাকেন ইস্কাটনে । বিশিষ্ট ছড়াকার, সাংবাদিক, কলামিস্ট। থাকেন ভাইয়ের সঙ্গে। চিরকুমার। ঠিকানা নিয়ে গেলাম। ফয়েজ সাহেবের বয়স হয়ে গেছে। ব্যাচেলরের রুম যা হয় আর কি। অগোছালো। ঠিকমতো কানে শুনেন না। পরিচয় দেয়ার পর বসতে বললেন। তারপর প্রায় দীর্ঘ দুই ঘন্টা প্যাচাল শুনলাম। ধৈর্য্য নিয়ে লিখলাম। পুরাটা আবার তাকে পড়ে শোনালাম। উনার পছন্দ হলো। পরের দিন সম্পাদকীয়তে উনার কলাম ছাপা হলো। আর আমি ফেঁসে গেলাম। এই অকৃতদার বুড়োর পাল্লায় পড়ে মাসে অন্তত চারটি সন্ধ্যা আমার মাটি। নিয়মিত লেখা নিতে যেতাম তাঁর বাসায়। আর মুকুল ভাইও আমাকে দিয়েই করাতেন এই কাজ। ভালোই চলছিল। বাড়তি টাকা আসছিল পকেটে।
আবার একদিন মুকুল ভাইয়ের ডাক। বললেন, ‘ফয়েজ ভাই তো আছেই, তুমি একটু এখন থেকে মনিরুজ্জামান মিঞার বাসায়ও যাবা। ফয়েজ ভাইয়ের মতোই লেখা নিয়ে আসবা।’ মনিরুজ্জামান মিঞা মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ধানমন্ডিতে থাকেন। আশ্চর্যজনকভাবে উনিও চিরকুমার। গেলাম উনার বাসায়। মনিরুজ্জামান সাহেব অবশ্য ফয়েজ সাহেবের মতো অতো বুড়ো নন। তাঁর লেখা নেয়া বেশ সহজ। বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। বিশাল বড় ফ্ল্যাট। কাজের লোক আছে একজন। তিনি নিয়মিত লেখা শুরু করলেন। আবার আমার মাসে আরো চারটি সন্ধ্যা মাটি। অবশ্য টাকার কথা চিন্তা করে তখন এই দুই চিরকুমারের সঙ্গ বেশ লাগছিলো। এরপর আবার আরেক সন্ধ্যায় মুকুল ভাই ধরলেন আমাকে। বললেন, ‘স্বরূপ আর একজনের কাছে যে যেতে হয়। বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার নওয়াজেশ আহমেদ।’ এবার গ্রীন রোড। আর এবার আমি পুরাই টাশকি। কারণ নওয়াজেশ আহমেদও অকৃতদার। থাকেন বোনের সঙ্গে। তিনি খুবই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একজন মানুষ। আড্ডা দিতেন আমার সঙ্গে। অনেক বিষয়ে। তিনিও লেখা শুরু করলেন নিয়মিত।
আর আমি? এই তিন চিরকুমারের পাল্লায় পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, বিয়ে করবো। ভাগ্যিস উনারা এসেছিলেন আমার জীবনে।
অভি’র পিস্তল
- কমরেড কই দেখি।
ইরাজ ভাই ড্রয়ার খুলে বের করলেন। টেবিলে চকচকে কালো জিনিসটার দিকে আমি, ওমর, সুমন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর! আবার কি ভয়ংকর! একটু দূরের টেবিল থেকে সম্পাদক মাহফুজউল্লাহ্ হৈহৈ করে উঠলেন। ‘ইরাজ নাড়াচাড়া কইরো না। ড্রয়ারে ঢুকাও।’ ইরাজ ভাই হাসলেন। ‘ধুর মাহফুজ ভাই, কিছু হবে না। সেফটি ক্যাচ অন অছে।’ আমি পিস্তলটা হাতে নিলাম। কি মসৃণ। ইরাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা কমরেড, এটা কি নিয়মিত পলিশ করা হয়। এত মসৃণ আর চকচকে।’ ইরাজ ভাই তার গোফের ফাঁক দিয়ে হাসলেন। বললেন, ‘অবশ্যই। যার জিনিস তিনি এটা অত্যন্ত যত্নে রাখেন।’ এটা কার জিনিস ততক্ষণে আমাদের জানা হয়ে গেছে। সাতসকালে আমরা তিনজন সাপ্তাহিক অন্বেষার অফিসে ছুটে এসেছি শুধু এই পিস্তলটা দেখবো বলে। যেনতেন পিস্তল নয় এটি, ওয়ালথার এপিপিকে। অত্যন্ত দামী ব্র্যান্ডের পিস্তল। অত্যন্ত আধুনিক। তার চাইতেও বড় কথা পিস্তলটি গোলাম ফারুক অভির। লাইসেন্স করা এই পিস্তল অভি নিজে বহন করেন। গতকাল বিকেলে অভির সহকারী গুড্ডু ইরাজ ভাইকে পিস্তলটি দিয়ে গেছে। তখন থেকেই পিস্তলটি কমরেডের জিম্মায়। আর কিছুক্ষণ পরই ফটোগ্রাফার বিপ্লব জাফর পিস্তলটির ফটোশ্যুট করবেন। আগেই জানতাম, ইরাজ ভাই অন্বেষার পরবর্তী সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী করছেন ঢাকার সন্ত্রাস নিয়ে। সেই সংখ্যায় প্রচ্ছদ ছবি যাবে অভির এই বিখ্যাত পিস্তলের। ইরাজ আহমেদ কোনো আর্টিফিশিয়াল পিস্তলের ছবি ব্যবহার করতে চাননি তার প্রচ্ছদ ছবিতে। আর তাই তার পুরনো বন্ধু একসময়ের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা গোলাম ফারুক অভিকে ফোন করেছিলেন। আর বলেছিলেন তার পিস্তলটি পাঠানোর জন্য। প্রচ্ছদ ছবির জন্য। অভিও সানন্দে রাজি হয়ে তার সহকারীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর বিখ্যাত অভির সেই পিস্তল দেখতেই আমরা তিনজন ছুটে এসেছি কমরেডের কাছে।
’৯৮র সেই সকালে আমরা অভির পিস্তলের ফটোসেশন দেখলাম। একটি পিস্তল কিভাবে একজন আবেদনময়ী মডেলের চাইতেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে তাই দেখলাম মুগ্ধতা নিয়ে। অভির পিস্তল বলেই হয়তো।
ঢাকায় ফোন সেক্স
স্কুল জীবন থেকে যে ব্যান্ডের গান শুনে এত বছর পার করে আসলাম, যে মানুষটার গান জীবনের বাঁকে বাঁকে ছুঁয়ে গেল, সেই মানুষটা চলে গেলেন ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর। সেদিন মনে পড়ছিল বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিন। আর সেই সুযোগটাও এসেছিল ভোরের কাগজে কাজের সুবাদে।
সুমন পাটওয়ারী আইয়ূব বাচ্চুর সাক্ষাৎকার নেবে। সেই সময় তো আর মোবাইল ফোনের প্রচলন শুরু হয়নি। তাই হুট করে ফোন দিয়ে কথা বলার বিষয়টাও ছিল না। আবার সবার বাসাতেও ল্যান্ড ফোন ছিল না। কারণ এই ল্যান্ড ফোনের সংযোগ পেতে নানান কাহিনি করতে হতো। উৎকোচ ছাড়া অসম্ভব ছিল ল্যান্ড ফোনের মালিক হওয়া।
সুমন পাটোয়ারীর বাসাতেও ল্যান্ড ফোন নেই, আমার বাসাতেও নেই।
আইয়ূব বাচ্চুকে ধরতে হলে তার বাসায় সকাল ১০টার আগে ফোন দিতে হবে। না হলে ফোনে লেগে যাবে অ্যান্সারিং মেশিন। তাই বাচ্চু ভাইকে ধরতে সকাল ৯টার সময় সুমন চলে গেল এক ল্যান্ডফোনধারী বন্ধুর বাসায়। সাত সকালে ফোন দিয়ে পাওয়াও গেল তাকে। সময় নির্ধারীত হল ওই দিনই বেলা ১১টায়। স্থান হাতিরপুলের সাউন্ড গার্ডেন।
চোখের সামনে আইয়ূব বাচ্চুকে দেখে আমি মোটামুটি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। স্টুডিও’র ওয়েটিং রুমে বসে চলছে কথোপকথন। প্রশ্ন সাক্ষাৎকার যা করার সুমন করে চলেছে। সে কথা বলার সময় একটু তোতলায়, আমি খালি শুনতেছি ‘তো তো ... বাচ্চু ভাই... আ আ আপনারা যখন ওই কাজটা করলেন...’ আমার কথাবার্তায় মন নেই। আমি মন ভরে শুধু দেখছি বাচ্চু ভাইকে।
মানুষটার মধ্যে ‘অহমিকা’, ‘পার্টমারা’, ‘অহংবোধ’ কিচ্ছু নেই। কোনো ফর্মালিটিজ নাই। কথা বলতে বলতেই আপন হয়ে গেলাম। তখন এলআরবি’র ‘স্বপ্ন’ অ্যালবামের কাজ চলছে। এক ফাঁকে বাচ্চু ভাই আমাদের স্টুডিওর ভেতর নিয়ে গেলেন। অ্যালবামের গানগুলো একটু একটু করে শোনালেন।
জীবনের প্রথম কোনো সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিওতে ঢুকলাম। তাও আবার এলআরবি’র কাজ চলাকালে। তাদেরই অপ্রকাশিত গান শুনলাম। সেদিন কিবোর্ডিস্ট টুটুল এবং ড্রামার রিয়াদও ছিলেন। মনে বার বার একটাই কথা বেজে চলেছে, বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যে অ্যালবামের অপেক্ষায় আছে, সেই অ্যালবামের গান আমরা শুনে এসেছি সবার আগে।
কীভাবে কীভাবে জানি আইয়ূব বাচ্চু এবং এলআরবি’র সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম। সুমন তো এখনও বলে, ‘সেই সময় বাচ্চু ভাই আমাদের পাত্তা না দিলে, আমি আজকের সুমন পাটওয়ারী হতেই পারতাম না।’
বাচ্চু ভাই আমাদের পছন্দ করলেন বললে ভুল হবে, তিনি আমাদের উপর ভরসা করাও শুরু করলেন। ‘স্বপ্ন’ অ্যালবামের প্রকাশনা উৎসব, ক্যাসেট বিভিন্ন পত্রিকার অফিসে বিলানো থেকে শুরু করে অনেক কাজই আমি আর সুমন মিলে করলাম।
প্রথমে ক্যাসেট-ই প্রকাশিত হয়েছিল। পরে বের হয় সিডি।
তখনও মগবাজারে নিজস্ব স্টুডিও ‘এবি কিচেন’ গড়েননি আইয়ূব বাচ্চু; শুধু ব্যান্ডের প্র্যাকটিস হত সেখানে। গান রেকর্ডের জন্য সাউন্ড গার্ডেন। যাতায়াত বাড়লো সেখানে। ফলে অনেক ব্যান্ড তারকাদের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ বাড়তে থাকলো। বিশেষ করে সুমনের।
একদিন দুপুরে এলআরবি’র প্র্যাকটিস প্যাডে গিয়ে দেখি, কিসের প্র্যাকটিস কিসের কি, ব্যান্ডের সব সদস্য আরাম করে শুয়ে আছে। এসির হালকা ঠা-া বাতাস আর কার্পেটের মোলায়েম পরশে সবারই ঘুমঘুম ভাব। ব্যাপার কী?
তখনও কি বোর্ডিস্ট ছিলেন এসআই টুটুল। বললেন, ‘বিরিয়ানি খেয়ে এমন আলসেমি ধরেছেরে।’ আমার পেটে তখন ছুঁচোর নাচন। সুমনেরও তাই।
বাচ্চু ভাই হাত নেড়ে ডেকে বললেন, “আয় আয় তোরাও শুয়ে থাক।” আমার মুখ থেকে তখন ফসকে বেরিয়ে আসে ‘আমরা তো বিরিয়ানি খাইলাম না, ঘুম ঘুম ভাবও আসে নাই।’
বলতে খালি বাকি, বাচ্চু ভাই কেয়ার টেকার কুদ্দুসকে দিয়ে আরও দু প্যাকেট বিরিয়ানি আনিয়ে আমাদের পেটপূজার সুযোগ করে দিল। তবে সেদিন ঘুম আর হয়নি। তুমুল আড্ডা দিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
সাউন্ড গার্ডেনের সেই দিনগুলোতেই চোখের সামনে দেখলাম, আইয়ূব বাচ্চু কীভাবে জেমসকে টেনে তুললেন। এখন হয়ত অনেকেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করবেন না।
আইয়ূব বাচ্চুর তুমুল জনপ্রিতার সময়, ক্যাসেটের এক পিঠে আইয়ূব বাচ্চু আরেক পিঠে জেমসের গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশিত হল। পাশাপাশি একসঙ্গে বসে আড্ডা, খাওয়া কত্ত কিছু।
সেই সময় কী কারণে যেন কনসার্টের আয়োজন করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে এমনি কথায় কথায় বললেন, ‘কনসার্ট করতে না দিলে আত্মহত্যা করবো।’
সেই কথা ধরে সুমন দিলো নিউজ করে। পরে বাচ্চু ভাই বলেছিল, “নিউজ তো করে দিলি, এখন যদি কনসার্ট না হয়!’
তবে কনসার্ট শেষ পর্যন্ত হয়েছিল। আমরা সব্বাই কনসার্ট দেখবো। বাচ্চু ভাই টিকিট দেবেন বলে সন্ধ্যার পরে সাউন্ড গার্ডেন যেতে বললেন। বাসা থেকে কাছে বলে আমিই গেলাম। পৌঁছে দেখি বাচ্চু আর জেমস সাউন্ড গার্ডেনের ম্যানেজার পরিমল দা’র ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
বসে থাকতে থাকতে এক সময় আয়োজকরা এসে টিকিট দিয়ে গেল। এবার হল বিপত্তি।
বাচ্চু ভাই সুমন উচ্চারণ করতেন অনেকটা সুপ উচ্চারণ করতে গিয়ে যেভাবে বলি আমরা সেভাবে, ‘হেই স্যুউম্যান’। আমাকে নাম ধরে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি খুব একটা, কথাবার্তার সময় ‘তুই কেমন আছিস’- এভাবেই চলে আসছিল।
তবে এবার তো আমাকে ডাকতে হবে, টিকিট দিতে। আমি রিসিপশনে বসে শুনতে থাকলাম বাচ্চু আর জেমস দুজনেই আমার নাম নিয়ে দ্বিধায় পড়েছেন। জেমস তো বলেই বসল ‘কী জানি নাম বাড়া, মনে তো পড়ছে না।’
বাচ্চু ভাই ডেকে উঠলেন, ‘ওই হুমায়ূন’। আমি মনে মনে হেসে দিলাম, কাছে গিয়ে বললাম ‘বস আমার নাম তো ওমর।’
বাচ্চু ভাই হেসে বললেন, ‘য়্যাহ ওমর, তুই কোমর সোজা করি কথা বল।’ কথায় কথায় কৌতুক করা বাচ্চু ভাইয়ের স্বভাব ছিল। ‘তো কয়টা টিকিট লাগবে তোর?’
আমি তখন মনে মনে হিসাবে ব্যস্ত, ভোরের কাগজে নওরোজ টওরোজরা আর ওদিকে পিংকু, ছুট্টি, সুমন-টুমন মিলায় .. হুহ ‘বাচ্চু ভাই বিশটার মতো’। শুনে তো তিনি থ, ‘কি বলিস বিশটা? দিছেই তো ত্রিশটা টিকিট। এক কাজ কর বারোটা নিয়ে যা। আর বাকিদের ঢুকাতে চাইলে ফোন দিস।’
সেই কনসার্ট ছাড়াও আইয়ূব বাচ্চু অ্যান্ড এলআরবি’র বহু কনসার্ট দেখেছি, কোনো সময় তুষার ভাইয়ের কল্যাণে ক্লোজআপ আনপ্লাগড বা জুকবক্স কনসার্টে কখনও বাচ্চুভাইয়ের সঙ্গে সহযাত্রী হয়ে।
গাড়ি চলে না
এসএসসি পরীক্ষার পর গিটার শেখা শুরু করেছিলাম, শখেই। নেশা থেকে পেশাদার বাজিয়ে হওয়া হয়ে ওঠেনি আর। তবে যেখানে সেখানে গিটার পেলে টুংটাং করার অভ্যাসটা হয়েছিল।
তারিখটা মনে নেই। তবে সেদিন কোনো কাজ না থাকায় বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম ভোরের কাগজের সেই ডাইনিং টেবিলটার সামনে বসে। একসময় নজর গেল একটা গিটার রওশন ভাইয়ের টেবিলের সামনে হেলান দিয়ে রাখা। কার না কার গিটার? তবে লোভটা সামলাতে পালাম না। উঠে গিয়ে গিটারটা নিয়ে পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
ধরেই বুঝলাম টিউন করা নেই। তারগুলো ঢিল ঢিল করছে। শখ যখন চেপেছে, কি আর করা, গিটারটা টিউন করে বাজালাম কিছুক্ষণ। তারপর মনে হল, যার গিটার সে দেখলে মাইন্ড করতে পারে, তাই তাড়াতাড়ি গিটারটা একইভাবে রেখে ফিরে এলাম ডাইনিং টেবিলে। তবে গিটারের টিউনটা ছেড়ে দিয়ে আসতে ভুলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পরে দেখি হ্যাংলা মতো একটা অল্প বয়স্ক ছেলে এসে গিটারটা তুলে হাঁটা দিতে যাবে, এমন সময় কিছুক্ষণ অবাক হয়ে গিটারটা দেখলো, তারপর আশপাশে তাকালো। মনে মনে হাসলাম আমি। বুঝলাম ওই ছেলেটারই গিটার আর টিউন করা অবস্থায় পেয়ে সে একটু অবাকই হয়েছে। কারণ সে তো আর টিউন করা অবস্থায় রেখে যায়নি।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখি সঞ্জীব দা এসে তাকে নিয়ে বের হয়ে গেল অফিস থেকে।
বেশ কটাদিন পর, ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দলছুটের ‘গাড়ি চলেনা’ গানটা প্রচারিত হল। সঞ্জীব দা’র ব্যান্ড; সেই গান মিস দেওয়ার তো কোনো মানেই হয় না। গানটা দেখতে গিয়ে তো,‘টিনের চালে কাক আমি তো অবাক’ অবস্থা! ওই সেই হ্যাংলা ছেলেটা, যার গিটারটা নিয়ে টুংটাং করেছিলাম; সেও তাইলে দাদার ব্যান্ডের সদস্য।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে, একদিন আবিষ্কার করলাম ওই হ্যাংলা ছেলেটা ছিল বাপ্পা মজুমদার। আজ তার অনেক নামডাক। অথচ সেদিন আমি তারে পাত্তাই দেই নাই।
টাইটানিক
বিশ্বসাগর পারি দিয়ে হলিউডের সারা জাগানো চলচ্চিত্র টাইটানিক ঢাকার মধুমিতা হলে ভিড়েছে। ডলবি ডিজিটাল সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম এবং সিলভার স্ক্রিনের যাদু একমাত্র এই হলে গেলেই পাওয়া যাবে। তাই ১৯৯৭ সালে ভোরের কাগজের দিনগুলোতে টাইটানিক দেখতে একদিন আমরা রওনা দিলাম মতিঝিলে মধুমিতা হলে।
সঞ্জীবদার সঙ্গে আমরা প্রদায়ক বাহিনী। মানে আমি, সুমন, স্বরূপ, নবনীতা চৌধুরী, সুমনের বোন রত্না আপা, শামীম শাহেদ আর টুশি।
সিনেমা চলছে, রোজ-জ্যাকের প্রেম কাহিনি আর জেমস ক্যামেরনের মুভি ম্যাজিক দেখে আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু সঞ্জীব দা’র এসবে কোনো খেয়াল নেই। একটা করে সিন যায়, আর তিনি মজার সব মন্তব্য করতে থাকেন। সিনেমা দেখবো নাকি হাসতে হাসতে পেটের ব্যথা ভুলবো- এই হল অবস্থা।
রোজ যখন জ্যাক জ্যাক করে চিৎকার করে, দাদাও চিকন কণ্ঠে জ্যাক জ্যাক বলে ডেকে ওঠেন। রোজকে ডাকা শুরু করলেন, ‘ও আমার গুলাপ ফুল’ বলে।
কেট উন্সলেটের নগ্ন বক্ষা দৃশ্য যখন আসলো তখন দেখি এদেশের সেন্সর বোর্ড পুরো দৃশ্যটা না ফেলে শুধু কেটের বক্ষের উপর কালি লেপে দিয়েছে। দাগটা আবার নড়াচড়া করছে দ্রুত। শুধু উন্মুক্ত বক্ষের কিয়দাংশ দেখা যাচ্ছে।
