নো মোর বিফ পলিটিকস

২৪১ পঠিত ... ১৮:১২, জানুয়ারি ২১, ২০২৫

31

বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রোটিন সংকট আছে। মাছ-মাংসের স্বাধীনতা আজও অধরা বেশিরভাগ মানুষের জীবনে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু লোককে রেস্টুরেন্টে গরুর গোশত রাখার দাবি নিয়ে উচ্চকিত হতে দেখেছি। তার নানারকম সমালোচনার পেছনে যুক্তি ও অপযুক্তি দুই-ই আছে।

শৈশব থেকে খাবার হোটেলে খাদ্য তালিকায় মুরগি, খাসি, গরু তিন ধরনের মাংসের নাম দেখেছি। হোটেলে বসে লক্ষ্য করেছি, গরুর মাংসের দাম সবচেয়ে কম বলে একটু কম আয়ের মানুষেরা তা অর্ডার করে। কারণ মুরগি কিংবা খাসির মাংসের দাম; তাদের সামর্থ্যের বাইরে।

একই রকম খাদ্য তালিকা ইউরোপের বিভিন্ন খাবার হোটেলের তালিকায় দেখেছি। সেখানে চিকেন, মাটন, পোর্ক, বিফ সবই থাকে। যার যেটা পছন্দ, সে সেটা অর্ডার করে। এ নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। ইউরোপের কোনো হোটেলে গিয়ে পোঁ ধরার উপায় নেই, ইসলাম ধর্মে পোর্ক খাওয়া মানা; অতএব খাদ্যতালিকা থেকে পোর্ক সরাও। হিন্দু ধর্মে গোমাতাকে পূজা করা হয়; সুতরাং রেস্টুরেন্টের বাইরে নো বিফ লিখে দাও।

বাংলাদেশে এ কারণে রেস্টুরেন্টের খাদ্য তালিকায় পোর্ক রাখার উপায় নাই; ভারতে খাদ্য তালিকায় বিফ রাখার উপায় নাই। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ভারত সমর্থিত শেখ হাসিনা সংস্থাপিত হবার পর; নো বিফ সাইনটি ঝুলতে শুরু করে কিছু খাবার হোটেলে। কম আয়ের মানুষের জন্য প্রোটিনের বরাদ্দ সরে যায়। চিকেন বা মাটন তার সামর্থ্যের বাইরে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায়, ভারতে মুসলমানেরা সংখ্যালঘু বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর ইচ্ছা অনুযায়ী বিফ মিট নিষিদ্ধ। আবার বাংলাদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুর ইচ্ছা অনুযায়ী নো বিফ মিট সাইন ঝুলতে হবে। ভারত বিশ্বের বিফ মিট রপ্তানী কারক দেশগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে; কিন্তু বাংলাদেশে বিফ মিট রপ্তানী করবে না। এইভাবে বিফ পলিটিক্যাল হেজিমনির অংশ হয়ে ওঠে।

১৮৫৭ সালে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধে নেটিভেরা হেরে যাবার অন্যতম কারণ; এই বিফ ও পোর্ক পলিটিকস। বন্দুকের কার্তুজে গরুর ও শূকরের চর্বি ব্যবহার করা হয়েছে; বৃটিশেরা এই প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সৈনিককে দ্বিধান্বিত করে। সুতরাং এই মাংসের সঙ্গে ধর্মানুভূতি জড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে নাকাল করার কোনো শেষ নেই।

প্রোটিন না পেলে যেহেতু মস্তিষ্ক বিকশিত হয় না; তাই ঢাকা শহরে কিছু লোককে আমরা দেখতে পাই, হিন্দু হোটেলে কিংবা ভেজিটেরিয়ান হোটেলে গিয়ে গোমাংস রাখার দাবি জানাতে। অথচ এটা কমনসেন্স যে হিন্দু হোটেল ও ভেজিটেরিয়ান হোটেলে গোমাংস থাকবে না।

অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা যেহেতু চিকেন ও মাটন এফোর্ড করতে পারে; তাই তারা গোমাংস তেমন খায় না। সৈয়দেরা গরুর গোশতকে গরিবের খাদ্য বলে মনে করে। সুতরাং যারা নতুন সৈয়দ হতে চায়; কিংবা নিজেকে সম্ভ্রান্ত মুসলমান প্রমাণ করতে চায়; তারা সাধারণ মুসলমানের গোমাংসের দাবিটিকে ছাগুদের কাণ্ড বলে টিটকারি করে। যারা নতুন শিবাজি হতে চায়, নিজেকে সম্ভ্রান্ত হিসেবে হিসেবে প্রমাণ করতে চায়; তারা সাধারণ মুসলমানের গোমাংসের দাবি দেখে ‘কাঁঠাল পাতা খোর’ বলে টিটকারি দিলে; নতুন সৈয়দ আর নতুন শিবাজি মিলে রচনা করে; নিও লিবেরেল আবহ; গরিব মুসলমানকে নিয়ে টিটকারি দিতে পারা মানেই ইংল্যান্ড কিংবা সুইডেনের রানীর নাতি-নাতনির মর্যাদা লাভ করতে পারে পোড়া বেগুনের মতো মুখমণ্ডলের নিও এলিটেরা।

এখন এই যারা ইসলামি জোশের সঙ্গে গরুকে মেলাচ্ছেন; তাদের জানা প্রয়োজন; ইসলামের আদিভূমি আরব বিশ্বে উট-দুম্বা-ভেড়ার মাংস প্রচলিত। আরব বিশ্বে যে খ্রিস্টানেরা রয়েছেন, তারা পোর্ক খেলে বা ফ্রিজে পোর্ক রাখলে কোনো মুসলমান গিয়ে কোনো খ্রিস্টানকে পিটিয়ে মেরে ফেলে না। আরব বিশ্বে খুশিজলের বন্দোবস্ত রয়েছে। রয়েছে সংগীত ও নৃত্য। তরুণ-তরুণীরা কোনো ভ্রমণে গেলে গ্রামবাসী এসে কাজি ডেকে তাকে বিয়ে পড়িয়ে দেয় না। সুতরাং ইসলাম উৎপত্তি যেখানে সেখান থেকে এতদূরে বসে ইসলামের মালিক হতে চাইলে তা মানাবে না। মালয়েশিয়ায় মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইন্ডিজিনাস জনগোষ্ঠী মিলে মিশে থাকে বলেই; তারা সমৃদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী। মালয়েশিয়ার পাসপোর্ট আর এমেরিকান পাসপোর্টের গুরুত্ব একই। কিন্তু গরিবের ঘোড়া রোগ অতিরিক্ত ইসলামের মালিক হয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-ইন্ডিজিনাসের ওপরে পেশীশক্তি দেখানোর সভরেন্টি রোগের কারণে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখলেই বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে বলে, আপনি একটু এদিকে আসেন। এই অবস্থা আজকাল হিন্দু ভারতের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পালকি শর্মা ইউটিউবে কান্না জুড়ে দিয়েছে।  

ভারতের উপনিবেশ বাংলাদেশের লেন্দুপ দর্জির ফ্যাসিস্টকাল গত হয়েছে। নতুন বাংলাদেশে নব্বুই শতাংশ মুসলমানের বাকি দশ শতাংশ অন্য বিশ্বাসের মানুষের ওপর মাতবরি করে আধিপত্য কায়েমের কিছু নেই। উত্তেজনা কমিয়ে নিজেকে জানতে হবে। এমন কোনো যোগ্যতা নেই যে কারণে কেউ ইসলাম সম্পর্কে জানতে আসবে প্রান্তের এই মুসলমানের কাছে। মিশরে, সৌদি আরবে, তুরস্কে ও ইরানে অসংখ্য ইসলামবেত্তা রয়েছেন, দার্শনিক ও চিন্তক রয়েছে; বিশ্ব যাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। অযথা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা ভুল। উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ধর্ম বেত্তা দার্শনিক ও চিন্তক রয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশের নতুন শিবাজির স্বপ্নে কেউ বিভোর হবে না। বাংলাদেশের হিন্দু কিংবা মুসলমান কারও কোনো আর্য দাবি কেউ কখনও বিশ্বাস করবে না। সুতরাং এখন কাজ করতে হবে বিদ্যার্জন ও প্রজ্ঞা আহরণে। শ্রেষ্ঠ তম বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন, গবেষণা, মৌলিক সমাজ ও দর্শন গবেষণা, শিল্প-সাহিত্যে উৎকর্ষ অর্জন না করলে সারাজীবন এই কলতলার বাহাদুরী কাইজ্জায় জীবন চলে যাবে।

বাংলাদেশের একজন মানুষের নিষ্ঠা থাকলে তিনি বিশ্বসভায় আদৃত হতে পারেন। ডাভোস সম্মেলনে ভারত-পাকিস্তানের ম্লান প্রতিনিধিদের পাশে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ড. ইউনূসের ঔজ্জ্বল্য চোখ মেলে দেখুন। ঠিক এইভাবে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। তারজন্য লাগে জীবনব্যাপী সাধনা। তা না করে দামি শাড়ি পরে কলতলার কাসুন্দি করে একে ওকে সুদখোর রক্তচোষা বলে; এরপর ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে থাকতে হয়।  

 

২৪১ পঠিত ... ১৮:১২, জানুয়ারি ২১, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top