যে সময়ের কথা বলছি তখন হংকং-এর দরজা সবার জন্য খোলা। বাংলাদেশের পাসপোর্টে তখন পোর্ট এন্ট্রি। ইমিগ্রেশানে আপনাকে নামধাম কি এ জাতীয় কিছু নিয়মরক্ষার প্রশ্ন করবে, তারপর ২১ দিনের ভিসা দিয়ে দিবে।
আপনাকে থাকতে দিলে তখন হংকং-এর লাভ। এর কারণ অর্থনীতি, ইত্যাদি; এবং হংকং-এ অবৈধভাবে থাকা বেশ কঠিন। কাজ ছাড়া থাকতে পারবেন না, খামাখা ঢুকে করবেনটা কি।
এক ধরণের উদার নীতি সবক্ষেত্রে অনেকদিন ছিল। একটু পরিষ্কার করি। লিবিয়াতে প্রশিক্ষন-প্রাপ্ত একজন মাওলানা তখন ছিলেন কাউলুন মসজিদের ইমাম। মুয়াম্মার গাদ্দাফি তখন লিবিয়াতে ক্ষমতায়। এটা নিয়ে কারো কোন সমস্যা ছিল না। (এখন কিন্তু পরিস্হিতি কেমন আমি জানি না)
যেদিনের কথা বলছি সেদিন সকালে আমার অফিস। আমি চীনের শেনযেনে ঘুরতে গিয়েছি। প্রায় শনিবার রাতে যাই, কাশগরের কিছু মানুষ এসে একটা রেস্তোরাঁ দিয়েছেন, ওইখানে খাই। বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি, সোমবার সকালে আবার পায়ে হেঁটে হংকং-এ ফেরা। আমি একা না; অনেকেই তখন এটা করতেন।
হংকং ইমিগ্রেশান সাধারণত খুব দ্রুত কাজ করে। আজকে দেরি হচ্ছে কেন জানি না। উকি দিলাম। সামনে বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট। কঠিন প্রশ্নোত্তর চলছে।
বলে রাখা ভাল হংকং-এর সাধারণ চীনাদের ইংরেজি উচ্চারণ বোঝা বেশ কষ্টের। তার উপর আপনার নিজের ইংরেজি যদি ভাল না হয় তাহলে একদম মরার উপর খাড়ার ঘা।
উদাহরণ দেই- “উই উইল হ্যাভ এন ইরেকশান”; এটার মানে হল— সামনে নির্বাচন। ইংরেজি এল-কে ওনারা ‘আর’ উচ্চারণ করেন।
তো এইদিকে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর বাংলাদেশি ভাই হাত পা নেড়ে কিছু বলছেন। কান খাড়া করে শুনে আলাপটা নীচে বাঙলায় অনুবাদ করে দিলাম।
ইমিগ্রেশান অফিসার: আপনার দেশের নাম তাহলে কি?
বাংলাদেশি ভাই: আমার দেশের নাম নোয়াখালী।
ইমিগ্রেশান অফিসার: ওহ, ঠিক আছে।
অফিসার কম্পিউটারে কিছু সময় টিপাটিপি করলেন। তারপর বেশ অবাক হয়ে বাংলাদেশি ভাইকে বললেন, 'সিস্টেমে তো নোয়াখালী বলে কোন দেশ পাচ্ছি না। এটা কোন মহাদেশে? আফ্রিকা নাকি?'
বাংলাদেশি ভাই মাথা নাড়লেন। 'হ্যাঁ, নোয়াখালী আফ্রিকা মহাদেশে।'
এর মধ্যে ইমিগ্রেশানের অফিসারের খেয়াল হল, উনি বাংলাদেশি ভাইয়ের পাসপোর্টের কাভার পেইজের দিকে তাকালেন। আমার মনে হয় আর্কিমিডিস বাথটাবে ইউরেকা বলার আগেও এত খুশি হন নাই।
এবার উনি বাংলাদেশি ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন উনি কতদিন হংকং-এ থাকতে চান।
জবাবে বাংলাদেশি ভাই জানালেন উনি বআট থেকে মালপত্র বের করে সবাইকে দিবেন। হংকং-এ অনেক বআট। উনি বআট ভালবাসেন।
আমার তখন মনে হল ওনারা একজন আরেকজনের কথা বুঝতে পারছেন না। পরের আলাপে আরও পরিষ্কার হল।
ইমিগ্রেশান অফিসার: আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি কি কোন ড্রাগস নেন?
বাংলাদেশি ভাই: হ্যাঁ, আমি সবসময় ড্রাগস নেই। আমার ফ্যামিলির সবাই ড্রাগস নেয়।
এ ধরণের পরিস্থিতির জন্য আমার একটা নীতি আছে— কেউ স্প্রাইট মনে করে সালফিউরিক এসিড না খাওয়া পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
কিন্তু পরের প্রশ্নে মনে হল সিচুয়েশন সালফিউরিক এসিডের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ইমিগ্রেশান অফিসার: আপনার সাথে কি কোন ড্রাগস আছে?
বাংলাদেশি ভাই: হ্যাঁ। আমার মা আমাকে একটা ড্রাগস দিয়েছেন যেটা হংকং-এ ঢুকে আমার চাচাকে দিতে হবে।
আমি তখন ভাবছি অন্য জিনিস। এর পর আরো অনেক প্রশ্ন আসবে। আরো অনেকক্ষণ পরে ওনাকে অন্য একটা কামড়ায় নিয়ে গিয়ে তল্লাশি করা হবে। আমি নিশ্চিত যে আমার এই দেশি ভাই পকেটে করে বাংলাদেশ থেকে কয়েক প্যাকেট প্যারাসিটেমল, কাশির ট্যাবলেট ইত্যাদি নিয়ে আসছেন যেগুলাকে উনি সগর্বে, সদর্পে ড্রাগস ডাকছেন।
এর মধ্যে আমার টানা কিছু মূল্যবান সময় ‘বআট’ খেয়ে দিবে। অন্য লাইনে যারা আমার সাথে দাড়িয়েছিলেন তারা মনে হয়ে এখন নিজ নিজ বাসায় কফি খাচ্ছেন, আর আমি...
আপনি কি বলতে পারবেন আমি যদি এই আলাপে যোগ দেই তাহলে কি হবে? আমি কিন্তু খুব ভালমত জানি।
আমার মুখ থেকে একটা বাঙলা শব্দ মাটিতে পরার আগেই বাংলাদেশি ভাই আমাকে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে নিজের ভাই (my deshi brother) হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
ইমিগ্রেশন দুজনের বাবার নামের পার্থক্য টের পাবে দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে এবং এরপর ওনারা আমাকে আদম ব্যাবসায়ী ভাবতে শুরু করবেন। জিনিষটা পরিস্কার করতে লাগবে দুই থেকে তিন ঘন্টা। এটা আমার সাথে আগে একবার হয়েছে। আমার সালফিউরিক এসিড নীতির কারণ এইটা।
মিনিট দশেক এই অদ্ভুত আলাপ চলল। ড্রাগস, নোয়াখালী কেন দেশ, বআট কি, বআট কারা, বআট কোথায় থাকে— এইসব।
আমি আর পারলাম না। পা বাড়িয়ে প্রথমেই বাংলায় দেশী ভাইকে বললাম, আপনি আল্লাহর ওয়াস্তে মুখ খুলবেন না।
কাজ হলো না। আমার মুখে বাঙলা শোনার সাথে সাথে উনি বলতে নিলেন যে আমি ওনার দেশি...
আমি একটা ধমক দিয়ে বাংলাদেশি ভাইকে থামালাম। তারপর ইমিগ্রেশনের ওনাকে বললাম যে ড্রাগস বলতে এই লোক সম্ভবত ঔষধ ভাবছে।
মুহুর্তের মধ্যে জানা গেল ‘ড্রাগস’ হচ্ছে নাপা আর ফেনারগন ইত্যাদি এবং আমরা সবাই বোধিপ্রাপ্ত হলাম।
বিদায় বেলা ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে অপার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেশে কি কোন জাতিগত সমস্যা আছে নাকি? নোয়াখালী কি স্বাধীনতা চায় বা এরকম কিছু? উনি নিজের দেশের নাম বললেন নোয়াখালী...
আমি জবাবে হাসলাম, যেটার মানে যেকোন কিছু হতে পারে।
বের হয়ে দেখি বাংলাদেশী ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এবার আমার কৌতুহল মেটানোর পালা।
এই ভাই যেভাবে বলেছেন যে উনি বআটে কাজ করতে চান, উনি আসলে এখানে কি করতে এসেছেন এ প্রশ্ন আমাকে প্রায় কুরেকুরে খাচ্ছিল।
আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম উনি হংকং-এ কেন এসেছেন।
জবাবে উনি বললেন, বআট। উনি বআটে কাজ করবেন।
আমি বললাম, ভাই বআট কি এটা তো ঠিক বুঝলাম না।
একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে উনি জানালেন ইংরেজীতে নৌকাকে বআট বলে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন