লেখা: শারমিন শান্ত
আরব দেশের এক পোলা অনেকক্ষণ ধরে আমার পিছে ঘুরঘুর করছে। প্রথমে অবশ্য বুঝি নাই। কারণ এত বড় মার্কেটে বোঝার কথা না যে ও আমার পেছনেই ঘুরছে।
কিন্তু যখন তিন-চারটা দোকান ঘুরে, অলিগলি পেরিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম, আর সেও ঠিক ঠিক আমার পাশের টেবিলে গিয়ে বসল, তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে সত্যি সত্যি সে আমাকেই ফলো করছে।
: তুমি কি একা একা এসেছ?
: হ্যাঁ, কেন!
বাহ, ছেলে তো আবার ইংরেজিও ভালো জানে। সাধারণত আরব দেশের বেশিরভাগ লোকজন খুব একটা ইংরেজি বলতে পারে না।
: এখানে আরেকটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট আছে, তুমি যদি কিছু মনে না করো, তুমি কি আমার সাথে সেই রেস্টুরেন্টে যাবে, ওখানে ফ্যামিলি ছাড়া ঢোকা যায় না।
: মানে! কী বলছ এসব! তুমি কে? আমি কি তোমাকে চিনি! আমি তোমার সাথে রেস্টুরেন্টে কেন যাব?
: আরে আমিও তো তোমাকে চিনি না। আর সেটা তো বেশি দূরেও না! জাস্ট ওই পাশেই, কিন্তু ওখানে যেতে হলে সাথে কোনো না কোনো মেয়ে থাকতে হয় এজন্য বলছি। আর তুমি তো খেতে বসেছই, ওখানেই না হয় খেলে, কোনো সমস্যা আছে!
আমি ছেলেটার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করছি না। কুয়েতি কোনো ছেলের আমার মতো এশিয়ান চেহারার মেয়েকে এরকম কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না! ওরা সব এশিয়ান মানুষকে কাজের লোক মনে করে। সেখানে সে আমাকে নিয়ে খেতে বসতে চাচ্ছে ব্যাপারটা বিস্ময়কর।
: কী হলো কথা বলছ না, সমস্যা আছে?
: না তা সমস্যা নেই, কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনি না!
: বললাম তো, আমিও তোমাকে চিনি না! তাতে কী! একটা রেস্টুরেন্টে বসে খেলে কী হয়! আর তাছাড়া এটা আরব দেশ, আমাদের আইন-কানুন যে কড়া, আমি যে তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারব না এইটুকু তো বোধহয় জানো, তাই না?
: হ্যাঁ, তা জানি, কিন্তু আমাকে কেন বলছ, তোমার সাথে কেউ নেই?
: না, এখন সাথে কেউ নেই।
: তাইলে অন্য কোনোদিন যেও।
: না, আমার আজকেই যেতে হবে, আজকে যদি আমি ওই রেস্টুরেন্টে না খাই, তাহলে অনেকদিন খেতে পারব না, এজন্যই আসলে জোর করছি, প্লিজ চলো।
আমি একটু চিন্তা করলাম।
ছেলেটা দেখতে খারাপ না। মাঝারি সাইজের লম্বা, আরব দেশের ছেলেরা যেরকম হয় আরকি, ফর্সা, গালে দাড়ি। ঢিলে ঢালা প্যান্ট, টি-শার্ট আর মাথায় ক্যাপ পরে একটু পর পর ফোক ফোক করে ভেপ টানতেছে, দেখতে ভালোই লাগতেছে। এরকম একটা ছেলের সাথে অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য এক টেবিলে বসে খাওয়াই যায়।
তাছাড়া এটা বিশাল বড় একটা শপিং কমপ্লেক্স। লোকজনে গমগম করছে। এখানকার কোনো রেস্টুরেন্টের মধ্যে খেতে বসলে এমন কোনো ভয়ঙ্কর কিছু হবার সম্ভাবনাও তেমন নেই।
: আচ্ছা চলো, কিন্তু আমার খাবার আমি অর্ডার দেব এবং সেটার বিল আমি নিজেই দেব।
: আচ্ছা ঠিক আছে, দিও, তাতে কোনো সমস্যা নেই।
শপিং কমপ্লেক্সের এক সারি দোকান পেরিয়ে পরের সারিতে গেলেই তার সেই রেস্তোরাঁ।
রেস্টুরেন্টটা ভালোই, ছিমছাম। তবে ভেতরে যেতে অবশ্যই সাথে কোনো না কোনো মেয়ে লাগবে, মানে পরিবার লাগবে আরকি।
: আচ্ছা তোমার বাসায় মেয়ে কেউ নেই?
: হ্যাঁ, মা আছে।
: তাইলে তাকে আনলে না কেন খাওয়ার জন্য?
: ধুর, মাকে আনলে শুধু শুধু আজকে কান্নাকাটি করত।
: কেন, কান্নাকাটি করত কেন?
: আমি আজকে চলে যাচ্ছি যে!
: কোথায় যাচ্ছ?
ছেলেটা কিছুক্ষণ দম নিলো। হয়ত বলবে কী বলবে না এই নিয়ে দোলাচলে ভুগছে।
: অ্যাঁ, আজকে আসলে আমার ফেরত যাবার তারিখ।
: কোথায়?
: উমম... জেলে।
: কোথায়!
: বললাম তো, জেলে।
: জেল মানে কি কারাগার?
: হ্যা।
: তুমি জেলে ফেরত যাবা মানে! বুঝি নাই! বুঝিয়ে বলো।
সে একটু গলা খাঁকারি দিল।
: আসলে আমার দুই বছরের সাজা হয়েছে, এরমধ্যে গিয়েছে মাত্র 5 মাস আর ১৯ মাস বাকি আছে।
: মানে! সাজা হইলে তুমি এখন বাইরে কেন! জামিন পেয়েছ?
: না।
: তাইলে?
: আসলে আমাদের জেলখানা মেরামতের কাজ চলছে। এজন্য সব কয়েদিকে দুই সপ্তাহের ছুটি দেওয়া হয়েছে। দুই সপ্তাহ পরে আজকে সবার জয়েন করার কথা।
আমার মাথা কাজ করতেছে না, এই ছেলে বলে কী!
খুব সম্ভবত আমার চেহারায়ও সেই অবিশ্বাস ফুটে উঠেছিল।
: তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না? তুমি দরকার হলে অনলাইনে পত্রিকায় দেখ, তাইলেই খবরটা পড়তে পারবা।
আমি তড়িঘড়ি মোবাইলে কুয়েত টাইমস, কুয়েত নিউজসহ বেশ কয়েকটা অনলাইন পত্রিকা বের করে ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। সার্চ দিয়ে দেখি ঘটনা আসলেই সত্যি।
মেরামত করা উপলক্ষে কুয়েতের জেলখানা থেকে সমস্ত কয়েদিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দুই সপ্তাহের জন্য এবং দুই সপ্তাহ পর তাদেরকে জয়েন করতে বলা হয়েছে।
আসলে এটা করা সম্ভব কারণ কুয়েতের সাথে অন্য দেশের বর্ডার এমন যে চাইলেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যেতে পারবে না। আর কড়া নিরাপত্তার কারণে আকাশ পথে তো নয়ই। তার ওপর কুয়েত দেশটা এত ছোটো যে অপরাধী লুকিয়ে বাঁচার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, ফিরতে তাদের হবেই। উল্টো সময় মতো না ফিরলে পরে সাজার মেয়াদ আরও বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
খবরটা পড়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
কই এতক্ষণ মনটা খুশি খুশি লাগতেছিল। কুয়েতি সুন্দর এক পোলা আমাকে নিয়ে খেতে বসছে, এই আনন্দে ভাসতে ছিলাম। কিন্তু না, শেষমেশ সে কিনা এক দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিকলা!
ইয়া আল্লাহ, আমার সাথেই শুধু এমন হয় ক্যান, বুঝি না!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন