নতুন রাশিয়ার জনক পুতিন দেশটির ৮৭ শতাংশেরও বেশি ভোটারের সমর্থন নিয়ে পঞ্চম বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলেন। তার পশ্চিমা শত্রুবলয় একে বিরোধী শক্তিহীন ডামি নির্বাচন বলে বর্ণনা করলেও; চীন-ভারত-সৌদি আরব ত্রয়ী এই নির্বাচনকে অত্যন্ত সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক আর উন্নয়নের জন্য সহায়ক বলে বর্ণনা করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আট বছর পর লেনিনগ্রাদের এক দরিদ্র কমিউন ফ্ল্যাটে জন্ম নেয়া পুতিন শিশু অবস্থায় জীর্ণ ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে ধেড়ে ইঁদুর দেখে ভয় পেতেন। ইঁদুরের ভয়কে জয় করে তিনি লেনিনগ্রাদের একজন স্ট্রিট ফাইটার হয়ে ওঠেন। শেখেন জুডো কারাত। লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করে তিনি যোগ দেন গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে।
বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে পড়ার আগের বছরগুলোতে তিনি পূর্ব জার্মানিতে কাজ করতেন কেজিবির এজেন্ট হিসেবে। উন্মত্ত জনতা সেখানে পূর্ব বার্লিন গোয়েন্দা দপ্তরে হামলা করলে পুতিন রাশিয়ার লাল ঘোড়া দাবড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু মস্কো থেকে লাল ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণের নির্দেশ না আসায় পুতিনের চোখের সামনে কমুনিস্ট পূর্ব বার্লিনের পতন ঘটে।
পুতিন মাঝারি মানের এজেন্ট ছিলেন; কিন্তু প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, গোল গোল চোখ করে টাইম মেশিন মেথডে ইতিহাসের সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরবের বর্ণনা করতে পারায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেনিন গ্রাদ যুদ্ধে পুতিনের বড় ভাই শহীদ হয়েছিলেন; বাবা-মা কোনোমতে বেঁচে যান। লেনিন গ্রাদ যুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি লে কর্ণেল পদে পদোন্নতি পান।
প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিন পুতিনকে কেজিবি প্রধানের দায়িত্ব দিলেও তেমন সফল হননি তিনি। তখন তাকে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্ষদে আনা হয়।
সোভিয়েত পতনের পর ইয়েলেতসিন যেন ধুকছিলেন, পুতিনকে তার প্রিয় লেনিনগ্রাদের ডেপুটি মেয়র করা হয়। কিন্তু প্রবীণ নেতারা তার মধ্যে সোভিয়েত স্বপ্ন পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেখেন। আচার আচরণে পুতিন যেন সোভিয়েত লৌহ মানব জোসেফ স্ট্যালিনের মানসপুত্র। ফলে পুতিন হয়ে পড়েন প্রেসিডেন্ট পদে পছন্দের প্রার্থী।
প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি চেচনিয়ার সন্ত্রাসবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। গ্রোজনিতে রক্তের হোলি খেলে নতুন রাশিয়ার ইঙ্গিত দেন। নাইন ইলেভেনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের চোখে চোখ রেখে যূথবদ্ধ হন আফঘানিস্তানে মুজাহিদ ও আল-কায়েদা বিরোধী অভিযান পরিচালনায়।
বৃটেনে কেজিবির একজন এজেন্টের গ্যাস প্রয়োগে মৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমের সঙ্গে পুতিনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর থেকেই পুতিন প্রচারণা চালাতে থাকেন, ন্যাটোর সহযোগিতায় নিও নাতসিদের প্রাধান্য ফেরাতে চাইছে ইঙ্গ-মার্কিন চক্র। চীন-ভারতের সঙ্গে ঘন হতে থাকেন পুতিন।
জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যারকেল পুতিনের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মন্তব্য করেন, পুতিন প্যারালেল ইউনিভার্সে বসবাস করেন। ইউরোপের বিনাশ করতে পুতিন বদ্ধ পরিকর।
পুতিনের ব্যক্তিগত জীবনকে তিনি বড্ড লুকিয়ে রাখেন। ত্রিশ বছর তার সংসার করার পর স্ত্রী সেপারেশন নেন। দুটি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা ও গবেষণা কাজ করেন। পুতিন কেবল সহমত ভাই বোন ছাড়া কারো সঙ্গে তেমন মেশেন না। তিনি তার নারী দেহরক্ষীদের সম্পর্কে বলেছেন, আমি কেবল তাদের সুন্দর চোখ দেখে মুগ্ধ হয়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব দিইনি। এরা বিশ্বস্ততম।
পুতিন নব্বুই দশকের অলিগার্ক পরিবারগুলোর হাতে সমস্ত ব্যবসা বানিজ্যের দায়িত্ব দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, মাল পানি কামাও-বিদেশে পাচার করো; অসুবিধা নাই; উন্নয়নের গাড়ি রাস্তা দিয়ে গেলে দুর্নীতির ধুলো উড়বেই। কিন্তু সমর্থন ধরে রাখবে আমার প্রতি। ক্রিমিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারি নতুন ব্রিজ নির্মাণের ঠিকাদারির কাজ পেয়েছেন পুতিনের একজন বন্ধু। পুতিনের আত্মীয়-বন্ধু-অনুগতরাই রাশিয়ার নতুন অলিগার্ক।
ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনা করে, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর বিদ্বেষ কারখানা চালু করে পুতিন রাশিয়ার সমস্ত মিডিয়াকে ক্রেমলিনের রক্ষিতা বানিয়েছেন যেন।
প্রধান বিরোধী নেতাদের একজনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছেন; আরেকজনকে কারাগারে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন; অভিযোগ নিহতদের পরিবারগুলোর। ফলে বিরোধিতা শূন্য খালি মাঠে একের পর এক গোল দিয়ে চলেছেন তিনি। সংবিধানে পরপর প্রেসিডেন্ট পদে থাকার বাধা টপকাতে মাঝে পুতুল এক প্রেসিডেন্ট বানিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন; কিন্তু এখন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী; রুপকল্প ২০৩০-৩৬; যতদিন আয়ু তার ততদিন স্ট্যালিন তিনি। রুশ সাংবাদিকদের "প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছির আসরে" একটাই রব, পুতিনই পারেন, পুতিনই পারবেন।
নির্বাচনে পশ্চিমা পর্যবেক্ষক ঢুকতে দেননি তিনি; নিজের পছন্দের চীন-ভারত-বেলারুশ-সৌদি আরব-উগান্ডার পর্যবেক্ষক নিয়ে সাজিয়েছিলেন গণতন্ত্র উতসব; নির্বাচনের গায়ে হলুদ ও বিবাহ মন্ডপ। পুতিনের অনুপ্রেরণার উতস জোসেফ স্ট্যালিনও নির্বাচনকে এরকম আনন্দঘন করে তুলতে জানতেন।
আশা রাখি পুতিনের হাত ধরে পথ হারাবে না নতুন রাশিয়া। জয় পুতিন, জয় স্ট্যালিন!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন