স্কুল থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল, ছোট্ট একটি গলির ভিতর দিয়ে আসছিল খোকা, অন্ধকার হয়ে এসেছে, গলির ভেতরটাতে আরও অন্ধকার, এদিকটায় গ্যাস বাতি জ্বলে, আর সেই গ্যাসের আবছা আলোয় পথ চিনে যেতে বেশ অসুবিধে।
এ গলির মাঝামাঝি এসেই হঠাৎ কি একটা শব্দ এল তার কানে, থমকে দাঁড়ায় খোকা। এক মিনিট মাত্র, তার পরই একটা অসম্ভব চিন্তায় বুকটা তার ধড়াস করে উঠল, ভয়ে হাঁটু দুটো কাঁপছে তার। সে ভাবতে লাগল, কি করবে, কি তার করা উচিত? ইতস্তত করতে লাগল খোকা। কিন্তু বেশিক্ষণ এই অবস্থা রইল না। ধীরে ধীরে মনে সাহস ফিরিয়ে আনল সে। তার মনে হল এই মুহূর্তে সে যেন একটা বিরাট কর্তব্য করতে যাচ্ছে। অসীম সাহসে বুক বেঁধে সে পা টিপে টিপে এগুলো। পাশেই একটা পুরনো একতলা বাড়ি। বাড়িখানার প্রায় ভেঙে-পড়ার দশা। তা হলেও খোকা বেশ বুঝতে পারল ওর ভেতরে লোক থাকে। একটু ভেতরের দিকের একটা কামরাতে টিমটিমে বাতি জ্বলছে-তারই একটুখানি আলো এসে পড়েছে রাস্তার ওপর। খোকা পা টিপে টিপে সেই আলো লক্ষ্য করে এগুলো।
খুব সন্তর্পণে পা ফেলে খোকা এসে দাঁড়াল জানালার কাছে। জানালাটা বন্ধ।।
কিন্তু কাঠের ফাঁক দিয়ে চোখ রাখলে ঘরের ভেতরটা বেশ দেখা যায়। একবার দৃষ্টি দিয়েই শুকিয়ে উঠল খোকার অন্তরাত্মা।
দেখল ঘরের ভেতর একপাশে একটা ভাঙা লণ্ঠন জ্বলছে। আবছা আলোয় দশ বারো জন লোক বসে আছে। তাদের সবাইকে ভাল করে দেখা যায় না। তবু যা দেখলে তাতেই খোকার প্রাণ যায় যায়।
একটা লোক হতভম্বের মতো ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে বসে আছে আর একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে সামনে, হাতে রিভলবার। বাকি লোকগুলো ওকে ঘিরে রয়েছে।
চেয়ারে উপবিষ্ট লোকটা বলছে, না, ও কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
রিভলভারধারী কঠিন দৃঢ় কণ্ঠে বললে, ‘করতেই হবে তোমাকে। নইলে দেখতেই তো পাচ্ছ—-!’
রিভলভারটা একাবর নাড়াল সে।
‘একটুও শব্দ হবে না, একেবারে আধুনিক যন্ত্র, সামান্য একটু হিস্। তার পরেই ব্যস।’
কিন্তু লোকটার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না, মনের বল তারও কম নয়। নিরুত্তর বসে রইল লোকটা। তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অস্ত্রধারী আবার বললে, ‘শোনো তেওয়ারী, আধঘণ্টা সময় দিলাম তোমাকে। এর মধ্যে মনস্থির করো। এই রইল কাগজ কলম। শুধু একটা সই, নইলে আধঘণ্টা পরে আত্মারাম আর খাঁচায় থাকবে না।’ - হঠাৎ চেতনা ফিরে এল খোকার।
আর মাত্র আধঘণ্টা। আর মাত্র আধঘন্টা। তার পরেই একটা প্রাণ ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে। খোকার মনের মধ্যে গেল হঠাৎ আলোর ঝরকানি। না, আর এখানে নয়, খোকা ভাবল। এস্তপদে নেমে এল সে জানালা থেকে।
পা টিপে টিপে গলি থেকে বেরিয়ে খোকা দিল এক দৌড়। এক দৌড়ে এসে পড়ল রাস্তার মোড়ে। বগলে বই চেপে সে ভাবতে লাগল, কি করবে এখন। কোথায় যাবে? খোকার মনে হল যেমন করেই হোক লোকটাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কেমন করে? স্কুলে থার্ড ক্লাসের ছাত্র সে। বয়স্ক লোক যদি হত, বন্ধুবান্ধবদের জুটিয়ে সে নিজেই উদ্ধার করত লোকটিকে। বড় রাস্তায় অনেক আলো। ভয় তার কেটে গেল অনেকটা। তার জায়গায় ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল সাহস। হ্যা, সাহস করে শুনতে হবে তাকে। এমন একটা কর্তব্য তাকে করতে হবে যা কতদিন ধরে সে কল্পনা করে এসেছে। চট করে তার মনে পড়ে গেল তার প্রিয় বইয়ের অতি পরিচিত মানুষগুলির কথা।
সত্যেন ঘোষ। ডিটেকটিভ সত্যেন ঘোষ হবার এইটেই সুযোগ। কিন্তু খোকা ভাবল সত্যেন ঘোষ তো বয়স্ক বুড়ো লোক। সে বরং তার সাগরেদ তরুণ সুব্রত হতে পারে। ঠিক। সে হল সুব্রত। শক্তিমান, বলিষ্ঠ নির্ভীক সুব্রত। কোনো চালাকি তার কাছে খাটে না। প্রত্যেকটা খুনী তার কাছে ধরা পড়ে। যারা পড়ে না তারা অসাধারণ। কিন্তু খোকাকে এবারে সে দুঃসাহসিক কাজের বিবরণ পড়াই নয়, এবার হাতে-কলমে এগুতে হবে। এতদিন সে বীরের কীর্তিকলাপের কাহিনী পড়েই এসেছে, এবার সে নিজেই বীর হবে।
কিন্তু এখন কি করা যায়। মাথায় তার বুদ্ধিও আসছে না। দীনেন রায়ের ব্লেক যদি এই অবস্থায় পড়তেন তা হলে কর্তব্য ঠিক করতে তাঁর এক মুহূর্তও দেরি হত না। অথচ সময় খুব কম। না, আর দেরি করা চলে না। মাত্র আধঘণ্টা সময়, তার মধ্যে আবার পাঁচ মিনিট ইতিমধ্যেই কেটে গেছে।
তাই তো। লোকটাকে বাঁচাতে হবে যে! সেই আধঘণ্টা কাটবার আগেই আচমকা হানা দিয়ে লোকটাকে বাঁচাতে হবে মৃত্যুর কবল থেকে।
সে ভাবতে লাগল সত্যেন ঘোষ এরকম অবস্থায় পড়লে কি করতেন। ভাবতে ভাবতে তার মনে হল এমন অবস্থায় তার কর্তব্য হচ্ছে একজন ইনসপেক্টার সঙ্গে করে সরাসরি ঘরে গিয়ে হানা দেওয়া।
ঠিক। কিন্তু ইনসপেক্টার কোথায় থাকেন, তাও যে তার জানা নাই।
পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটা লোক। খোকা ভাবল, সমস্ত ব্যাপারটা একে খুলে বলাটা কেমন হবে?
বিপদ আছে তাতে। এসব আনাড়ি লোক হয়তো চেঁচামেচি করে সব মাটি করে দেবে। টের পেয়ে পাখি ততক্ষণে উড়েই যাবে।
তবে হ্যা, ইনসপেক্টারের খোঁজটা ওর কাছ থেকে নেওয়া যেতে পারে। চট করে বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়।
লোকটার সামনে গিয়ে সে খুব বুদ্ধিমানের মতো জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা এখন কয়টা বাজে বলতে পারেন?
লোকটা একটু অবাক হলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘সাতটা।’
খোকা একটু ভাবল। ‘আচ্ছা, পুলিশের ইনসপেক্টার কোথায় থাকেন বলতে পারেন?’
‘কেন খোকা! পুলিশের ইনসপেক্টার দিয়ে কি করবে?’ লোকটার কথায় খোকার রাগ হয় খুব।
খোকা ভাবে : লোকটা পেয়েছে কি তাকে, কতবড় একটা কাজ করতে বেরিয়েছে। সে যদি সফল হয় তা হলে কালকের ‘প্রভাতী’ সংবাদপত্রগুলিতে বড় বড় অক্ষরে তার কীর্তিকথা প্রচার করা হবে।
লোকটার কথার জবাবে খোকা বললে, ‘আমার দরকার। কোনো ইনসপেক্টারের ঠিকানা জানা থাকলে দয়া করে বলুন।’
ভদ্রলোক একটুখানি চুপ করে থেকে তাকে বললেন, ‘কেন, তুমি থানায় গেলে তো পার।’
কথাটা ঠিক মনে ধরল তার। থানায় রওয়ানা হল খোকা। লোকের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে থানার পথ চিনে সোজা সে হাজির হল থানার অফিস-ঘরে। সামনেই বসে ছিলেন ওসি। দেখলেন বেশ একটা অল্প বয়স্ক ছেলে কি যেন বলবে মনে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি খোকা, কি দরকার তোমার?’
আবার খোকা মনে মনে বেজায় চটে গেল। কিন্তু মুখে শুধু বলল, ‘অনেকগুলি লোক মিলে একটা লোককে খুন করছে।’
ওসির কাজই হল অপরাধ যেন না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা। কাজেই তিনি একেবারে লাফিয়ে উঠলেন।
‘কোথায়? কেমন করে? তুমি কি করে জানলে? খোকা তাকে আদ্যোপান্ত সব ঘটনা খুলে বলল, সব শুনে ও-সি মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাই তো।’
খোকার তখন সাহস আরও বেড়ে গেল। সে বলল, শিগগির চলুন। এতক্ষণে হয়তো লোকটাকে ওরা মেরেই ফেলেছে। ও-সি তখন সঙ্গে জনা দশেক কনস্টেবল নিয়ে একটা জীপে গিয়ে উঠলেন।
জীপগাড়িটা ছুটে চলছে। খোকার তখন কী আরাম। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে খোকা। দুরু দুরু কাঁপছে তার বুক। কত বড় একটা অভিযানে চলেছে সে। তার মনে হয় ওদের জীপটাকে যদি অন্য একটা জীপকে অনুসরণ করতে হত তা হলে বেশ হত। শাই শাই করে বেরিয়ে যেত এক-একটা গাড়ি। অবশেষে অপরাধীর গাড়িটা ধরে ফেলত তারা।
সেই গলির মোড়টা এসে পড়তেই খোকা বলল, “থামুন, এইখানে।। হুড়মুড় করে নেমে পড়ল সাবই। খোকা বলল, সাবধানে পা টিপে টিপে আসুন, নইলে, ফুড়ুৎ।
খুব সন্তর্পণে এগিয়ে এসে সেই একতলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল তারা। ভেতরে তখনও আলো জ্বলছে। আর ঘর থেকে ভেসে আসছে তুমুল হাসির সাড়া। জানালার কাছে এসে খোকা উঁকি মারল।
ওসিকে ফিসফিস করে বলল, ‘ওই ওরা। ওসি এদিক-ওদিক তাকিয়ে, দুয়ারে আঘাত দিল। ভেতর থেকে ভেসে এল কর্কশ কণ্ঠস্বর, কে?’
‘দুয়ার খোলো।’ দুয়ারটা পরক্ষণেই খুলে গেল। একটা লোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কি চান? খোকা দেখেই তাকে চিনতে পারল। সেই রিভলভারধারী।
‘আরে এ যে দেখছি মমতাজ সাহেব।’ ওসি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘কি ব্যাপার?’
মমতাজ সাহেব বললেন, ‘আমিও তো বলি কি ব্যাপার। আপনি যে হঠাৎ! তা আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।’
মমতাজ সাহেবের পিছুপিছু সকলে ঘরে ঢুকল। ও-সি সারাটা ঘর একবার ভাল করে দেখে নিলেন। তারপর চেয়ারের উপর পড়ে থাকা কাগজপত্রগুলি দেখতে-দেখতে হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠলেন।
মমতাজ সাহেব ও তাঁর সঙ্গীরা সকলেই তখন দারুণ হকচকিয়ে গেছেন। একসঙ্গে এতগুলি পুলিশ, দারোগা দেখে সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছিল।
ওসির হাসি দেখে তারা ঘাবড়ে গেল আরও। ওসি তাদের ভয় ভাঙানোর জন্যে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না অসময়ে হানা দিয়ে আপনাদের কাজের ব্যাঘ্যাত করলুম বলে। ব্যাপার কিছুই নয়। আমরা সবাই এসেছিলাম একটা অনুরোধ নিয়ে। আমরা যেন বাদ না পড়ি।’
মমতাজ সাহেবও হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’
তারপা কিছুক্ষণ খোশগল্প করে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আসার সময় খোকাকে শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরতে ভুললেন না ওসি।
বাইরে এসে খোকাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোহন কখানা পড়েছ বল দিকি?’
খোকা বুঝতেই পারল না ও-সি কি বলছেন। এ আবার কেমন রহস্য, সে ভাবল।
‘মাথাটা তো গুলে খেয়েছ। দুনিয়াসুদ্ধ খালি চোর ডাকাত খুনী ছাড়া আর কিছু দেখ না। তোমাদের নিয়ে যে কি হবে,তাই আমি ভেবে পাই না।’ খোকাকে আচ্ছা করে ধমকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলেন।
বড় বড় অক্ষরে নিচের ঘটনাটি বেরুল। গত ১৪ই অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজামিত্র রোডের বাড়িতে আইঢাই অভিনেতা সংঘ যখন তাঁহাদের নতুন নাটক ‘খুন’ এর মহড়া দিতেছিলেন তখন ফরাক্কাবাদের ও-সির নেতৃত্বে একদল পুলিশ তথায় গিয়ে হানা দেয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, সাইফুদ্দীন ওরফে খোকা নামে এক বালক থানা পুলিশকে সংবাদ দেয় যে কিছু লোক মিলে অপর একটি লোককে হত্যা করিতে যাইতেছে। তাহারা সেই লোকটিকে কোনো একটি দলিলে স্বাক্ষর করিবার আদেশসহ আধঘণ্টার সময় দিয়াছে, এই আধঘণ্টার মধ্যে উক্ত দলিলে স্বাক্ষর না করিলে তাহাকে রিভলভার দ্বারা হত্যা করিবার হুমকি দেওয়া হইয়াছে। বালকের নিকট হইতে এই মর্মে সংবাদ পাইয়া ফরক্কাবাদের পুলিশ তথায় হানা দেয়। আরও জানা গিয়াছে যে, থানার ওসি তথায় গিয়া আইঢাই সংঘের প্রসিদ্ধ অভিনেতা মমতাজউদ্দীন সাহেবকে দেখিতে পান। ঘরের মধ্যে ঢোল, তবলা, পোশাক এবং একটি নাটকের পাণ্ডুলিপিও তিনি দেখিতে পান, পাণ্ডুলিপির কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাইয়া তিনি সমগ্র ব্যাপারটি বুঝিতে পারেন। কিছুক্ষণ পূর্বে বালকটি যখন সেই পথ দিয়া অতিক্রম করিতেছিল, তখন নাটকের মহড়া চলিতেছিল, বালকটিকে যথোপযুক্ত ধমক দিয়া ও-সি বাড়ি পৌছাইয়া দেন। জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়া তাহার নিকট হইতে জানা যায় যে, গোয়েন্দাকাহিনী তাহার অত্যন্ত প্রিয়, মোট ১৮০ খানা মোহন সিরিজ, ১৮৯ খনা সেক্রেটন ব্লেক, সব কটি কোনান ডয়েল, নীহার গুপ্ত, পাঁচকড়ি দের সবখানা গোয়েন্দা গ্রন্থ সে ইতিমধ্যেই শেষ করিয়াছে। ছেলেটি আগাথা ক্রিস্টির নাম শুনিয়াছে, তবে ইংরাজি জানা না থাকায় এখনও শুরু করিতে পারে নাই।
[শহীদ সাবের: একজন সাংবাদিক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবী।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন