বছর চারেক আগে উন্মাদ পত্রিকার কার্টুনিস্ট মেহেদী ভাইয়ের গায়ে-হলুদে গিয়েছিলাম।
প্রথামাফিক আমরা হলুদ দিলাম; কেক কেটে খাওয়ালাম; মিষ্টি ভেঙে নিজেরা মুখে দিলাম; ফটোসেশন করলাম; এর সাথে ওর সাথে হাহা হিহি করলাম; তারপর খেতে ডাকার সাথে সাথে সুড়সুড় করে টেবিলে বসে গেলাম।
চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। খেতে বসার সাথে সাথেই প্লেটের সাথে তাই জুড়ে গেলো চামচ-কাঁটা চামচ। ওয়েটার এসে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন থ্রি ইস্টু ওয়ান। আমি আর উন্মাদের তন্ময় পাশাপাশি বসা। সতৃষ্ণ নয়নে অপেক্ষা করছি সামনের চেয়ারে তৃতীয়জনের কোটা পূরণ করতে কে এসে বসে!
আমাদের অন্তরাত্মা মোটামুটি কাঁপিয়ে দিয়ে সামনে এসে বসলেন জুন্নুন ভাই! দ্য গ্রেট জুন্নুন ভাই। কম্পিউটার স্পেশালিস্টের পাশাপাশি তিনি কারাতে ব্ল্যাকবেল্ট। উন্মাদে কাউকে বিশেষভাবে শায়েস্তা করতে হলে সম্পাদক আহসান হাবীব ভাই এই জুন্নুন ভাইকে স্মরণ করে থাকেন।
এহেন জুন্নুন ভাই সামনে এসে বসাতে আমি আর তন্ময় শক্ত ফ্রিজের মতো হয়ে গেলাম। ওয়েটার ডিশে নিয়ে এলেন চিকেন ফ্রাই। শক্ত মুখে বললেন থ্রি ইস্টু ওয়ান। জুন্নুন ভাই নিলেন। আমরা শক্ত হয়ে বসে আছি। কী জানি যদি চিকেন ফ্রাই নিতে গিয়ে ভূলচুক হয়ে যায়! যদি থাবড়া-টাবড়া খাই! জুন্নুন ভাই কড়া গলায় বললেন- কি ব্যাপার তোমরা নিচ্ছো না কেন?
আমরা 'এই যে নিচ্ছি' বলে হুড়োহুড়ি করে চিকেন ফ্রাই নিলাম। হুড়োহুড়ি করে করে খেতে গিয়ে গলায় বাঁধিয়ে ফেললাম। এলো ভেজিটেবল। একই অবস্থা। জুন্নুন ভাইয়ের ঝাড়ি না খেলে যেন আমাদের হাতই চলে না! শ্যাডার বিফেও একই অবস্থা! জুন্নুন ভাই এবার ওয়েটারকে ঝাড়ি দিলেন- শ্যাডার বিফ আরেকটা লাগাও!
শ্যাডার বিফ এলো, সেটা আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছার আগেই পাশের ভাই-বেরাদররা সেটা চেটেপুটে শেষ!
মোটের ওপর চাইনিজটা সেদিন জমলো না। আমি মনে মনে ভাবলাম- চাইনিজের খানা তো এমনই হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে পুষিয়ে নেবো।
মাথার ওপর বাজ ভেঙে পড়লো যখন শুনতে পেলাম যে বিয়ের অনুষ্ঠানও ঐ একই রেস্টুরেন্টে! আমি ফেসবুকে বিয়ের দাওয়াতের ইভেন্টে গিয়ে পোস্ট করলাম- বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবো, বিয়ের খাবারই খেতে চাই। আবার চাইনিজ-ফাইনিজ হলে আমি তাতে নাই!
তৎক্ষণাৎ আমাকে আশ্বস্ত করা হলো যে বিয়ের খাবারই হচ্ছে। অনেকে ইনবক্স করেও আমাকে কনফার্ম করলেন। বিশেষ করে বিয়ের দিনে আগে আগে খেতে বসে জুন্নুন ভাই পোলাউ আর রোস্টের ছবি ফেসবুকে পাঠিয়ে আমাকে জানালেন- খাবার ঠিক আছে, তুমি চলে আসো।
আমি উড়ে উড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। অনেক প্রিয় মুখ, অনেক কাছের মানুষ। সম্পর্কভেদে কাউকে মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম, কাউকে ভক্তিভরা সালাম, কাউকে মাথায় ঠোনকা। আবেগে কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, আবার কাউকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরার অদম্য ইচ্ছা লোকলজ্জার ভয়ে বুকেই পুষে রেখে গাম্ভীর্য মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- খেয়েছো?
নিজের হাতে বেড়ে খাওয়ালাম অনেককে। তুলে দিলাম রোস্ট, বেড়ে দিলাম রেজালা, ঢেলে দিলাম বোরহানির জগ। এবার নিজের পালা। হাত ধুয়ে ভদ্রলোকের মতো আসন নিলাম। আশেপাশে সব কাছের মানুষ। ওয়েটার এসে গম্ভীর মুখে আমাকে বললেন- স্যার খাওয়া তো শেষ!
আমি ভীত গলায় বললাম- শেষ?
ওয়েটার বললো- তবে স্যার বিকল্প ব্যবস্থা আছে।
আমি খুশি খুশি গলায় বললাম- কী?
ওয়েটার গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলো- চাইনিজ! থ্রি ইস্টু ওয়ান!
আমার মাথায় যেন পম্পেই, ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরি একসাথে বিস্ফোরণ শুরু করলো! চিন্তা করছিলাম থালাটা ফ্রিজবি আকারে ছুড়ে ফেলবো নাকি টেবিলে ধ্রিম করে একটা ঘুষি বসিয়ে দেবো।
ওমা! টেবিলে দেখি খাবার সার্ভ করা শুরু হয়েছে! কোথায় চাইনিজ? এ দেখি আমার অতি সাধের জাফরানের গন্ধওয়ালা পোলাও, ভেজা ভেজা মুরগির রোস্ট, তুলতুলে খাশির রেজালা, গরুর ঝাল ভূনা, মোলায়েম ভেজিটেবল, ঝাঁঝালো বোরহানি, পুরুষ্টু কাবাব।
জানি না কোন রসিক ঐ ওয়েটারকে শিখিয়ে দিয়েছিলো আমাকে ওমন ভয় দেখাতে, তবে তাকে হাজার সেলাম। না পাওয়ার বেদনায় কাতর কাউকে অল্পতেই তুষ্ট করা যায়। আর পরম আকাংখিত বিয়ের খানা পেলে তো আত্মহারা হবারই কথা! অনেকদিন পর কোন বিয়ের খানা আমি কনুই ডুবিয়ে খেলাম এবং তৃপ্তি পেলাম।
খোদাতায়ালা সকলকেই আনন্দ নিয়ে বিয়ে করা এবং বিয়ে খাওয়ার তৌফিক দিন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন