এক
অফিসে পাড়া দিয়েই রানার কাছে মনে হলো, পরিবেশটা থমথমে। এমনিতেও তারা যে ধরনের কাজ করে, তাতে উদ্বেগ, উত্তেজনা থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতেও অফিসের পরিবেশ এমন থমথমে থাকে না।
ঢোকার মুখেই দেখা হলো সোহানার সাথে। শিফনের একটা শাড়ি পরে এসেছে। দেখা মাত্রই রানার মুখে ভুবন ভোলানো একটা হাসি খেলে গেলো। এই হাসি সোহানা চেনে। সবসময়ই সে একটা পালটা মিষ্টি হাসি দেয়। কিন্তু আজকের হাসিটাতে কেমন যেন প্রাণ নেই।
নিজের রুমে ঢোকার আগে রানা অভ্যাস হলো সোহেলের রুমে একটা হানা দেয়া। ওর টেবিলে বসে সোহেলেরই প্যাকেট থেকে একটা সিগারেটে টান না দিলে রানার অফিস যেন শুরু হয় না। রানাকে দেখামাত্রই সোহেল সবসময় সিগারেট লুকিয়ে ফেলে। টানাটানি করেই সিগারেট বের করতে হয় ওর থেকে। আজকে কী যেন হয়েছে, রানাকে দেখেও প্যাকেট সরালো না সোহেল।
প্যাকেটটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আগুন ধরিয়ে বুভুক্ষু একটা টান দিলো রানা। তারপর সামনের চেয়ারটা টান দিয়ে বসে পা তুলে দিলো সোহেলের ডেস্কের ওপর। আরাম করে আরেকটা টান দিয়ে বললো- কিরে শালা, আজকে এতো ভালো হয়ে গেলি? বুড়ো কি ডেকে নিয়ে ভালো ভালো কথা বলেছে আজকে?
সোহেল কিছু বলতে গিয়েও যেন বললো না। তারপর নিজেও একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো- স্যারের সাথে কথা হয়নি তোর এখনও?
- আরে, আমি তো এলামই মাত্র। তোর রুম দিয়েই আমার অফিস শুরু। কেন, বুড়ো কি নতুন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ধরিয়ে দেবে নাকি?
সোহেল কিছু বলতে যাচ্ছিলো, দরজায় খুটখুট শব্দ হওয়ায় থেমে গেলো। বসের সেক্রেটারি অঞ্জনা। রানাকে দেখা মাত্রই বললো- রানা, এসেছো? স্যার তোমাকে খুঁজছেন অনেকক্ষণ ধরে।
রানা এবার প্রমাদ গুনলো। মাত্রই ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস চিফ মার্ভিন লংফেলোর সাথে একটা লম্বা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে দেশে এসেছে। এখন মাসখানেকের ছুটিতে আছে। এই তো আজকে বিকেলেই সোহানাকে সঙ্গে নিয়ে বেইলি রোডে ফুচকা খেতে যাবার কথা। সেই জন্যই একটু অফিসে আসা। এই সময়ে স্যারের ডাক আসার তো কথা না!
রানা তাকালো সোহেলের দিকে। কিন্তু সোহেল নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে ফ্যানের পাখার দিকে। তারমানে, সোহেলের কাছ থেকে আগাম কোনো তথ্য পাবার আশা নেই। হতাশ গলায় রানা অঞ্জনাকে বললো- চলো তাহলে।
দুই
বিসিআইয়ের চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের দরজার সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই বুকে ঢিপ ঢিপ শব্দ হওয়া শুরু করলো। এ এক অদ্ভুত জিনিস। যতোবারই স্যারের দরজার সামনে দাঁড়ায়, কোনবারই বুক ঢিপ ঢিপ শব্দ হওয়া তাঁর বাদ যায় না। মেহগনি কাঠের পলিশ করা দরজায় দু’বার শব্দ করলো, ঠকঠক। ভেতর থেকে জলদগম্ভীর গলা ভেসে এলো- কাম ইন।
ভেতরে ঢুকেই মনে হলো পুরো ঘরটা ধোঁয়ায় ভেসে আছে। ধোঁয়ার কারণে স্যারকে টেবিলের এপাশ থেকে ভালো মতোন দেখাই যাচ্ছে না। বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে কড়া হাভানা চুরুটের ঘ্রাণ। তারমানে বিসিআই চিফ ভালোই টেনশনে আছেন।
এতোক্ষণে রানা বুঝতে পারলো, রাহাত খান উলটো দিকে ঘুরে আছেন। স্যুইভেল চেয়ারে ঘুরে এদিকে তাকিয়ে বললেন- বসো, রানা।
এরপর একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন- দেখো।
রানা ফাইলটা খুললো। খুলেই চমকে উঠলো। এ তো তারই ফাইল!
প্রথমেই রানার ড্যোশিয়ে। কবে থেকে সে জয়েন করলো, কোন কোন অ্যাসাইনমেন্টে যোগ দিলো সেগুলোর বিস্তারিত। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় তার মারাত্মক ভুলগুলো লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করা। সেগুলোর পাশে বসের রাগান্বিত নোট। দেখেই রানার বুক আবার ধ্বক করে উঠলো। আবার কৃতিত্বের জায়গাগুলিও হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ফাইল স্যার তাকে পড়তে দিচ্ছেন কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাহাত খানের দিকে তাকালো সে।
রাহাত খানের ঠোঁটে ঝুলছে হাভানা সিগার। রানার চাহনীতেই বুঝে গেলেন প্রশ্ন। বিশাল এক্সিকিউটিভ ডেস্কের ওপাশ থেকে বললেন- প্রথম থেকেই তোমার বাবার ব্যাপারে কনফিউজড ছিলাম আমরা।
রানার চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা। বাবার ব্যাপারে কনফিউজড মানে? অবশ্য বাবাকে খুব ছোটবেলাতেই সে কাছে পেয়েছে। তারপর তো বাইরেই পড়তে পাঠাতে হলো তাকে। দেশে ফিরে আর্মিতে জয়েন করার পরও বাবা আলাদাই থাকতেন। সেগুন বাগিচার ঐ বাসায় বাবার সাথে আর থাকতে যাওয়া হয়নি ওভাবে আর কখনও।
কিন্তু এর সাথে বাবার ব্যাপারে সন্দিহান থাকার কী সম্পর্ক?
রাহাত খান আবার বললেন- শেষ পাতায় দেখো। তোমার বাবার নাম লিখে তাতে কোয়েশ্চেন মার্ক দেয়া।
রানা শেষ পাতা উল্টালো। তাতে রানার নাম, জন্মসাল, বিদেশে পড়তে যাবার তারিখ, বাবার নাম সবই দেয়া। তাতে বাবার নামের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
এবার মৃদুস্বরে রানা বললো- কিন্তু স্যার, আমি এর কিছু বুঝতে পারছি না।
রাহাত খান বললেন- বিপথে চলে যাওয়া বৈজ্ঞানিক কবীর চৌধুরি আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। এবার সে ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরি করা শুরু করেছে। এর মাধ্যমে সে একজনের ডিএনএ নিয়ে অবিকল দোষেগুণে তাঁর মতোই আরেকজনকে ক্লোন করতে পারবে। কাকে সে ক্লোন করার টার্গেট নিয়েছে বলে আমার কাছে রিপোর্ট জানো?
- কাকে?
- তোমাকে, রানা!
ঘরের মাঝে বোমা পড়লেও বোধহয় এতোটা অবাক হতো না রানা। একটু সামলে সে মুখ খুললো- কিন্তু স্যার, আমার ডিএনএ সে পাচ্ছে কোথায়? আমি তো এখানেই আছি এই মুহূর্তে।
- তোমার ডিএনএ পাচ্ছে, কারণ তোমার বাবাকে আজকে সকালে অপহরণ করা হয়েছে।
- বলেন কি স্যার?
- শুধু তোমার বাবাকেই নয়, সাথে অপহরণ করেছে শেখ আব্দুল হাকিম নামে এক ভদ্রলোককেও।
রানা চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো। ওর মনের মাঝে যে কী চলছে, সেটা সে-ই ভালো জানে।
- ওয়েল, মাই বয়। আমাদের কাছে একটা তথ্য ছিলো, এই ভদ্রলোক বেশ কিছুদিন তোমার পড়ালেখায় স্পন্সর করেছেন। কাজেই একটা সন্দেহ আমাদের ছিলোই। এই একই সন্দেহ সম্ভবত কবীর চৌধুরীও করছে। তাই, ডিএনএ কালেক্ট করতে সে দুইজনকেই তুলে নিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রানা জিজ্ঞেস করলো- কী করতে হবে এখন স্যার আমাকে?
রাহাত খান একটা এনভেলপ এগিয়ে দিলেন- এখানে ইতালি যাবার টিকেট, ভিসা আর দরকারি ডকুমেন্ট আছে। কবীর চৌধুরীকে শেষ ওখানেই দেখা গেছে দুইদিন আগে। রানা এজেন্সির ছেলেরা ওকে ট্র্যাক করছে। বাকিটা সোহেল তোমাকে বুঝিয়ে দেবে।
রানা উঠে দাঁড়ালো। হনহন করে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। পেছনে তাকালে দেখতে পেতো কাঁচাপাকা জুলফির এই বৃদ্ধ একদৃষ্টিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। বিড়বিড় করে তিনি বলছেন- বেস্ট উইশেস মাই বয়, বেস্ট উইশেস!
তিন
ইতালির মিলান। ভিনসেন্ট গগোলের অফিসে বসে আছে রানা। দুজনের সম্পর্কটা কেমন যেন অদ্ভুত। বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে, একের জন্য অপরের ভয়াবহ কিছু উপকার করা রয়েছে। কিন্তু সেটার জন্য কেউ কাউকে একটা শুকনো ধন্যবাদ পর্যন্ত বলে না। উপকারের জবাব তারা উপকার দিয়েই দেয়।
গগোল বললো- কফি? স্যান্ডুইচ?
রানা বললো- না।
গগোল একটা কাঁধ ঝাঁকালো শুধু। রানা সরাসরি চলে এলো কাজের কথায়- প্লেন চার্টার করেছো?
- হ্যাঁ।
-কবীর চৌধুরীর কেনা ঐ আইল্যান্ডের ওপর দিয়েই যাবে?
হ্যাঁ। কিন্তু আমার কথা হলো, তোমার প্লেনটাকে দ্বীপের ওপর দিয়ে দেখলেই ওরা গুলি করে ফেলে দেবে না?
রানা মুচকি হাসলো। তারপর বললো- বিদায়, বন্ধু।
গগোল মৃদুস্বরে বললো- বিদায়।
পাহাড়ি একটা ছোট্ট এয়ারপোর্ট বোলভিলা। ওটারই রানওয়েতে দাঁড়িয়ে একটা সেসনা। পাইলট জানে একজন ফ্রেঞ্চ মার্সেনারি ওটা ভাড়া করেছে। যেতে হবে তুরিনে।
ফ্লাইট ইন্সট্রাকশনের এনভেলপটা নিয়ে সে ট্রাউজারের সাথে বাড়ি দিচ্ছে আনমনে, আর প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করছে। তখনই দেখতে পেলো লোকটাকে। খাড়া খাড়া চুল, ট্রিম করা দাঁড়ি। দেখলেই ফ্রেঞ্চ বলে চেনা যায়। খুব ঢোলা একটা পার্কার পরে আছে লোকটা। ককপিটে উঠে লাস্ট একটা চেক দিতে শুরু করলো ও।
পুরনো সেসনা, একটু খক খক করে কেশে বেশ মসৃণভাবেই আকাশের উপর উঠে এলো। অটো পাইলটের কাছে কোর্স সেট করতে যাচ্ছে, এমন সময় প্যাসেঞ্জার উঠে এলো ককপিটে।
- গুড মর্নিং, পাইলট।
- গুড মর্নিং, স্যার।
- কোর্স সেট করছো নাকি?
- ইয়েস স্যার।
- একটু বদল করতে হবে যে? আমরা এখন আর তুরিনে যাবো না। তুমি শুধু একটু আইল্যান্ড কেপ ডি গাটায় উড়ে এসে আবার এখানে ল্যান্ড করবে।
- কিন্তু স্যার, আমার পক্ষে এটা সম্ভব না আসলে... বলত বলতে পাইলট থেমে গেলো। একটা ওয়ালথার পিপিকে উঠে এসেছে ফ্রেঞ্চ প্যাসেঞ্জারের সামনে। আর ঢোলা ঢালা পার্কারের নিচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন মেশিনগান, গ্রেনেড। আর সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে প্যারাস্যুট।
চার
কবীর চৌধুরী অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। দু’জন বৃদ্ধকে তুলে আনা হয়েছে। কবীর চৌধুরী প্রথমে দু’জনকেই তুলে আনার এই ঝামেলা করতে চাননি। কিন্তু তাঁর স্পাইরা মাসুদ রানার আসল বাবা কে- এই তথ্য দ্রুত বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্রুত কাজটা করতে চাওয়ার কারণ আছে। তিনি যে মাসুদ রানার একটা ক্লোন করতে চান- এই তথ্য বিসিআইয়ের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। ক্লোনিং এক্সপার্ট ল্যাংলি যে বিসিআইয়েরই একজন চর, সেটা আসলে বের করতে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
বিসিআই দুজনকে পাহারা দেবার ব্যবস্থা করার আগেই তুলে আনতে হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে আরেকজনও হতে পারে রানার বাবা।
এই দুজনকেই আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। দু’জনেরই দাবী- তিনিই রানার বাবা। ট্রুথ সেরাম দিয়েও কাজ হচ্ছে না। সম্ভবত, মন থেকে দুজনই বিশ্বাস করে যে সে রানার বাবা। এইক্ষেত্রে যে কাজটা করতে হবে, দু’জনের কাছ থেকেই ডিএনএ নিয়ে দু’টা ক্লোন করতে হবে।
ক্লোনিং তো বিশ্বে আগেই প্রচলিত। সেটার মাধ্যমে একটা নতুন শিশু পাওয়া সম্ভব ছিলো। কিন্তু প্রতিভাবান কবীর চৌধুরী উদ্ভাবন করেছেন নতুন ফরমুলা। তাতে মানুষের রক্ত মাংসের একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করা সম্ভব। সঠিক ডিএনএ তাতে থাকলে, সেটা আসল মানুষটার মতোই হয়ে ওঠে দক্ষ।
রানার একটা ক্লোন হাতে থাকলে, কবীর চৌধুরীর অনেক কাজই বেশ সহজ হয়ে যায়।
এরমধ্যেই দু’জনের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। রানার মতো হুবহু দেখতে দুইজন তৈরিও হয়ে গেছে। আর দুইদিনের মাঝেই রানার দু’টা ক্লোন তৈরি হয়ে যাবে। তারপর যোগ্যতা, কাজকর্ম বুঝে একজনকে টিকিয়ে রাখা হবে। আরেকজনকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
পাঁচ
সেসনা কেপ ডি গাটা আইল্যান্ডের কাছাকাছি চলে এসেছে। ফ্রেঞ্চ নাগরিকের ভোলভাল পালটে রানা এখন পুরোপুরিই ফিরে এসেছে নিজের চেহারায়। ইঞ্জিন অফ করে সেসনাটা এখন এয়ার গ্লাইড করছে। তাঁর মাধ্যমে কবীর চৌধুরীর রাডারকে ফাঁকি দেয়া যাবে।
পাইলটের ওপর নির্দেশ রয়েছে, রানা প্যারাস্যুট নিয়ে জাম্প করার পাঁচ মিনিট পর ইঞ্জিন চালু করে সেসনা ফিরে যাবে তাঁর ল্যান্ডিং স্টেশনে।
পাইলট মুখ ফিরিয়ে বললো- গুডলাক, সিনর…
মুখ ফিরিয়ে দেখলো, কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগেই রানা জাম্প করেছে কবীর চৌধুরীর দ্বীপে।
গভীর অন্ধকার। ঠিক যে জায়গায় রানা প্যারাসুট নিয়ে ঝুপ করে নামলো, গার্ডরা সেখানে কেউ নেই। থাকলে মনে হতো, বিশাল একটা পেটমোটা বাদুড় নামলো।
প্রথমেই আক্রমণ এলো ভয়াল দর্শন ছয়টা গ্রে হাউন্ড কুকুর থেকে। নীরবে ছুটে এলো তারা। সাইলেন্সার লাগানো রানার ওয়ালথার পিপিকে অনেকটা নীরবেই মৃত্যুবর্ষন করলো। দ্যুপ করে একটু শব্দ হলো খালি।
গার্ডরুমে টিভি চলছে। তাতে রেস্ট সেশনে থাকা গার্ডরা কোনো ফুটবল ম্যাচ দেখছে। সামনে পড়ে আছে আধখাওয়া স্যান্ডউইচের প্লেট, কফির কাপ। সেমি অটোমেটিক স্টেনগান সরাসরি চালিয়ে দিলো রানা ওদের ওপর। খট খট খট খট করে বাড়ি পড়লো চেম্বারে। মুহূর্তে যেন নরক হয়ে উঠলো জায়গাটা।
উপরে উঠতে শুরু করলো। সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে শুরু করলো রানা। চারদিকে ততোক্ষণে এলার্ট সাইরেন বাজা শুরু করেছে। হুট করেই যেন আলোর মিছিল বয়ে গেলো চারপাশের ফ্লাডলাইটে।
রানা খুব ভালো করেই জানে, ঠিক ওপরের তলায় রয়েছে আরেকটা গার্ডরুম। আসার আগে গগোলের দেয়া ম্যাপ দেখে দেখে একেবারে মুখস্থ করে এসেছে। কী হয়েছে ঠিকঠাক মতো বোঝার আগেই বেরিয়ে এসেছে দুয়েকজন গার্ড। খালি গায়ে হাতে ধরা স্টেনগান। এক সেকেন্ড সময় নিয়ে রানা ছুঁড়ে দিলো একটা গ্রেনেড। প্রকাণ্ড শব্দ করে ফাটলো সেটা। মুহূর্তে জ্বলন্ত আগুনের মশালে পরিণত হলো একেকটা গার্ড।
ততোক্ষণে রানা টপকে চলে গেছে ওপরের রেলিং। ওখানেই কবীর চৌধুরীর ল্যাব। পুরু প্লেক্সি গ্লাসে ঘেরা সমস্তটা জায়গা। হুট করেই মুখোমুখি পড়ে গেলো এক গার্ডের। হাতের ছুরিটা সে বসাতে চেয়েছিলো বুকেই,রানার বিদ্যুৎগতির রিফ্লেক্সে সেটা বুক এড়িয়ে পড়লো বাঁ উরুর মাংসপেশীতে। দাঁতে দাঁত চেপে গার্ডের কণ্ঠনালী চেপে ধরলো রানা। শ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাস করছে গার্ড। মুখের ওপর দুটা ঘুষিও সহ্য করতে হলো রানার। আস্তে আস্তে নেতিয়ে এলো গার্ড। শ্বাস রোধ হয়ে গেছে তাঁর।
দাঁত মুখ শক্ত করে থাই থেকে ছুরিটা বের করে ফেললো রানা। ভাগ্য ভালো, কোনো আর্টারি কেটে ফেলেনি। এই সময়ে হেলিকপ্টারের আওয়াজটা কানে যেন মধু বর্ষণ করলো রানার। পেরেছে, গগোল আর্মি ট্রুপের সাথে কথা বলে তাদের ফোর্স নিয়ে আসতে পেরেছে!
ছয়
হেলিকপ্টারের রোটরের তীব্র আওয়াজ হচ্ছে। রানাকে ঘিরে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছেন কাজী আনোয়ার হোসেন, শেখ আব্দুল হাকিম, গগোল আর মিলান এয়ার ফোর্সের পেট্রোল হেড। যথেষ্ট রক্তক্ষরণ হলেও, রানার অবস্থা সংকটে পড়ার মতো কিছু নয়। আর পনেরো মিনিটেই এয়ার ফোর্সের স্থানীয় ঘাঁটিতে পৌঁছে যাবে তারা। ওখানে ডাক্তার আছে, জানিয়েছে ট্রুপ হেড।
যদিও রানার মনে খুব যে তৃপ্তি, এমন নয়। কবীর চৌধুরী আবার ফসকেছে। এই লোকটা কীভাবে কীভাবে যেন প্রতিবার হাতের মুঠো থেকে পালিয়ে যায়।
কীভাবে এই দুর্ভেদ্য ল্যাবে ঢুকবে, সেটার জন্য রানার অন্য প্ল্যান ছিলো। কিন্তু, গগোল এয়ার ট্রুপ নিয়ে আসতে পারায়, সে আর খুব বেশি ঝুঁকিতে যায়নি। গার্ড আর ল্যাবের সায়েন্টিস্টরা সবাই ধরা দিয়েছে। কবীর চৌধুরীকে খোঁজা হয়েছে দ্বীপের প্রতিটা কোনা, সম্ভবত এই লোক স্পিডবোটে করে সরে গিয়েছে।
হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজের মাঝেই সঙ্ঘটিত হচ্ছে আরেক নাটক। পৃথিবী কাঁপানো দুর্দান্ত সব অ্যাডভেঞ্চারের নায়ক এম আর নাইনের আজকে দুনিয়াটাই কেঁপে যাচ্ছিলো। গত কয়েকদিন রানার মনে চলছিলো- কে আসলে তার বাবা?
কবীর চৌধুরীর অত্যাধুনিক ল্যাবে সায়েন্টিস্টদের ধরে রানা এই টেস্টটাই করিয়েছে। এখনকার দুনিয়ায় যেটা করাতে অনেক সময় লাগে, সেই ডিএনএ টেস্টটাই রানা করিয়েছে কয়েক মিনিটে।
সেখান থেকেই জানা গেছে, রানার জন্মদাতা আসলে কাজী আনোয়ার হোসেনই। তবে, শেখ আব্দুল হাকীমও তার ভরনপোষণ করে গেছে অনেকটা বছর। দু’জনেই মনে করে রানা তাদের সন্তান। এখন থেকে রানাও তা-ই মনে করে। সে দুজনেরই আপন।
চোখ আবার বন্ধ করলো রানা। মনের মধ্যে ভেসে উঠলো কাঁচা-পাকা ভুরুওয়ালা একটা মুখ। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। বিড়বিড় করেই রানা বললো- স্যার, আমি আমার বাবা খুঁজে পেয়েছি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন