শ্যামের বাঁশীতে কান পেতে রই

৯২ পঠিত ... ১৭:১০, অক্টোবর ১৯, ২০২৪

17 (20)

একজন দীর্ঘাঙ্গী সুদর্শন মানুষ ধীর পায়ে হেঁটে এসে আমার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসতেন। উনার জন্য চা রেডি থাকতো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুরু হতো তাঁর সঙ্গে অন্তহীন সংলাপ। আগারগাঁও-এর জাতীয় বেতার ভবনে যে গানের শিল্পীরাই আসতেন; তাদের কাছে কাংক্ষিত ছিলো উনার সুরে গান গাওয়া। কিন্তু সংগীত তৈরি তো স্বয়ংক্রিয় কারখানায় ক্যান্ডি তৈরি নয়। উনার মুড ভালো থাকলে অনুরোধ করতাম; মুড একটু মেঘে ঢাকা হলে উনাকে নিয়ে ক্যান্টিনে চলে যেতাম আমার পারপাসিভনেস উইদাউট আ পারপাস-এর  আড্ডায়। আমি জানতাম যতগুলো মানুষ এসে উনার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন; কোন বাদ্যযন্ত্রী এসে কোন উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুর ভাঁজবেন সামনে বসে; আমাদের বেতোফেন তখন হাসি হাসি মুখে স্টুডিওতে হেঁটে যাবেন গানে সুর সংযোজন করতে। হারমোনিয়ামের রিডে ঝড় ওঠে; সুজেয় শ্যাম মেতে ওঠেন সুরের সঙ্গে অভিসারে।

মাঝে মাঝেই অফিস শেষে রেড বাটন পানশালায় ঢুঁ মারতাম; সেখানে উনি আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। স্পেশাল একটা বসার ঘর ছিলো; সেখানে একটা হারমোনিয়াম রাখা ছিলো। সেই আড্ডায় সংগীত জগতের অনেক তারকাই আসতেন। কিন্তু উনার সামনে তারা বাধ্যগত ছাত্রের মতো বসে থাকতেন। উনি আমার সঙ্গে একা হলেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের টুকরো স্মৃতির গল্প বলতেন। আমি তখন ভোরের কাগজে ‘বিষণ্ণতার শহর’ লিখি; তাই মুক্তিযোদ্ধারা আমার কাছে যুদ্ধদিনের গল্প বলতেন; উনারা জানতেন; আমি ঠিকই এসব গল্প লিখবো পরম মায়ায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশীভাই বলেই কিনা জানিনা; উনার রসবোধ ছিলো প্রখর। প্রথম আলোতে আমি তখন ‘তির্যক রচনা’ শিরোনামে স্যাটায়ার লিখে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ধুয়ে দিতাম। এগুলো পড়ে উনি খুক খুক করে হাসতেন। আমাকে নিত্য নতুন উপাদান দিতেন।

প্রবাদপ্রতিম মুক্তিযোদ্ধা সংগীতকার হয়েও তিনি ছিলেন নৈর্ব্যক্তিক আর ক্রিটিক্যাল নাগরিক। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিকদের দায়ী করতেন; যারা সুযোগ পেয়েও দেশটাকে কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে না গড়ে; নতুন জমিদারির সামন্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়েছে। উনি দেশাত্মবোধক গান প্যারোডি করে গাইতেন। আমি হাসতে হাসতে বলতাম, এই প্যারোডি শুনে হাসলে সিভিল সার্ভিস রুল ভঙ্গ করার দায়ে আমার চাকরি চলে যাবে। উনি জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া দিয়া বলতেন, এই চাকরির চেয়ে তোমার জীবন অনেক বড়।

মাঝে মধ্যেই বিদেশী মন্ত্রীরা বাংলাদেশ ভ্রমণে এলে; কিংবা বিশেষ দিবসে অথবা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক আয়োজনের এসাইনমেন্ট এসে পড়তো। উনি হেসে বলতেন, ভালোই পেয়েছে তোমাকে; কিন্তু আমি আগেই বলে দিচ্ছি রিহার্সালে এসে কোন বড় কর্তা মাতবরি করলে কিন্তু আমি তা সহ্য করবো না। আমি আশ্বস্ত করতাম, এতো ভালো নাশতা দেবো যে খেয়ে সোফায় ঘুমিয়ে পড়বেন তারা।

দিনমান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বাইরে গিয়ে উনি আমাকে খুশিজয়েন্ট এগিয়ে দিতেন। শিল্পীদের জন্য ক্যান্টিনে আয়োজিত হতো খানা-খাজানা। সংগীত শিল্পী সুবীর নন্দী একদিন এসে বলেন, কি ব্যাপার সরকারি অফিসের নিয়ম কানুন বদলে গেলো নাকি; সবাই শুধু খাবার সাধছে। উনি শুধু হেসে বললেন, এইগুলি হইতেছে ওর লোকজনরে সারাদিন ধইরা রাখার টেকনিক। এইরকম ফচকে জীবনেও দেখি নাই।

আড্ডার উনি; আর সুরসংযোজন ও সংগীত পরিচালনার মুহূর্তের উনি; সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। শিল্পসৃষ্টিতে যে হাইসিরিয়াসনেস লাগে আবার কাজের ফাঁকে নিরন্তর এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট ডার্ক হিউমারের  এক্সচেঞ্জ হতে পারে; এই সোনালী গড়ের আপাদমস্তক শিল্পী ছিলেন। উনার সুখী শিল্পীজীবনের কোড ব্রেক করেছিলাম। উনার  স্ত্রী ডাক্তার ছিলেন, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে; তোমার মতো সিস্টার।’ হাসপাতালের দায়িত্বপালন শেষে বেতার ভবনে আসতেন উনাকে নিতে। আমি অফিসার ইন চার্জের দায়িত্বে থাকলে উনি আমার দপ্তরে এসে বসতেন। চা কিংবা কোমল পানীয় খেতেন। আবার কখনোবা উনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বৌদিকে সালাম জানিয়ে আসতাম। বৌদি বলতেন, যে রসের আড্ডা জমিয়েছো; তাতে তোমরা যে অফিস থেকে বাসায় ফেরো এইতো অনেক।

উনি সুযোগ পেলেই বলতেন, মাইয়ারা তোমারে ভালা পায়; এইজন্য সব কাজ সহজে হয়ে যায়। বড় বড় সাংস্কৃতিক আয়োজনে নারী শিল্পী ও কর্মকর্তারা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতেন। সেটা নিয়েই সারাক্ষণ দুষ্টুমি করতেন আমার সঙ্গে।

উনি খুবই ক্রিটিক্যাল আর্টিস্ট; শিল্পী তো তাই হবে; কিন্তু খানিকটা আমির খসরুর ঢং-এ রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নিতেন। উনাকে মঞ্চে বা সংসদ ভবনের সামনে সমবেত সংগীত আয়োজনে দাঁড়িয়ে গাইতে দেখে বোঝার উপায় নেই মনে মনে কি ভাবছেন তিনি। কিন্তু আমি তো জানি; এইসব কৌতুকপ্রদ দেশপ্রেমের লিপসার্ভিসে বৈষম্যবিধুর সমাজের কোন লাভ হয়না; এই ব্যাপারটা কি গভীরভাবে অনুভব করতেন উনি। এইজন্য রাজনীতিক ও আমলারা উনার সামনে সমঝে চলতেন। অনেকবার এমন হয়েছে; ফাইনাল রিহার্সালে কোন আধাখ্যাঁচড়া সংস্কৃতি জ্ঞানের বড় কর্তা ফাঁপা শিল্প সমালোচনা হাজির করলে; উনি এসে আমার কানে কানে  বলতেন, হয় ঐডারে বাইর করো; নাইলে আমি যাইতাছি। আমি তখন নয়া বড়  শিল্প সমালোচককে কঠিন জারগনে জটিল শিল্প বোঝানোর অভিনয় করতে করতে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতাম।

এই যে উনি আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন; আমি এতে মন খারাপ করিনি। কারণ শিল্প বিমুখ ঊষর সমাজের খেলনা সংস্কৃতি মামাদের অর্থহীন কোলাহল ছেড়ে একজন সুরের মায়েস্ত্রো জীবন নদীর ওপারে সোনালী যুগের মায়েস্ত্রোদের আড্ডায় যোগ দিলে; ব্যাক্কাস নিজে এসে নিশ্চয়ই তাঁকে স্বাগত জানাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর সুর করা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানটি একাই তো তাঁকে অমরতার আয়োজন করেছে। নিজ হাতে ইতিহাস নির্মাণ করেন যিনি, ইতিহাস সব সময় তাকে ভালোবেসে কাছে রাখে।

৯২ পঠিত ... ১৭:১০, অক্টোবর ১৯, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top