তারেক একজন সুপারস্টার নায়ক। ভক্তরা তাকে আদর করে স্কিপ খান বলে ডাকে। তারেক যখন প্রথম বিয়ে করে তখন তার বয়স মাত্র একুশ বছর। না, না, ভুল বুঝবেন না। এতে আইনত কোনো অপরাধ নেই। গুণীজনেরা বলেন, ছেলেদের নাকি ম্যাচিউরিটি ধীরে আসে। ওই হিসেবে তার যখন বিয়ে হয়—সে তখন কখনও সমুদ্র না দেখা কুয়ার ব্যাঙ।
বিয়েটা হয় একরকম তড়িঘড়ি করে।
তারেকের আব্বার তখন কোলন ক্যান্সার। একদিন সকালে তারেকের হাত ধরে তিনি বলেন, 'হাশেমের মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বিয়েটা করে ফেলো বাবা, বৌমার হাতের আদর যত্ন যদি পাই কিছুদিন! কদিন বাঁচি বলা তো যায় না...’
এরপর বাপ ব্যাটা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদে। তারেকের বিয়ে হয় পরদিন সন্ধ্যায়। মেয়ের নাম শাহীনূর। বাসর রাতে তারেক বউকে বলে, 'আমার আব্বাকে দেখে রাইখো...’
শাহীনূর ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শ্বশুরের সেবা শুশ্রূষা করে। একের পর এক কেমোথেরাপিতে একসময় ক্যান্সারের হাত থেকে মুক্তি পান তারেকের বাবা। বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি। এই আনন্দঘন পরিবেশে তারেক ঘোষণা দেয় সে এবার নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চায়। আগেরবার যেহেতু বাবার কারণে এই সুযোগ সে পায়নি, এই বিয়ে তার প্রাপ্য।
অনেকদিন ধরে তার মনের মধ্যে এক হরিণচোখা মেয়ে জায়গা করে নিয়েছে। এক শুভ দিনে পরিবারসহ পালকি বেয়ারা নিয়ে তারেক হাজির হয় পাপড়িদের বাসায়। সবার পছন্দ হলেও বেঁকে বসে তারেকের বোন। মেয়েটার মধ্যে নাকি একটু ব্যাটাছোল ভাব। এসব কথা শুনেও না শোনার ভান করে তারেক। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ান, দুজনই কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বলে। এরপর দুলাভাইয়ের জুতা লুকানোর খেলায় মত্ত হয় পাপড়ির ছোটো বোন জুঁই। তার সাথে যোগ দেয় বড় বউ শাহীনূরও। ভুলে দুই একবার তারেককে 'দুলাভাই'-ও ডাকে জুঁইয়ের সাথে। এদিকে জুঁইয়ের অতিথিপরায়ণতা আর উচ্ছ্বলতায় মুগ্ধ তারেকের বোন। তার চোখের পাতা পড়ে না। কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে তারেককে বলে, 'এই মেয়েটা বেশি ভালো না?'
তারেকের তখন টনক নড়ে। মনে হয়, সত্যিই তো! ধীরে ধীরে জমে ওঠে শাহীনূর, তারেক আর পাপড়ির সংসার। সেখানে টক, মিষ্টি, ঝালা হয়ে আসে জুঁইও। প্রায় এক বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে সংসারে তৃতীয় স্ত্রী হয়ে আসে জুঁই।
ভালোই চলছিল তাদের সংসার। মাঝে মাঝে খুনসুটি হয় না, তা না। তবে তা ঢেকে যায় রাতের আঁধারে।
অনেকদিন পর বিদেশ থেকে ফেরত আসে তারেকের খালাতো ভাই শরীফুল। দেশে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য বিয়ে করা। শরীফুলের বিয়েতে গিয়ে চোখে পরে পাত্রীর বান্ধবী শিমুকে। শরীফুল ঐ পাত্রীকে বিয়ে করে বটে, তবে তারেককে জানায় তার সুপ্ত বাসনার কথা। শিমুকে খুব মানাবে তারেকের পাশে। দুইদিন সময় চায় তারেক। খালাতো ভাইয়ের কথা ফেলতে পারে না তারেক। এতদিন পর দেশে এসে মাত্র একটা আবদার করেছে, তা-ও রাখতে না পারলে নিজেকে ব্যর্থ ছাড়া আর কী মনে হবে?
ঘটা করে শরীফুলের পাশের স্টেজেই বিয়ে হয় তারেক আর শিমুর। হলুদে 'নয়া দামান' গানে একসাথে নাচে শাহীনূর, পাপড়ি আর জুঁই। একই রকম শাড়ি টুইনিং করে আর পরে টিকটক করে তারা। খুব সুখে কাটতে থাকে দিন।
সময় গড়াতে থাকে। তারেকের বয়স তখন ৩৪। তার ছোটোভাই মালেকের ৩০। এই বয়সে তারেকের ঝুলিতে চার বউ থাকলেও মালেকের ঝুলি শূণ্য। সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে করবে না। সবার অনুনয় বিনয়ের পর সে রাজি হয় এক শর্তে। বড় ভাই যদি বিয়ে করে আবার, তাহলে সেও করবে।
তারেক ভাবল, ছো্টো ভাইয়ের জন্য এতটুকু করতে না পারলে তার কোনো অবদানই রইল না। সবার চাপাচাপিতে মালেকের সাথে বিয়ে করে তারেকও।
ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই শেষ হয় বিয়ের অনুষ্ঠান।
সমস্যা শুরু হয় বিয়ের দুই মাস পর। বড় বউ শাহীনূর দুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। শহরে যেয়ে বারবার ডাক্তার দেখানোর খরচ সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে তারেকের। তার মাথায় সুবুদ্ধির উদয় হয় এক মাঝরাতে। শাহীনূর তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে, 'আপনি একটা ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করেন না ক্যান? মানুষও বাড়বে, চিকিৎসার খরচও কমবে...'
তারেকের চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। আরে সত্যিই তো! এই আইডিয়া আগে আসলেই কাজটা হয়ে যেত। অবশেষে দিনক্ষণ দেখে বিয়ে করে এক ডাক্তার মেয়েকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী হতে থাকে সবকিছু। চিকিৎসার খরচ কমে যায় অর্ধেক, সংসার ফিরে পায় তার গতি।
এদিকে মালেক একবার আইনী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে তারেক বাধ্য হয়ে বিয়ে করে এক ব্যারিস্টার মেয়েকে। সে-ই শেষ মেষ ঝামেলা থেকে মুক্ত করে মালেককে।
তারেকের বয়স যখন চল্লিশ, তখন তার আঠারো স্ত্রী, দশ সন্তান। এত বড় পরিবার নিয়ে এক বিল্ডিঙে বাস করা একটু কঠিনই ঠেকে তার কাছে। সে গ্রামের বাড়িতে আলাদা এক কলোনী বানায়। 'তারেক & কো:'
সেখানে পুরো এলাকা জুড়ে তার স্ত্রী সন্তান। গোলাভরা ধানের কাজ করে কেউ, ঢেকিতে পাড় দেয় কেউ, আবার কলসী ভরে পানি আনতে যায় কেউ। গরমের দিনে মাদুর পেতে লিচু গাছের ছায়ায় বসে তারেক প্রকৃতি দেখে।
একসময় মুখে দুর্বাঘাস চিবোতে চিবোতে সে ডাক দেয়, 'বউ!’ ণ
পেছন ফিরে তাকায় আঠারো রমনী।
তারেক মুচকি হাসে আর ভাবে, 'পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন?’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন