যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

৫০৯ পঠিত ... ১৬:৩৯, মার্চ ১০, ২০২২

Juddho-Juddho-khela

‘সবকিছুর পরেও ইউরোপ আমেরিকা ভালো থাকুক, কারণ ওইসব দেশে আমাদের বহু মানুষ পুরো পরিবারসহ সেটেল্ড, সেই দেশগুলো থেকে রেমিটেন্স আসে কাড়ি কাড়ি। আমাদের গরীব দেশের মানুষের স্বপ্নের দেশ ঐ ইউরোপ আমেরিকা-ই, তাদের ভেতরে মানবতা আছে; মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে; বাস্তবে থাকুক নাই থাকুক। খাবারে ভেজাল নাই, মাছে-দুধে ফলমূলে ফরমালিন নাই। ডিমও অরিজিনাল পাওয়া যায়।  

আমাদের দেশের অনেক লোক সেখানকার পার্লামেন্টেও আছে, ওখানে জীবন-জীবিকার গ্যারান্টি আছে, লেখাপড়ার ডিগ্রীর জন্য সেই ইউরোপ আমেরিকাই মানসম্মত; কানাডা, আমেরিকা, ইউকে-তে কত স্টুডেন্ট আছে!

কিন্তু রাশিয়ায় আমাদের কী আছে? কে যায় রাশিয়ায়, কি রেমিটেন্স ইনকাম আছে সেখানে, রাশিয়ান ভাষা শিখে কয়েকজন ইউটিউবার বিয়ে করা ছাড়া আর কী আছে? সকল কিছুর পরেও ইউরোপ আমেরিকার তুলনা নাই। ইউরোপ আমেরিকা আক্রান্ত হওয়া মানেই আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি হবে।'

কথাগুলো বলছিলেন একজন ভদ্রলোক। অফিস শেষে এসেছেন মহল্লার দোকানে। আমি আর সারোয়ার ভাই বসা রাসেলের চায়ের দোকানে। গুড়ের চা খাচ্ছিলাম।

সারোয়ার ভাইয়ের সাথে বেশ অনেকদিন পরে দেখা। উনার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনিও শুনেছেন কথাগুলো। হালকা প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে সেই লোকের দিকে চেয়ে আছেন।

সারোয়ার ভাইয়েরা তিন চাই। বড়জন লন্ডনে থাকেন, মেজোটা আমেরিকায় ডালাসে, দীর্ঘদিন। সেই সূত্রে সামনে উনার আমেরিকা যাওয়ার একটা চান্স আছে। ওই ভাই বাবা মা-কে ইতিমধ্যে নিয়ে গেছেন। একে একে বাকি ভাইবোনেরাও যাবেন।

যদিও রেমিট্যান্সের ব্যাপারটা লোকটা ভুল জানে। রেমিট্যান্স বেশি আসে মিডলইস্ট থেকে। কিন্তু সেখানে তো কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে থাকে না। ওরা কাউকে সিটিজেনশিপও দেয় না। আমরা আর কিছু বললাম না তাকে।

কথাগুলো আসলে শুধু এই ভদ্রলোকের একার কথা না। বাংলাদেশের অনেকের মনের কথা। যদিও আমেরিকা কানাডায় না যাওয়া পর্যন্ত তারা মুখে মুখে পশ্চিমের বিরোধিতা করবে।

সারোয়ার ভাইকে বললাম, ‘ভাই, এই মুহুর্তে দেশের বেশিরভাগ মানুষই রাশিয়ার পক্ষে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইহুদি বলে তার পুরনো ইসরায়েল প্রেমকে সামনে এনে তাকে মুসলিম বিদ্বেষী বানিয়ে পুতিনের হামলাকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে। এটাও ফেলে দেয়ার মত যুক্তি নয় কিন্তু!’

সারোয়ার ভাই বললেন, ‘আমার ধারণা, বাংলাদেশি আপামর জনসাধারণের রাশিয়ার পক্ষে যাওয়ার কারণ হল, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার ইউক্রেনের পক্ষ নেওয়া। মানুষের মেন্টালিটিটাই এমন হয়ে গেছে, মিডিয়া যার পক্ষে যাবে, মানুষ তার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তারা জানে, মিডিয়াকে কন্ট্রোল করা যায়, আর যারা করে তারা সবাই মাফিয়া। এই কারণে মিডিয়ার প্রতি সবার এতটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়ে গেছে। মিডিয়ার লোকজন কি আদৌ এগুলো বোঝার চেষ্টা করে!’

চা চলে এসেছে।

এর মধ্যে মোবাইলে ফেইসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে একটা খবরে চোখ আটকে গেল। ইউক্রেনের অনেকগুলো পারমাণবিক স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে রাশিয়া।

আমি তাকে বললাম, 'ভাই দেখেন আরও ঘটনা আছে। রাশিয়ান সোলজাররা যদি এখন উবু দশবিশ করে একটা মিসাইল ফুটিয়ে দেয়, তাহলেই আর রক্ষা নাই। কুখ্যাত 'চেরনোবিল' দুর্ঘটনা হয়েছিল কিন্তু ইউক্রেনেই, সেই সোভিয়েত আমলে।'

সারোয়ার ভাই একটু যেন চমকালেন। চায়ের কাপ থেকে চা ছলকে পড়ল কী? তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।

ফিনল্যান্ডে থাকা এক বড়ভাইয়ের স্ট্যাটাস দেখে তাকে বললাম, 'স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলো নাকি যুদ্ধের প্রিপারেশন নিচ্ছে। কীরকম? যদি যুদ্ধ শুরু হয়েই যায়, তাহলে ফিনল্যান্ড, সুইডেন এসব দেশের অনেক বাসাবাড়ির নিচের বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিবে।

সম্ভবত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড সহ ইউরোপের অনেক দেশই এই প্রিপারেশন নিয়ে রাখছে। তারা প্রায়ই যুদ্ধকালীন সময়ে আত্মরক্ষা মূলক ড্রিল করে থাকে। কোনো কোনো শেল্টার আছে ফুললি ইক্যুইপড। নাগরিকেরা জানে কোন কোন বাসার নিচে ও কোন এলাকায় কোথায় কোথায় শেল্টার আছে। বেশিরভাগই গ্রামের দিকে।

অনেকে এক বছরের সাপ্লাই রেডি করেছে, মেডিসিন প্যাকেট করে রেখেছে, খাবার থেকে শুরু করে যা যা ইমার্জেন্সি দরকার। পানির ছোট ছোট ট্যাংক বর্তমানে বাজারে নাই, বিক্রি হয়ে গেছে। মিনি রেডিও ও নাই, সব সোল্ড আউট।'

আমি বলে যাচ্ছি, ' মানে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মত আরকি। ১৯৭১-এ অনেকেই এরকম গহীন গ্রামে চলে গিয়েছিল। গ্রামে গেলে তো আর ডাইরেক্ট বম্বিংয়ের শিকার হতে হবে না। কিছুদিন আগে একজন ইসলামিক স্কলারের বয়ানেও শুনেছিলাম, তিনি প্রায় লেকচারে লোকজনকে যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাপদ থাকার জন্য গ্রামে আধুনিক ফ্যাসিলিটি ছাড়া থাকার প্র‍্যাকটিস করার নসিহত করেন। অনেকটা 'ইন টু দ্য ওয়াইল্ড' মুভির মত। হুজুর ওই মুভি না দেখে থাকলেও হয়তো আইডিয়া তার পছন্দ হয়েছে।'

সারোয়ার ভাই শুনলেন। বললেন, 'আমি মনে করি না ঘটনা ওই পর্যন্ত যাবে, তার পরেও সতর্ক থাকা তো দোষের কিছু না। পারমাণবিক যুদ্ধ বাধলে মৃত্যু টেরই পাবো না, এতো চিন্তার কী আছে?  আর দ্যাখো, ইউরোপিয়ানদের সাথে আমাদের চিন্তার পার্থক্য। ওরা কিনে রাখছে ওষুধ আর খাবার, আর রাশিয়ার যুদ্ধে আমরা কিনে স্টক করছি সয়াবিন তেল। 'মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরা' অবস্থা বোধহয় একেই বলে।'

বলা শেষ করে 'হাক থুহ' বলে থুতু ফেললেন। বুঝলাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বেশ বিরক্ত।

কড়া লিকারের চা ছাড়া সারোয়ার ভাইয়ের মেজাজ ঠিক হবে না।

৫০৯ পঠিত ... ১৬:৩৯, মার্চ ১০, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top