এই দেখে সঞ্জীব দা বলে উঠলেন, “বক্ষবন্ধনীও ঠিক মতো পরাতে পারলি না।” শুনে তো আমি খ্যা খ্যা করে হাসতেছি।
শেষ দৃশ্য চলে এসেছে, জ্যাক মারা যাচ্ছে, রোজ জ্যাকের হাত ধরে রেখেছে। প্রেমিক প্রেমিকার বিচ্ছেদ হচ্ছে মৃত্যু দিয়ে। আমাদের মনেও আবেগ জেগে উঠেছে। এরমধ্যে খেয়াল হল, সঞ্জীব দা অনেক্ষণ ধরে চুপচাপ। তার বিতলা মার্কা কথাগুলো শুনছি না। তার দিকে তাকিয়ে দেখি, ওমা সঞ্জীব দা’র দুচোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। শিশুর মতো কাঁদছেন তিনি।
হায়রে টাইটানিক ডুবলো আটলান্টিকে আর নোনা সাগরের ফোঁটা গড়ায় সঞ্জীব দা’র গালে।
এরশাদ বিদিশা
ধানম-িতে বিদিশার একটা পোশাকের দোকান ছিল ‘বুটিক ইসাবেল’। বিদিশা মানে হু.মু. এরশাদ খ্যাত বিদিশা আরকি। তখন তিনি এরশাদের জন্য নয়, স্বনামেই খ্যাত। তার ফ্যাশন হাউজটার জন্য। সে কারণে ফ্যাশন ভিত্তিক খবর করতে গিয়ে বিদিশার সঙ্গে আমাদেরও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পল্লব ভাইয়ের কল্যাণে ২০০১ সালের দিকে বাংলাদেশ ইনফো ডটকম নামের একটা প্রতিষ্ঠানে পার্ট টাইম চাকরি হলো আমার আর সুমনের। বনানীর কাকলিতে অফিস।
বাংলাদেশ ইনফো ডটকম মনে হয় এদেশের প্রথম অনলাইন ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ছিলো। তবে তাদের কোনো রিপোর্টার ছিলো না। বিভিন্ন পত্রিকার খবর থেকে নির্বাচিত খবর সংগ্রহ করে আপ করতো। আর আমি ও সুমন দুটো বিভাগ দেখভাল করতাম, যেখানে সংগীত, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল বিষয়ক প্রতিবেদন যেতো।
যা হোক, এই চাকরির সুবাদে অনলাইনে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়ে গেলো। আমরা সকালে সেখানে যাই বিকালে চলে আসি প্রথম আলো’তে। প্রতিদিন প্রথম আলো’তে না গেলে আমাদের যেন পেটের ভাত হজম হতো না। আবার কোনো দিন চলে যেতাম কোনো বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিতে।
এভাবেই চলছিল। স্বরূপ তখন লেখালিখি ছেড়ে ব্যাংকে চাকরি করা শুরু করেছে। তাই সুমনের সঙ্গেই যোগাযোগটা বেশি ছিলো। পাশাপাশি নওরোজ ইমতিয়াজ, শিমু নাসের, মুসা ইব্রাহিম, কাজী ফাহিম আহমেদ, পান্থ রহমান, মঈনুল হক রোজ, সৌরভ সাখাওয়াত আর পল্লব ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা জমতো।
একদিন সুমন বললো, “আজকে বিদিশা আপার বাসায় দাওয়াত। যাবি নাকি?”
সেদিন আবার স্বরূপের বাসাতেও আমাদের সবার আড্ডা দেওয়ার কথা। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না- যাব কি যাব না বিদিশার বাসায়।
তবে বিকালের দিকে বিদিশার আরও দুই সাংবাদিক বন্ধু আমাদের মোটামুটি জোর করেই নিয়ে গেলো সেই অনুষ্ঠানে।
বারিধারার ওই বাড়িতে ঢোকার সময় খেয়াল করলাম নাম ফলকে বাড়ির নাম লেখা আছে ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’। তখনও বুঝিনি কিসের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি।
ফ্ল্যাটে ঢোকার পর ওই দুই বন্ধু আমাদের সঙ্গে বিদিশার সাক্ষাৎ করিয়ে দিলো। খেয়াল করলাম সাংবাদিকের চাইতে আত্মিয় স্বজনের সমাগম বেশি। তাদের মধ্যে একজনকে ড্রইং রুমে বসে থাকতে দেখে তো আমার আর সুমনের চোখ ছানাবড়া।
কি কা- বসে আছেন স্বয়ং এরশাদ! ভাবলাম বিদিশার হয়ত কোনো ভাবে পরিচিত।
একটু পর ড্রইং রুমে সবাইকে ডাকা হলো। বিদিশার ছেলের জন্মদিনের কেক কাটা হবে। তখন ভাবছি বিদিশার ছেলে আসলো কোত্থেকে। এরই মধ্যে দেখি বিদিশার কোল থেকে ছেলেকে কোলে তুলে নিচ্ছেন এরশাদ।
তারপর বললেন, “আজ আমাদের ছেলের জন্মদিন। আমাদের সংসারের জন্য দোয়া করবেন।”
কি সাংঘাতিক, আমি আর সুমন তখন বুঝতে পারলাম এটা তো শুধু জন্মদিনের অনুষ্ঠান না। এরশাদ বিদিশারে বিয়ে করেছেন, সেটা জানাল তারা। আর যে ফ্ল্যাটে দাঁড়ায় আছি সেটা আসলে এরশাদের ফ্ল্যাট।
ওদিকে এরশাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে বিদিশাসহ কেক কাটছেন। আমি আর সুমন মুখ চাওয়া চাওয়ি করি! এ কই আইসা পড়লাম আমরা!
সেখান থেকে তখন ভাগতে পারলে বাঁচি। কারণ মাথায় ঘুরছে স্বরূপের বাসায় গিয়ে আড্ডা মারার চিন্তা। কোনো রকমে চারটা কাচ্চি বিরিয়ানি মুখে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম।
সেই দুই বন্ধু তাদের গাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় বললো, “প্রথম আলো তো মনে হয় এরকম নিউজ করে না, তাই না।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, “মনে হয় না।”
পরদিন সকালে বনানীর অফিসে যাওয়ার সময় পত্রিকার স্ট্যান্ডে দেখলাম সবগুলো পত্রিকার প্রথম পাতায় বিদিশা-এরশাদের বিয়ের খবর। প্রথম আলোতেও আছে খবরটা। তবে আমরা চর্ম চক্ষে যা দেখেছিলাম সেভাবে আসেনি।
তখন টনক নড়লো, ইশ এই অনুষ্ঠানে আমরাও তো ছিলাম। নিউজটা করতে পারলে নিজেদের নামে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় নিউজ হতো। সেদিন আসলে বুঝেছিলাম ফিচারে কাজ করে, দৈনিক খবরের গুরুত্ব বোঝার ক্ষমতা আমাদের সেভাবে গড়ে ওঠেনি। উঠলে, স্বরূপের বাসায় না গিয়ে আগে সোজা প্রথম আলো যেতাম।
সেদিন বিকালে প্রথম আলো অফিসে গিয়ে কাহিনি বলতেই মোটামুটি হুলহুস্থুল পড়লো। স্বশরীরে উপস্থিত থেকেও কেনো নিউজ করলাম না। যা হোক... সেই বিয়ের ঘোষণা অনুষ্ঠানের একটা রম্য লেখা লিখে শেষ পর্যন্ত নিজেদের ইজ্জ্বত বাঁচিয়েছিলাম।
বন্ধ দরজা
অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছি কিন্তু দরজা খুলাবার নাম নেই। অথচ বাসার ভেতরে লোকজনের হাঁটাহাঁটি ঠিকই টের পাচ্ছি। মেজাজটা কেমন লাগে। অথচ এমন কথা ছিলো না। তিনি রাজী হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এখন আবার কেন বেঁকে বসেছেন, মাবুদই জানেন। আমাদের দুজনেরই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেছে। দু’জন মানে আমি আর বিখ্যাত ফটোগ্রাফার নাসির আলী মামুন।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা বের হবে। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের একটি সাক্ষাৎকার যাবে। আমাকে যখন বলা হলো আমাকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে হবে, আমি বেশ দাঁত কেলিয়ে রাজী হলাম। কারণ তখন অবধি আমি জানতাম না, কী বিষ আমি হাসিমুখে পান করছি।
আমার ধারণা ছিলো, বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে একটা ফোন করবো। আর তিনি প্রথম আলোর নাম শুনে রাজী হয়ে যাবেন। এরপর ইন্টারভিউটি নিয়ে হেলতে দুলতে বাড়ি যাবো। সব মিলিয়ে ঘন্টা দুয়েকের কাজ। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। আমার ক্ষেত্রে হলো ভেবেছি এক হলো কয়েকশ গুণ বেশি।
ধীরে ধীরে ফিরোজা বেগমের সাক্ষাৎকার নেয়া নিয়ে যেসব ভয়াবহ কথা জানতে পেলাম তাতে আমার শুধু রাতের ঘুম না দিনের ঘুমও হারাম হয়ে গেলো। সবশেষে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেলাম, তিনি গত ২০ বছর ধরে কোন পত্রিকাতেই কোন ইন্টারভিউ দেননি।
খবরটা শোনেই গলা শুকিয়ে গেলো। হাতি ঘোড়া গেলো তল, সুমন বলে কতো জল। কিন্তু জনাব আমি কম না, আমি ফাল হয়ে ঢুকে সুই হয়ে বেরুতে জানি। চেপে ধরলাম ফিরোজা বেগমের ছেলে বাংলাদেশের ব্যান্ডে সঙ্গীতের আরেক দিকপাল মাইলসের শাফিন ভাইকে। আমার মতো মোটা মানুষের চাপ শাফিন ভাই সহ্য করতে পারলেন না। তার মাকে তিনি রাজী করিয়ে ফেললেন।
এক শুক্রবার সকালে বললেন ইন্ধিরা রোডের কালিন্দী অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে তার বাসায় যেতে। ফিরোজা বেগমও ওই একই কমপ্লেক্সেই থাকেন তবে ভিন্ন ফ্ল্যাটে। গেলাম আমি আর ছবিয়াল নাসির আলী মামুন ভাই। শাফিন ভাই আমাদের তার মায়ের ফ্ল্যাটে যেতে বললেন, তার কথামতো গিয়ে প্রথমে বেল বাজালাম। উঁহু সাড়া নেই। এরপর দরজায় মৃদু নক। তাও নট দরজা খোলাখুলি। বাকি রইলো দরজা ভাঙা। সঙ্গে যন্ত্রপাতি নেই, তা না হলে তাও একটা ট্রাই দিতাম।
মামুন ভাই বিরস বদনে বললেন, সুমন গতিক তো সুবিধার না। কি করা যায়? আমি মামুন ভাইকে অভয় দিয়ে বললাম, দাঁড়ান জীবনের শেষ চেষ্টা। আমি আবার গেলাম শাফিন ভাইয়ের বাসায়। এবার দ্বিগুন চাপ দিলাম। কাজ হলো এবার। শাফিন ভাইও ফোন তুলে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, রাস্তা পরিষ্কার। এবার যাও।
সত্যিই এবার দরজা খুললো। আমাদের বসতেও দিলো। এরপর এলেন তিনি। সৌম্য চেহারার ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন অভিজাত নারী। তাকে প্রথম দেখলে যে কথাগুলো মনে আসে তাইই লিখলাম আমি। শুরু হলো সাক্ষাৎকার প্রথমে খুব ভাব গম্ভীর এরপর আস্তে আস্তে সহজ হতে লাগলেন। বাড়তে লাগলো সময়।
দশ মিনিটের জন্যে সময় চেয়ে পেলাম তিন ঘন্টা। নাসির ভাই তুললেন, তার মনের মতো দারুণ কিছু ছবি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দিনটি আমার সাংবাদিকতা জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
উমম্, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন লেখাটা শুরু করেছিলাম বাচ্চু ভাইকে দিয়ে, তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। এরপর লিখলাম টুশিকে সঙ্গে নিয়ে সেই টুশিও নেই। এখন লিখলাম ফিরোজা বেগমকে নিয়ে, গুণী এই শিল্পীও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সবগুলো লেখার শেষই মন খারাপ করা।
তাই ঠিক করেছি মৃত কথাদের তোলা থাক এবার জীবিতদের নিয়ে লিখি। যদিও এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বই বেরুতে বেরুতে কী হয় তা স্রষ্টাই ভালো জানেন।
অলংকরণ: আরিফ ইকবাল
[তিন বন্ধুর এমন অতীত খুঁড়ে আনা আরও অর্ধশতাধিক গল্প পড়তে সংগ্রহ করতে পারেন বর্ষাদুপুর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'বাদামের খোসা'। ঘরে বসে পেতে অর্ডার করুন অনলাইনে।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন