একটু চালাক চাষী না হলে আসলে মোহর পাওয়া যায় না

১৬০০ পঠিত ... ১৮:০৪, অক্টোবর ০৪, ২০২০

অনেক কাল আগে এক দেশে বাস করত গরীব এক চাষী। নিজের বলতে জমি-জিরাত কিছুই তার ছিল না। সারাদিন ধরে পরের জমি চাষ করে যা কিছু পাওয়া যেত তাই দিয়ে চলত চাষীর সংসার। সংসার বলতে ছিল সে নিজে আর তার বউ।

একদিন জমি চাষ করতে মাঠে গিয়ে একটা আজব ঘটনা ঘটল। একটা ক্ষেত চষে সে প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় শক্ত একটা কিসে লেগে যেন লাঙ্গলের ফলাটা ঠক করে শব্দ হল আর লোহার ফলাটা বুঝি ভেঙেই গেল।

বিরক্ত চাষী উপুড় হয়ে দেখতে লাগল, না ভাঙেনি। আবার চাষ আরম্ভ করতে গিয়ে তার খেয়াল হল মাটির তলায় শক্ত জিনিসটা কি দেখতে হবে। দোষ নেই দেখতে। অনেক সময় অনেক জিনিস পাওয়া যায় মাটির তলায়।

আবার উপুড় হয়ে দু'হাতে মাটি সরিয়ে সে দেখতে লাগল। খানিকটা মাটি সরাতেই মনে হল একটা তামার হাঁড়ির ঢাকনার মত দেখাচ্ছে জিনিসটা। কৌতূহল তার বেড়ে উঠল। সে সেখানে বসে বসে আর খানিকটা মাটি সরিয়ে ফেলল । মাটি সরিয়ে দেখতে পেল সত্যিই একটা তামার হাঁড়ির ঢাকনা। ময়লা পড়া ঢাকনা তুলতেই তার চক্ষুস্থির। হাড়ি ভর্তি সোনার মোহর। পড়ন্ত রোদে ঝকঝক করে উঠল মোহরগুলো।

ঢাকনাটা লাগিয়ে তাড়াতাড়ি আবার মাটি চাপা দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। বাকি জমিটা সে বেশ পরিপাটি করে অনেক্ষণ ধরে চাষ করে। চাষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল । মাঠের কোথাও কেউ নেই। সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেছে দিনের কাজ কর্ম সেরে।

সে ধীরে ধীরে উঠে হাঁড়িটা কাপড়-ঢাকা দিয়ে বাড়ি নিয়ে এল । পথে কারো সঙ্গে দেখা হল না। হঠাৎ আজ একটা হাঁড়ি নিয়ে চাষীকে বাড়ি ঢুকতে দেখেই চাষী বউ এগিয়ে এল দেখতে।

চাষী বউকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলল, চুপ চুপ! আগে দরোজাটা বন্ধ করে এস, পরে দেখবে হাঁড়ির ভেতর কি এনেছি। এতদিনে খোদা আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। দরোজায় খিল দিয়ে এসে চাষী বউ দেখল, হাঁড়ি ভর্তি মোহর। আনন্দ সে প্রায় চিৎকার করেই উঠেছিল। কিন্তু চাষী তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল। বলল, এখন এ জিনিস লুকিয়ে রাখাই হল বড় কাজ। কোথায় লুকিয়ে রাখি বলত?

বউ বলল, কেন, ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে রাখলেই চলবে।

চাষী ভেবে দেখল পরামর্শটা মন্দ নয়। ঘরের ভেতর মাটির তলায় রাখলে কেউ আর টের পাবে না। ওখান থেকে একটা দুটো নিয়ে ধীরে সুস্থে খরচ করা যাবে। রাতারাতি খরচ করতে গেলেই লোকে সন্দেহ করবে। তারপরেই সব জানাজানি হয়ে যাবে। 

দু’জনে মিলে মাটি খুঁড়ে তারা মোহরের হাঁড়িটা রেখে দিল ঘরের মেঝেয় । রেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। বউকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে চাষী বল, কাউকে কিছু বলবে না কিন্তু। বললেই সর্বনাশ হবে। রাজার তোষাখানায় গিয়ে সব কিছু জমা দিয়ে আসতে হবে। বউ তাকে অভয় দিয়ে বলল, আমার জন্য তুমি কিচ্ছু ভেব না। তুমি পুরুষ মানুষ বাইরে নানা জায়গায় যাবে, নানাজনের সাথে কথা বলবে । তুমি বরং হুঁশিয়ার থেকো।

সেদিন রাত্রে শুয়ে বেচারা চাষীর আর ঘুম আসছিল না। সে কেবলই এ পাশ ওপাশ করে কাটাল অনেকক্ষণ, কিন্তু ঘুম এল না চোখে। কেবলই মনে হচ্ছে, মোহরগুলোর কথা কেউ না কেউ জেনে ফেলবে। অবশ্যি সে আর তার বউ ছাড়া কেউ ব্যাপারটি জানেনা। কিন্তু তার বউকে দিয়েও বিশ্বাস নেই। সেই হয়তো পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে সব কিছু ফাঁস করে দেবে। হোক না ঘরের বউ, এসব ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস না করাই ভাল । তাছাড়া তার বউটি যে খুব গল্পের, তা পাড়ার সবাই জানে। 

চাষী এ সব কথা ভাবছে আর ওদিকে তার বউয়ের নাকডাকা শুরু হয়েছে। চাষী তখন আস্তে উঠে গিয়ে মোহরের হাঁড়িটা তুলে বাইরে নিয়ে গেল । বাইরে একটা খড়ের গাদার নিচে গর্ত করে তার ভেতরে লুকিয়ে রাখল। রেখে নিশ্চিত মনে এসে শুয়ে পড়ল। এবার তার ঘুম আসতে একটুও দেরি হল না।

চাষীর অনুমান একটুও মিথ্যে হয়নি। পরের দিন খুব ভোরে চাষীর বউ কূয়োতলায় গিয়েছে পানি আনতে। গিয়ে দেখল, তার আগেই পাড়ার আরো দুটি বউ পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। সে তাদের থামিয়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি বলল, অতি আপন জেনে তোমাদের একটা কথা বলছি, কিন্তু কাউকে তা বলতে পারবে না। তোমরা আমার আপনজন, তাই শুধু তোমাদের কাছেই বলছি। এই বলে তার স্বামীর মোহর পাওয়ার ঘটনাটা আগাগোড়া খুলে তাদের বলল। তারা চলে গেলে কূয়োতলায় এল আরো দু'তিনজন পাড়াপড়শীর বউ। চাষী বউ তাদের কাছেও খবরটা বলতে কসুর করল না। বলে আবার হুঁশিয়ার করে দিল, কাউকে না বলতে।

কিন্তু হুশিয়ার করলে কি হবে- সেদিন বিকেলেই চাষী বুঝতে পারল পাড়ার কেউ বাকি নেই কথাটা জানতে। সেদিনই রাত্রে জমির মালিক এসে তার সঙ্গে দেখা করল। দেখা করে বলল, তোমার উচিৎ হয়নি এত বড় একটা ব্যাপার আমার কাছে এভাবে গোপন রাখা। শত হলেও জমিটা যে আমার, একথা ভুললে কেন?

চাষী অবাক হবার ভান করে বলল, তুমি কিসের কথা বলছ কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। জমি চাষ করেই রেখেছি। অনেক খাটুনি খেটেছি এবার তোমার জমি চাষ করতে।

আমি সে কথা বলতে আসিনি। এসেছি আসল কথা বলতে। আমার জমিতে পাওয়া মোহর তুমি একা ভোগ করে কোন আইনে? তোমার কাজ জমি চাষ করা, জমির ওপরে নীচে যা কিছু রয়েছে সবই আমার।

এ নিয়ে দুজনে খুব খানিক বাদানুবাদ হল। অবশেসে জমির মালিক বলল, ঠিক আছে, তুমি রাখ অর্ধেক মোহর আর বাকি অর্ধেক দাও আমাকে। তাতে তোমার আপত্তি হবে না আশা করি? 

চাষী বলল, তুমি এমন আজগুবী কথা শুনে এলে যে আমি মোহর পেয়েছি?

কেন, তোমার বউই ত বলেছে এ খবর । সে কি মিথ্যে বলতে পারে? মিথ্যে বলে কি  লাভ শুনি? 

বউয়ের কথা উঠতেই চাষী বলল, তার কথা ছেড়ে দাও, কিছু দিন থেকে তার মাথা ঠিক নেই। রাতদিন শুধু আজেবাজে বকে। তার কথা আমরা বিশ্বাস করি না।

তা বিশ্বাস কর, চাই না কর, তুমি মোহর পেয়েছ তা জানি। ভাল কথায় না দাওতো এ মোহর তোমাকেও ভোগ করতে দেব না। দু'দিন অপেক্ষা করে কাজীর কাছে গিয়ে সব ফাঁক করে দিয়ে আসব। এ বলে শাসিয়ে জমির মালিক বেরিয়ে গেল ।  

পরের দিন ভোর না হতেই চাষী বেরিয়ে গেল বাজারের দিকে। বাজারে গিয়ে এক দোকান থেকে নিল কয়েক খানা রুটি। তারপর মাছের দোকানে গিয়ে কিনল কয়েকটি জ্যান্ত মাছ-কই, মাগুর, শিং। সে সব নিয়ে ঢুকল গিয়ে গায়ের পাশেই এক জঙ্গলে। জঙ্গলের ভেতর এখানে মাছ আর রুটিগুলো ফেলে রেখে এল। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে পেল একটি খরগোস। সেটাকেও মেরে একটি সুতোয় বেঁধে জঙ্গলের নালায় ডুবিয়ে রেখে এল। বাড়িতে চাষী যখন ফিরে এল, বউ তখন সবে বিছানা ছেড়ে উঠেছে।

চাষী তাকে ডেকে বলল, একটি ভারী মজার ব্যাপার শুনে এলাম পথে। কাল রাত্রিরে নাকি রুটি বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে পানির বদলে রুটি পড়েছে। শুধু তাই নয়, আজকাল নাকি রাত্রিরে মাছেরা সব গাছে উঠে ঘুমায়।

তাহলে তুমি তো রাস্তা থেকেই এলে, কিন্তু একটি রুটিও তো কুড়িয়ে পাওনি দেখছি।

বেশ তো তুমিও চল না ।

দাঁড়াও, আমি একটি ঝুড়ি নিয়ে আসছি। এই বলে চাষী বউ মস্ত ঝুড়ি বের করে আনল ঘর থেকে।

জঙ্গলে গিয়ে চাষী বউকে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিয়ে এল আসল জায়গায়। সেখানে চা বউ প্রথমে পেল কয়েকটি রুটি। তারপর পেল মাছ। সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে মনের আনন্দে যখন বাড়ি ফিরল তখন নালার কাছে চাষী বলল– দাঁড়াও একটু। কাল সন্ধাবেলা একটি বড়শি ফেলে রেখেছিলাম নালা পানিতে, একবার দেখতে হবে তাতে মাছ ধরছে কিনা।

এই বলে সুতোটা ধরে টানতেই উঠে এল একটি খরগোস। চাষী বলে উঠল, আজকাল সব দেখছি আজব ব্যাপার। মাছের বদলে বড়শীতে আটকেছে খরগোস।

চাষীর বউ বলল- হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। সবই দেখছি তাজ্জব ব্যাপার।

এদিকে এক কান দু'কান করে চাষীর মোহর পাওয়ার খবরটি কাজীর কানেও গিয়ে পৌঁছেছে। কাজী তাই সমন পাঠিয়েছেন চাষী আর চাষীর বউয়ের নামে।  

চাষী এর জন্য মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। কাজীর দরবারে গিয়ে সে মোহর পাওয়ার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলল, এসব মিথ্যা কথা হুজুর। মোহর কখনো আমি চোখেও দেখিনি।

কাজী বললেন, তুমি অস্বীকার করলে হবে কেন। তোমার স্ত্রীকে বলেছে সব কিছু। তোমার নামে নিশ্চয়ই সে মিথ্যে কথা বলেনি? 

চাষী বলে উঠল, আমার স্ত্রী বলেছে? তাই বলুন, কিছু দিন থেকে ওর মাথা ঠিক নেই হুজুর। ও একটা পাগল।

চাষীর মুখে একথা শুনে একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল চাষী বউ বলল, মুখপোড়া, আমি পাগল হব কোন দুঃখে। তুই তো পাগল । পাসনি তুই এক ঘড়া ভর্তি মোহর?

চাষী বলল, কখন পেলাম?  

কখন পেলে? মনে করেছ আমি সব ভুলে গেছি। কেন, যেদিন ঝড় বৃষ্টি হল, সেদিন আমরা জঙ্গলে গিয়ে রুটি কুড়িয়ে পেলাম, জঙ্গলে মাছ ধরলাম, তার দু'দিন আগেই তো তুমি এক ঘড়া মোহর পেলে। জঙ্গল থেকে ফেরবার সময় তুমি বড়শিতে একটি খরগোশ পেয়েছিলে। এখন সে সব ভুলে গেলে চলবে কেন?

ঢাষী বলল, ঐ শুনুন হুজুর। শুনলেন তো পাগলের মুখে সব আজব কথা?

কাজী তার দরবারের সবাই হাসতে লাগল চাষী বউয়ের কথা শুনে। হাসি থামলে কাজী বললেন, বউটার মাথায় সত্যিই গোলমাল আছে। তা না হলে কেউ এমন কথা বলতে পারে?

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, বেশ, পেয়েই যদি থাকে তবে সে মোহর রেখেছে কোথায়?

চাষীর বউ বলল- হ্যা, তাই বলুন। রেখেছে ঘরের মেঝেয়। মাটি খুঁড়ে সেখানে মোহরগুলো পেলেই তো বোঝা যাবে আমি পাগল নই, ওই মুখপোড়াই মিথ্যেবাদী।

কাজীর হুকুমে তখখনি চাষীর ঘরের মেঝের মাটি সরিয়ে দেখা হল, কিন্তু মোহরের নাম গন্ধও সেখানে পাওয়া গেল না।

সবাই মনে করল, চাষী বউ সত্যি একটা পাগল।

 

[মোহাম্মদ নাসির আলী: বাংলাদেশের একজন শিশুসাহিত্যিক। তিনি সাধারণত ছোটদের জন্য লিখেছেন এবং সাহিত্যচর্চায় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।]

১৬০০ পঠিত ... ১৮:০৪, অক্টোবর ০৪, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top