প্রথম আলো হচ্ছে আগের কালের মহল্লার সংস্কৃতিমনা ও ক্রীড়ামোদি বড় ভাইয়ের মতো। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী থেকে ফুটবল ম্যাচ, পুজো থেকে ইদ পুনর্মিলনী সবকিছুর আয়োজক সে। মহল্লার কারা সংস্কৃতি কিংবা ক্রীড়া তারকা হবে; তা নির্ধারণ করতেন ঐ বড় ভাই। এইভাবে একটি মহল্লার সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ নির্মাণের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ঐ বড় ভাই।
কে সাহিত্যিক হিসেবে সৃজনশীল ও মননশীল শাখার সেরা দশে থাকবে; তা ঠিক করে দেয় প্রথম আলো। কে ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম পার্থ হবে; তা ঠিক করে দেয় প্রথম আলো।
প্রথম আলো তার শৈশব থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার হয়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তাই উপসম্পাদকীয় শাখায় অধ্যাপক, সচিব, রাষ্ট্রদূত, জেনারেল, এনজিও নির্বাহী প্রধান, সংস্কৃতি মামা-খালাদের একটি অভিজাত বৈঠকখানা নির্মাণ তার কল্পনা। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বাম দল করতেন। বাম দলের লোকেরা দেখবেন আজও টকশোতে সবচেয়ে পরিপাটি পোশাকে হাজির হন। মাথায় চুল থাকুক বা না থাকুক; তা আঁচড়ে; হাতের নখ সুন্দর করে কেটে, ঝকঝকে করে দাঁত মেজে তারা যে কোনো সভা কিংবা টিভি সভায় আসেন। এর কারণ হচ্ছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের ছেলেরা বঙ্গভঙ্গের পর বৃটিশের ওপর ক্ষেপে গিয়ে বামপন্থী হয়ে যায়। তাদের অভিমান, জমিদার বাবা বৃটিশরাজকে এত তেলাঞ্জলি দেওয়ার পরেও কেন বঙ্গভঙ্গ করেছে।
প্রথম আলো তিনটি জনস্বার্থে প্রতিবেদন ছেপে চতুর্থ প্রতিবেদনে জনগণকে শেখায় কাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে; কাকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে হবে। যে কারণে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত এমনকি হালের বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবী; কেউই প্রথম আলোকে শতভাগ পছন্দ করে উঠতে পারে না।
প্রথম আলো নিজেকে কিং মেকার হিসেবে দেখতে চায়। তাই তো সে ‘সিক দ্য ট্রুথ অ্যান্ড রিপোর্ট ইট’, এই সাংবাদিকতা আচরণবিধিতে আটকে না থেকে; ‘মেক দ্য ট্রুথ এন্ড পপুলারাইজ ইট’ নীতি তৈরি করেছে নিজের মতো করে।
চিরস্থায়ী জমিদারি ব্যবস্থা অবসানের কারণে সহমত-রহমত-শিবব্রত-শরিয়ত নতুন জমিদার হওয়ার লক্ষ্যে রাজনীতিতে লেগে থাকলে; প্রথম আলো আপ্রাণ চেষ্টা করে অধ্যাপক, সচিব, রাষ্ট্রদূত, জেনারেল, এনজিও নির্বাহী প্রধান, সংস্কৃতি মামা-খালাদের নিয়ে তার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িটি অক্ষুণ্ণ রাখতে।
এ কারণে তাকে কখনও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এমনকি হাসিনার জন্মদিনে প্রথম পাতাটা ভরে ফেলতে হয় ছবিতে আর শতবর্ষ কামাল জাতীয় কবিতে। আবার তাকে জিয়া ও খালেদার ছবি নিয়েও পাজল মেলাতে হয়; কখনও বা ড. ইউনূসের নোবেল বিজয়ে জাতির বুকের ছাতা ফুলে ৫৬ ইঞ্চি হয়ে যাওয়া দেখাতে হয়। এসবই করতে হয় টিকে থাকতে। প্রথম আলোর জমজ ভাই ডেইলি স্টারেরও রয়েছে এমন ছাতা হাতে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা ভারসাম্য রক্ষার জীবন। তারও রয়েছে শেকসপিয়ারের বৈঠকখানা জুড়ে এংলো স্যাক্সন ভাষায় দুর্বোধ্য ইংরেজিতে পোস্ট এডিটোরিয়াল লেখা সিভিল সোসাইটির লর্ড ও ব্যারন তৈরির সাধ। ঐ যে যারা প্রথম আলোর ঠাকুর বাড়ির বৈঠকখানার বাবু, তারা সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালুর প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিয়ে জাতিকে ইংরেজিতে দুর্বল করে নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেই ইংলিশ ভিংলিশ বেবি সিটিঙের জন্য মাহফুজ আনাম গড়ে তুলেছেন এই ডিজনিল্যান্ড। এইখানে ভি এস নইপল, অরুন্ধতী রায়, শাশি থারুর হবার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেংলিশ শিশুরা গল্প-কবিতা ও প্রবন্ধ লেখে। এসবই নির্দোষ স্বপ্নের শিশুপার্ক।
মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম সবচেয়ে গোছানো সবচেয়ে পেশাদার সংবাদ ও অভিমত প্রকাশ করে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অতীতে আইসিএস কিংবা সিএসপি পাবনায় বদলী হয়ে এসে ছেলেকে স্থানীয় জেলা স্কুলে ভর্তি করলে; ছেলেটি যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠত শহরময়।
প্রথম আলোর বৈঠকখানায় দুপুরবেলা নক্সী মাটির সানকিতে নানারকম ভর্তা খেয়ে তারপর চোখ মুদে বন্যাদির রবীন্দ্র সংগীত শোনার যে আসর, সোফায় নানা জ্যামিতিক ঢঙ্গে বসে থাকা শুল্ক ও সাহিত্য, ব্যাংকার ও সাহিত্য, ফতুয়া পরা সংস্কৃতি মামা, গলায় মাটির অলংকার পরা এনজিও আপা; এই আলোকিত আড্ডায় নেমন্তন্ন পেতে ‘উনি আমাদের লোক, উনি আমাদের লোক নন’ এমন ফিল্টার রয়েছে। সম্মুখ সমরে নয়, কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ তৈরিতে ভূমিকা থাকলে; এরপর মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে ঢাকায় অভিজাত এলাকায় বাংলো দখল করে বসতে পারলে; মতি ভাই নিজেই সেই বাংলোতে গিয়ে দাওয়াত পৌঁছে দেন। দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সামলানোর জন্য রয়েছেন আনিসুল হক ভাই। তাকেই মঙ্গার দেশের বীরপ্রতীক তারামন বিবি কিংবা কিশোর মুক্তিযোদ্ধা লালুর বেদনা নিয়ে কেঁদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অ্যাম্বিয়ান্স তৈরি করতে হয় প্রথম আলোর পৃষ্ঠা জুড়ে।
আনন্দবাজার পত্রিকা যেমন লেখক তৈরি প্রকল্প, সংস্কৃতি নির্মাণ প্রকল্প, রুচি নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি বাঙালি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল; প্রথম আলো ঢাকায় একইরকম মহৎ উদ্দেশ্যে পথ হেঁটেছে। আনন্দ বাজারকে ছাড়িয়ে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের মতো মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার চালু করেছে। তারকা তৈরির কারখানা হিসেবে প্রথম আলো অদ্বিতীয়। এমন সব তারকা, যাদের চলচ্চিত্র ও নাটক সাধারণ দর্শক পছন্দ করে না; যাদের কোরিওগ্রাফি বহু ব্যবহারে জীর্ণ; যাদের সাজ পোশাক গুচ্চি ব্যাগের তিন নম্বর কপির মতো। কারণ দুই নম্বর কপিটি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে দেখা যায়। প্রথম কপিটি অস্কার বা গ্র্যামিতে দেখা যায়।
এই যে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের খেলাঘর, তা তাদের কমফোর্ট জোন; নিজেরাই একটি তারকা জগত তৈরি করে এ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মতি-মাহফুজ নভো থিয়েটার। এ নিয়ে আওয়ামীলীগ বিএনপি, জামায়াত, জুলাই বিপ্লবী, আঁতেল মিলেনিয়াল; সবার এত সমস্যা কীসে! ফোন করে একটা কলাম দিতে বললে তো সহাস্যবদনে জমা দিয়ে আসবে; জাফর ইকবালের কভিড টেস্টিং কিটে চেতনার লোক প্রমাণিত হলে; দাওয়াত পেয়ে বর্তে যাবে, মেরিল প্রথম আলোর দাওয়াত পেলে ফেসবুকে চেক ইন দেবে সবার আগে; প্রথম আলোর দাড়িয়াবান্দা খেলায় দাওয়াত না পেয়ে এর পেছনে লেগে পড়া অনুচিত।
প্রথম আলো ইতিহাসের ন্যারেটিভ নির্মাণে এগিয়ে থাকে; জুলাই বিপ্লবের তৃতীয় মাসে ঠিকই চারজন বিপ্লবীর লেখা ছেপেছে। এইরকম চারজনকে দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ন্যারেটিভ নির্মাণ করেছিল। সুশাসন ও গণতন্ত্রের ন্যারেটিভ তৈরির জন্য রয়েছেন আরো চারজন। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার ন্যারেটিভ নির্মাণের জন্য রয়েছেন চারজন। এই যে এত ন্যারেটিভ নির্মাণ; তা ঠিক কোন কাজে এসেছে গত আড়াই দশকে।
ইতিহাস নির্মাণ করে সাধারণ মানুষ; যারা আমাদের ধুলোমলিন চাখানার এরিস্টোটলের পাঠশালায় বসে নির্ধারণ করে বাংলাদেশের আগামীযাত্রা।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে আমি বরং উপভোগ করি, কাস্ট সিস্টেমের কল্পনার জাদুঘর হিসেবে। ফলাফলহীন অন্তঃসারশুন্য এলিটিজম চর্চার খেলনা প্রদর্শনী হিসেবে। থাকুক কিছু প্রাচীন আচরণ; আউটডেটেড চিন্তাধারা, আমাদের ডেড পোয়েটস সোসাইটি হয়ে কিংবা ডিরোজিও-র বেঙ্গল রেনেসাঁর আলোঘর হয়ে; যেখানে কিছু মোমের মূর্তি সাজানো রয়েছে ফাঁপা খ্যাতির অভিজ্ঞান হিসেবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন